মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
এই মেঘ এই বৃষ্টি। খানিক বাদেই রোদের হাসি। সে এক প্রকৃতির আপন খেয়াল। প্রকৃতি তার খেয়াল নিয়েই থাক, আমরা 'দে-ছুট' ভ্রমণ সংঘের দল তার তোয়াক্কা না করে ছুটে চলি প্রাকৃতিক কোনো এক বিস্ময়ের পানে। আমাদের এবারের ভ্রমণ ছিল দুটি পাতা একটি কুঁড়ি-দুইশত ষাট আউলিয়ার পুণ্যভূমি, সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত অপরূপ সৌন্দর্যের জলার বন রাতারগুল। রাতের গাড়িতে রওনা হয়ে সকালে গিয়ে সিলেট পৌঁছি। হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে সোজা চলে গেলাম লালাখাল। সারি নদীর ঘাট থেকে ট্রলারে চেপে দুপুর পর্যন্ত লালাখালে ভেসে বেড়ালাম। সৌন্দর্যের উপমা লালাখালের বর্ণনা আজ আর নাই-বা দিলাম। অতঃপর জোহরের নামাজ শেষে মোটরঘাট গিয়ে ইটালি হোটেলে (খোলা আকাশের নিচে তিনটি দশ ইঞ্চি ইটের উপর বসে) খিচুড়ি খেলাম। মরিচের গুঁড়া মেশানো আলুভর্তা খেয়ে আলাল আর কামাল পুরোই বেসামাল। এরপরও ক্ষুদা পেটে সেই খিচুড়ি খেতে লেগেছিল বেশ। 'দে-ছুট'-এর আভিধানিক অর্থই হচ্ছে যখন যেমন, তখন তেমন। ভ্রূ কুঁচকানোর কোনো সুযোগ নেই। খাওয়া-দাওয়া শেষে গাইড এমরানের ঠিক করা নৌকায় উঠে বসলাম। 'দে-ছুট'- এর দল নিয়ে ছয়টি ডিঙ্গি নৌকা লতা, গুল্ম ভেদ করে সাপ, বিচ্ছুকে সঙ্গী করে বনের গভীরে যাচ্ছে। নৌকাগুলো যতই এগিয়ে যায়, ততই মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকি। বনের ভিতর গাছের মগডালে তাকালে এক অদ্ভুদ আনন্দ মনে দোলা দেয়। সাপ-বিচ্ছুর বন রাতারগুল। তবে ভয় পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ বৈজ্ঞানিক মতে অধিকাংশ সর্পই বিষক্রিয়াহীন। গাছের ডালপালাগুলো দেখে এমন মনে হবে যেন পর্যটকদের আগমনে তারা আনন্দে নিত্যরত। বড় বড় বিচ্ছু, সাপ যেন আপন মনে বিশ্রাম নিচ্ছে। খুব কাছ থেকে ফটো তুলতেও তাদের কোনো খেদ নেই। বরং মনে হয় তারা ফটোসেশনের জন্য প্রস্তুত। ভিন্ন রকমের এক মায়াবী বন। ৫০৪ একর আয়তনের এই বনে হিজল, করচ, তমাল, অর্জুন, কদম, বনজাম, মুর্তা আর জারুল বৃক্ষের সমারোহ। বনের পানি প্রবাহ হয় পার্শ্ববর্তী গোয়াইন নদী থেকে। গভীর বনে আছে বানর, নানা প্রজাতির সাপ, মেছো বাঘ, ভোদরসহ বিভিন্ন প্রাণী। নীলাভ স্বচ্ছ জলের ওপর ভাসমান বন রাতারগুল। বর্ষা মৌসুমে এই বনের গাছপালা গড়পড়তা ৮-১০ ফুট পর্যন্ত ডুবে থাকে। অবশিষ্ট অংশ পানির ওপর। স্বচ্ছ জলে ভ্রমণপিপাসুরা তাদের নিজ চেহারার প্রতিচ্ছবি দেখে ভুলভ্রান্তি থেকে নিজেকে শুধরে নেয়। যেমনটি হয়েছে মোস্তাক পুরো বিকালটা জলবনে ঘুরে যখন সন্ধ্যায় ডাঙ্গায় ফিরছি তখনি ঘটল এক ভয়ানক অভিজ্ঞতার কান্ড। বিরল প্রজাতির ভাইপার গ্রিন পিটার সাপের ছবি খুব কাছ থেকে তুলতে গিয়ে ডিঙ্গি ডুবল। ভাগ্য ভালো যে, যত সামান্য সাঁতার জানা ছিল। পায়ের তালুতে যখন ডুবন্ত গাছের লতাপাতা জড়িয়ে যাচ্ছিল তখন বেশ ভয় পেয়েছিলাম। বন্ধুরা চিৎকারে করে অভয় দিলেন জাভেদ তুমি ভয় পেয়ো না। ভয় পেয়ো না বললেই কি আর হয়! জীবনে এই প্রথম নৌকাডুবির অভিজ্ঞতা, তাও আবার সাপ-বিচ্ছুর বনে। সঙ্গীদের নৌকায় টেনে উঠানোর আগ পর্যন্ত ভেবেছিলাম এই বুঝি 'দে-ছুট'-এর ইতি। নিজেকে স্বাভাবিক করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছে। এই ফাঁকে পিন্টু আমার বিদ্ধস্ত হওয়ার করুণ অবস্থা ক্যামেরায় ধারণ করে নিয়েছে। সেই ছবি থাক স্মৃতি হয়ে। ভয়কে জয় করেই 'দে-ছুট' ঘুরে বেড়ায় দেশের নানান দুর্গম পাহাড় আর গহিন বনজঙ্গলে।
ভ্রমণ তথ্য : বর্ষা মৌসুমেই রাতারগুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার মোক্ষম সময়। সিলেটের সুন্দরবন বলে খ্যাত রাতারগুল ভ্রমণে, পর্যটকরা পাবেন এক অন্য রকম অনুভূতি, মনে জাগবে ভিন্ন রকম শিহরণ, যা শুধু স্বচক্ষে দেখাতেই সম্ভব। সারা পৃথিবীতে ২২টি সোয়াম্প ফরেস্ট (জলার বন) আছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে একটি। সত্যিই জাতি হিসেবে আমরা প্রকৃতির কৃপাকে পুঁজি করে বিশ্বের পর্যটন দরবারে গর্ব করতে পারি।
পর্যটকদের প্রতি সিলেটের হোটেল, রেস্টুুরেন্ট ও পরিবহন ব্যবসায় জড়িতদের আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। যথার্থ মানসম্পন্ন সেবাই উন্নত পর্যটন শিল্প বিকাশে সহায়ক। পাঠক বুঝতেই পারছেন ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গ টেনে, আপনাদের নিষ্কণ্টক ভ্রমণের জন্য কি বুঝাতে চেয়েছি।
যাতায়াত : দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সিলেট কীভাবে যেতে হবে তা সবারই জানা আছে। সিলেট শহরে পৌঁছে, হুমায়ুন চত্বর/আম্বরখানা থেকে লেগুনা, সিএনজিতে চড়ে গোয়াইন ঘাট উপজেলার মোটরঘাট। সেখান থেকে নৌকায় বন ভ্রমণ।
টিপস
# পানিতে অপচনশীল কিছু ফেলবেন না।
# লাইফ জ্যাকেট পরে নিবেন।
# গাছের পাশ বা নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় সাপ, বিচ্ছু খেয়াল করে যাবেন
# গাড়ি ও নৌকা ভাড়া এবং খাবারসামগ্রী দরদাম করে নিবেন।