মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাওর বিলাস...

বে ড়া নো
সুমন্ত গুপ্ত
  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক সৌন্দযের্র দেশ বাংলাদেশ। একেকটি ঋতুতে এ দেশের প্রকৃতি সাজে ভিন্ন ভিন্ন রূপে যা ভ্রমণপিপাসুদের অতৃপ্ত মনকে তৃপ্তি দিয়ে থাকে। সব ঋতুতে যদিও প্রকৃতির বহুরূপী সৌন্দযর্ উপভোগ করা যায়। তবুও নিদির্ষ্ট ঋতুতে কিছু কিছু স্থান যেন তার যৌবন ফিরে পায়। অথার্ৎ সেই নিদির্ষ্ট সময়ে আপনি ওই স্থানের রূপ-সৌন্দযর্ উপভোগ করতে পারবেন অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই। আর শরীর ও মনের ক্লান্তি দূর করতে ভ্রমণের বিকল্প নেই। জুন মাসে কাজের খুব চাপ গিয়েছে অফিসে তাই বন্ধ বারে ঘরে বসে থাকতে মন চাইছিল না আর আমার সব সময়ের ভ্রমণসঙ্গী মাও বলছিল বেশ কিছুদিন হয় কোথাও যাওয়া হয় না।

বাইরে প্রচÐ বৃষ্টি হচ্ছে সঙ্গে মেঘের হুঙ্কার তার মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়ি ঘুরতে কিন্তু কোথায় যাবো ঠিক করতে পারছিলাম না আমার চার চাকার পাইলট মামুন বলল দাদা চলেন হাকালুকি হাওরে ঘুরে আসি আমি ভাবলাম বষার্য় হাওরগুলো অপরূপ রূপ ধারণ করে তাই আর না বললাম না। একদিকে বাইরে ভীষণ বৃষ্টি আর অন্যদিকে গাড়ির সিডি বাজছে ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে...’ এক অন্য রকম পরিবেশ। আমরা এগিয়ে চলছি বৃষ্টিস্নাত মহাসড়ক বেয়ে দূরের পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ভেসে চলা কাপার্শ তুলোর মতো মেঘ, বৃষ্টির জলে এলিয়ে দেয়া নাগরিক জঞ্জালে ক্লান্ত শরীরে স্নেহের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। মাইজগঁাও আসার পর বৃষ্টি কিছুটা কমেছে হঠাৎ করে দেখলাম সেই কু ঝিক ঝিক কু ঝিক ঝিক করা মধুর শব্দ করে ট্রেন আমাদের অতিক্রম করে যাচ্ছে। এদিকে পেটে রাম-রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে আমাদের চার চাকার বাহনের পাইলট মামুনকে বললাম ও বলল আর একটু সামনে গিয়ে নাশতা করাবে। আমরা ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে নামলাম নেমে আল মুমিন রেস্টুরেন্টে বসে নাশতা করলাম গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজি দিয়ে। এর পর গেলাম নৌকা ঘাটে মানুষ কম তার পরেও বড় ছইওয়ালা ট্রলার নিলাম। চারদিকে থইথই পানি, সাগরের মতো ঢেউ আর দূরে দূরে ছোট ছোট হাওর দ্বীপ যে কারোর মনকে মুগ্ধ করবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি। হাওর হলো এমন একটি বিস্তীণর্ এলাকা, যেখানে বৃষ্টি মৌসুমে থইথই জলে পরিপূণর্ হয়ে যায়, সমুদ্রের মতো ঢেউ থাকে। হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পঁাচটি উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। ২৩৮টি বিল ও নদী মিলে তৈরি হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার একরের এ হাওর। বষার্কালে একে হাওর না বলে সমুদ্র বলা যায় অনায়াসে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ হাওরে নানা প্রজাতির মাছ রয়েছে। বষার্য় থইথই পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু স্থানগুলোতে অনেক পাখি আশ্রয় নেয়। আর শীতের সময়ে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি মেলা বসায় হাওরের বুকে। হাকালুকি হাওরের বিলের পাড় ও কান্দায় বিদ্যমান জলাভ‚মিবন পানির নিচে ডুবে গিয়ে সৃষ্টি করেছে ডুবন্ত বন যা ব্যবহৃত হয় মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে। হাওর এলাকার প্রতিটি মানুষ মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত এমনকি ছোট বাচ্চারাও মাছ ধরছে। আমাদের মাঝি সুনীল তার সুমধুর গলায় শাহ আব্দুল করিমের গান ধরলেন... গ্রামের নওজয়ান হিন্দু মুসলমান ... আমাদের সুনীল মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম হাকালুকি নাম কীভাবে হলো তিনি বললেন হাকালুকি হাওরের নামকরণ নিয়ে অনেক মজার মজার কল্পকাহিনী শোনা যায়। হাওর শব্দটি সংস্কৃত শব্দ সাগরের পরিবতির্ত রূপ বলে ধারণা করা হয়। হাওর শব্দের বংশপূবর্ শব্দ ছিল সাগর। এই সাগর থেকে পযার্য়ক্রমে সাগর>সাওর>হাওর শব্দে রূপান্তর হয়েছে। প্রচলিত একটা তথ্য আছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা ওমর মানিক্যের সৈন্যদের ভয়ে বড়লেখা এলাকার কুকি প্রধান হাঙ্গর সিং তখনকার এই হাওর এলাকায় জঙ্গলপূণর্ ও কদর্মাক্ত এলাকায় ‘লুকি দেয়’ অথার্ৎ লুকিয়ে থাকে। কালক্রমে এই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি’। আরেক কাহিনীতে জানা যায় প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচÐ এক ভ‚মিকম্পে ‘আকা’ নামে এক নৃপতি ও তার রাজত্ব মাটির নিচে তলিয়ে যায়। এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভ‚মির নাম হয় ‘আকালুকি বা হাকালুকি’। আরও এক ইতিহাস থেকে শোনা যায় বড়লেখা উপজেলার পশ্চিমাংশে ‘হেংকেল’ নামে একটি উপজাতি বাস করত। ওই উপজাতী এলাকার নাম ছিল ‘হেংকেলুকি’। এটি পরে ‘হাকালুকি’ নাম ধারণ করে। অন্য একটি জনশ্রæতি মতে, একসময় এই হাওরের কাছাকাছি বসবাসকারী কুকি ও নাগা উপজাতি তাদের ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করে ‘হাকালুকি’- যার পূণর্ অথর্ লুকানো সম্পদ। পঁাচটি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওরটি সিলেট ও সীমান্তবতীর্ মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। হাওরের ৪০ শতাংশ অংশ বড়লেখা, ৩০ শতাংশ কুলাউড়া, ১৫ শতাংশ ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০ শতাংশ গোলাপগঞ্জ ও ৫ শতাংশ বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তগর্ত। হাওরের আয়তন ২০ হাজার ৪০০ হেক্টর। ২৪০টি বিল নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওরের বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বষার্কালে এই হাওর ধারণ করে এক অনবদ্য রূপ।

