শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বে ড়া নো

আনারস রাজ্যে একদিন...

সুমন্ত গুপ্ত
  ২৮ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমার সহকর্মীরা বলছেন আপনি তো অনেক ঘুরে বেড়ান একবার আমাদের নিয়ে চলেন না কোথাও ঘুরে আসি। আমি মনে মনে ভাবছিলাম কোথায় নিয়ে যাওয়া যায় সবাইকে কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। এদিকে হাসনাত বলে উঠল নতুন কোথাও সে যেতে চায় আমি পড়লাম ভারি মুশকিলে, কী করি- কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়। এদিকে সবাই দিনে দিনে ফিরেও আসতে চায়, হঠাৎ করে বন্ধু তন্ময়ের ফোন কেমন আছিস, অনেকদিন তোকে দেখি না, একদিন আয় আমাদের এই দিকে শ্রীমঙ্গলে। আমি বললাম নতুন কিছু কি আছে দেখার মতো। ও বলল নতুন কিছুই নাই তবে তুই এখন আনারস বাগান দেখতে পারিস শ্রীমঙ্গলের মোহাজেরাবাদ, বিষামণি, পিচের মুখ বা সাতগাঁও পাহাড়ে আনারসের আবাদ হয় চাইলে দেখে আসতে পারিস ভালো লাগবে। আমি মনে মনে খুশি হলাম যাক বাবা একটা জায়গা পাওয়া গেল, এখন সবাই যেতে রাজি হলেই হলো আমি ওকে বললাম আসছে শুক্রবার কি ও ফ্রি থাকবে তবে আমি আমার কয়েক জন অতিথি নিয়ে ওদের এখানে হানা দিতে পারি ও খুব খুশি হলো বলল চলে আয়। আমি সবাইকে বললাম সবাই এক পায়ে রাজি ঠিক হলো শুক্রবার সকালে আমাদের গন্তব্য হবে শ্রীমঙ্গল। সকাল সাতটা সবাই এসে উপস্থিত নতুন ভ্রমণ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য কিন্তু সবার মনে একটু সন্দেহের দোলা এই বুঝি আকাশ ভেঙে মেঘ গড়িয়ে পড়ল কারণ আজ আকাশের মন ভালো নেই। আমরা মোট আটজনের দল রওনা দিলাম সঙ্গে আমাদের পাইলট মামুন গাড়ি চলছে সিলেট শহর থেকে লালাবাজার, তাজপুর হয়ে শ্রীমঙ্গলের দিকে পথিমধ্যে বৃষ্টি হানা দিল সে মুষলধারায় বৃষ্টি, গাড়ি থেকে সামনের কিছু দেখা যায় না। আমি আবার গাড়ির গস্নাস নামিয়ে হাত ভিজিয়ে নিলাম। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমরা চলছি নতুন গন্তব্যে মাঝেমধ্যে বিকট শব্দে বাজ পড়ছে। আমাদের মধ্যে উপস্থিত পান্না আপা খুব ভিতু মানুষ উনি গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার জোগাড়। ওনার ভয় কিছু লাঘব করার জন্য গাড়িতে পুরো ভলিউম দিয়ে গান ছাড়া হলো। গাড়িতে চলছে শ্রীকান্ত আচার্যের গান 'আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম ... শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম ...' দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছালাম শ্রীমঙ্গলে। এবার বিরতির পালা কারণ সবার পেটে রাম রাবণের যুদ্ধ চলছে। আমরা এসে নামলাম চৌমোহনা এলাকার প্রখ্যাত ম্যানেজার স্টলে, সেখানে নাশতা সেরে রওনা দিলাম আমাদের ভ্রমণ গন্তব্যে। পথে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো আমার বন্ধু তন্ময়। চা বাগানের মাঝ দিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি বৃষ্টি ও থেমে গেছে গাছের ফাঁকে সূর্যি মামা উঁকি দিচ্ছেন। চলতি পথে চোখে পড়ল সারি সারি ভ্যানভর্তি আনারস নিয়ে শহরে যাচ্ছে একদল লোক। ভ্যানের পাশাপাশি সাইকেলেও আনারস ঝুলিয়ে বাজারে যাচ্ছে অনেকেই। দেশের সবচেয়ে বেশি আনারস উৎপন্ন হয় এই শ্রীমঙ্গলে, তাই শ্রীমঙ্গলকে অনেকে আনারসের রাজধানীও বলে থাকেন। এই আনারস সারা দেশজুড়েই