কীভাবে যাবেন : হাকালুকি যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া উপবন এক্সপ্রেস উঠে যাওয়া। নামতে হবে মাইজগঁাও স্টেশনে। এটি সিলেটের ঠিক আগের স্টেশন। ভাড়া নেবে ৩৪০ টাকা। মাইজগঁাও থেকে দুটি উপায়ে যাওয়া যায় হাকালুকি।

ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার হয়ে : মাইজগঁাও থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার, বাজারে নেমেই আল মুমিন রেস্টুরেন্টে বসে যাবেন। সেখানে ফ্রেশ হয়ে, হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা করে সামনের নৌকা ঘাটে চলে আসুন। এখান থেকে নৌকা দরদাম করে উঠে পড়ুন সারা দিনের জন্য। বড় গ্রæপ হলে (১০/১৫ জন) বড় ছইওয়ালা ট্রলার দিন। দিনপ্রতি ভাড়া নিতে পারে চার থেকে পঁাচ হাজার টাকা। কিছু খাবার এবং পানি কিনে নিন, কারণ হাওরে কোনো দোকানপাট পাবেন না। তবে দয়া করে কোনো ধরনের প্লাস্টিকের বোতল, প্যাকেট, খাদ্যদ্রব্য হাওরে ফেলে হাওরের পরিবেশকে দূষিত করবেন না। এবার নৌকায় উঠে কুশিয়ারা নদী পাড়ি দিয়ে হাওরে ঘুরে বেড়ান।

গিলাছড়া বাজার হয়ে : কুশিয়ারা নদীর ৪০ মিনিট সেভ করতে মাইজগঁাও থেকে সরাসরি ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে চলে আসতে পারেন গিলাছড়া বাজারে। এখান থেকেই হাওর শুরু। তবে সমস্যা হলো এখানে বড় নৌকা পাওয়া যায় না। নৌকা আনতে হবে সেই ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার থেকেই। এখানকার লোকজন খুব অতিথিপরায়ণ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<13728 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1