বিখ্যাত কেননা স্বাদে এই আনারস অতুলনীয় বলছিল আমার বন্ধু তন্ময়। সে সুনামের নমুনা দেখতেই এক শুক্রবার সকালে এখানে আসি। গাড়ি থেকে নেমে আমরা হাঁটা শুরু করি মোহাজেরাবাদের আনারস বাগানের দিকে। সাইকেলবোঝাই আনারস নিয়ে বিক্রির অপেক্ষায় থাকা বনমালি গওলা বলেন, শ্রীমঙ্গলের সুমিষ্ট 'বিলাতি' (হানিকুইন) এবং রসালো 'ক্যালেন্ডার' (জায়ান্ট) আনারসের নাম আজও রয়ে গেছে, কিন্তু মিষ্টতা, সুগন্ধ এবং রসে পরিপূর্ণ আনারসের সে সমাহার আর নেই। উৎপাদন কমে যাওয়ায় শ্রীমঙ্গলের বাজার এখন দখল করে নিয়েছে অন্য জেলার আনারস। ষাটের দশকে শুরু হওয়া আনারস চাষের হিড়িকে দুই দশকের ভিতরেই স্থানীয় 'বালিশিরা হিলস' এবং 'ফয়েজাবাদ হিলস'-এর পুরোটাই আনারস চাষের আওতায় চলে আসে এবং 'শ্রীমঙ্গলের আনারস'-এর পরিচিতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীমঙ্গলের মৌসুমী ফলের বাজারের চিত্র বদলে গেছে। শ্রাবণ-ভাদ্র পর্যন্ত যেখানে ফলের পাইকারি বাজার পূর্ণ থাকত স্থানীয় আনারসে, সেখানে আষাঢ়ের মাঝামাঝিতেই স্থানীয় আনারসের সমাহার কমে যায়। শুরু হয় অন্য জেলা থেকে আনারসের আমদানি। শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা হিলস এবং বাহুবলের ফয়েজাবাদ হিলসের ২০-২৫ হাজার একর জমির আনারস দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভোক্তার রসনা জুগিয়েছে গত চার-পাঁচ দশক পর্যন্ত। কিন্তু এখন ভোক্তার সংখ্যা বাড়লেও আনারসের প্রাপ্যতা তিন-চতুর্থাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। আর এ শূন্যতা পূরণ করছে মধুপুরের আনারস। তবে মধুপুরের আনারসে ভোক্তার রসনা তৃপ্ত হয় না পরিপূর্ণভাবে। মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় ফাঁপানো এ আনারসের সুগন্ধ ও মিষ্টতা শ্রীমঙ্গলের আনারসের ধারে-কাছেও না বলে আনারস ভোক্তাদের অভিমত। এখানে বেচাকেনা শুরু হয় খুব সকালে চলে বিকাল পর্যন্ত। এখনে প্রতি ১০০ আনারস বিক্রির জন্য ভ্যান বা সাইকেলওয়ালা পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। আবার অনেক চাষি বা মহাজন নিজেরাই সাইকেল বা ভ্যানে করে শহরে নিয়ে বিক্রি করেন। আমরা হাঁটছি টিলা বেয়ে আনারস বাগানে নামার সঙ্গে সঙ্গেই নাকে এলো পাকা আনারসের সুমিষ্ট গন্ধ আর আমি একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। চোখে পড়ল শত শত শ্রমিক বাগানের টাটকা আনারস পেড়ে ঠেলাগাড়িতে সাজিয়ে রেখেছে। সাজনো-গোছানো আনারস বাগানের এই সৌন্দর্য কোনো অংশে চা বাগানের চেয়ে কম যায় না। ভ্যানবোঝাই আনারস বিক্রেতা নুরুল বলেন, প্রতি ভ্যানে ১০৫টি আনারস থাকে। তবে ১০৫টি হলেও ধরা হয় ১০০টি। একইভাবে সাইকেলের দুই পাশেও ঝোলানো থাকে ১০৫টি আনারস। এগুলো বিক্রি হয় আকারভেদে। সাধারণত এ হাটে বড় আকারের আনারস প্রতিটি পাইকারি বিক্রি হয় ১৬ থেকে ২১ টাকা। আবার একটু ছোট আকারেরগুলো প্রতিটি বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৫ টাকা। বনমালি গওলা আমাদের জন্য এক পেস্নটভর্তি আনারস নিয়ে এলেন। আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না হাত না ধুয়েই মুখে দিলাম আনারস বললেন ওনাদের বাগান থেকে সদ্য আনা পাকা আনারস।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<47117 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1