যদি কেউ এই অভিযোগ করে যে বাংলাদেশে দেখার মতো স্থান নেই তবে তার এই অভিযোগের জন্য তাকে শাস্তি দেয়া যায় না বরং তাকে জানিয়ে দেয়া যায় যে আমাদের এই দেশটিতে দেখার মতো কী কী আছে। বিশ্বাস করুন যদি আপনি যদি বাংলাদেশ ভ্রমণে বের হোন তবে বছরেও শেষ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। বাংলাদেশর প্রায় প্রতিটি স্থানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সৌন্দযের্র সমাহার। তেমনই এক নৈস্বগির্ক সৌন্দযের্ ভরপুর বাংলাদেশের ভোলাগঞ্জ স্থানটি। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দযের্র পাশাপাশি সিলেটের সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য অনন্তকাল ধরে দেশি-বিদেশি পযর্টকদের মুগ্ধ করেছে। ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে কথা শুনেছি সেই ছোটবেলার থেকেই কিন্তু সময়ের অভাবে দেখার সময় হয়ে ওঠেনি। অনেকদিন ধরে প্ল্যান করি ভোলাগঞ্জ যাবো কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠছিল না শেষ পযর্ন্ত আমরা রওনা দিলাম। আগের থেকেই ভোলাগঞ্জের আলিম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম তার কথামতো ভোরে সিলেটেই পৌঁছে আমরা রওনা দিই গন্তব্য পানে আর ভ্রমণ সঙ্গী আমার মা। আকাশ একটু মেঘলা, মিষ্টি রোদ, অজানা পথ আর দূরে পাহাড়ের হাতছানি; আমাদের কেমন মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। মায়াময় পথে ভুলেছিলাম সবকিছুই। দূরের পাহাড় কখন কাছে আসবে আর যেন তর সইছিল না। মাঝেমধ্যে বেরসিক রাস্তার কারণে খুব রাগ হচ্ছিল নিজের ওপরে আমরা চাইলেই এই রাস্তাগুলোকে সুন্দর করে রাখতে পারি। মজা শুরু হলো যখন দূরের পাহাড় চোখে পড়ল। পথে গাড়ি ছিল না মোটেই, একটু পর পর দুই একটা সিএনজি ছাড়া আমরা ছিলাম একরকম নিজর্নতায়। পরে খেয়াল হয়েছিল যে পথের দুপাশে ধান খেত ছিল কিন্তু তখন চোখে ছিল একটা জিনিসই; সামনের ছায়ার মতো পাহাড়, হালকা কুয়াশাঘেরা দিগন্ত। সে সব মাঠে মাঠে কচি ধানগাছ হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। মাসের শেষে ধান কাটা হবে এমন দৃশ্য দেখে জীবনানন্দ দাশের গ্রামবাংলার কথা মনে পড়ে গেল। বাংলার সে রূপ দেখে দেখে আমরা ভোলাগঞ্জের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। পথের অবস্থা খুবই খারাপ। শেষে কবে এই পথে পিচ বা ঢালাই পড়েছিল, সেটা বিশাল এক গবেষণার বিষয়। তবুও এর মধ্যেই রাস্তার দুই পাশের শোভা দশের্নর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আলিম ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাকে নিয়ে সরাসরি চলে যাই পাথর কোয়ারিতে। পাথর কোয়ারির লাখ লাখ মানুষের কমর্যজ্ঞ আর ধলাই নদীর মায়াবী রূপ পথের সব ক্লান্তি দূর করে দিল। আলিম ভাই বলছিলেন ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে শুষ্ক মৌসুমে প্রধানত গতর্ খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে শ্রমিকরা প্রথমে কোয়ারির ওপরের বালি অপসারণ করে। পযার্য়ক্রমে গতর্ খুঁড়ে নিচের দিকে যেতে থাকে। ৭-৮ ফুট নিচু গতর্ খেঁাড়ার পর কোয়ারিতে পানি উঠে যায়। পানি উঠে গেলে শ্যালো মেশিন দিয়ে কোয়ারির পানি অপসারণ করে শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন করে। এর বাইরে ‘শিবের নৌকা’ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের উপায় হচ্ছেÑ একটি খালি নৌকায় শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন লাগানো হয়। ইঞ্জিনের পাখা পানির নিচে ঘুরতে থাকে। পাখা অনবরত ঘুরতে ঘুরতে মাটি নরম হয়ে পাথর বেরোতে থাকে। সংশ্লিষ্টরা ঝুঁকির সাহায্যে পাথর নৌকায় তোলে। এ পদ্ধতিতে সহস্রাধিক শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে থাকে। এরপর আমরা ভারত বাংলাদেশের সীমান্তের ১২৪৯- ১-ঝ পিলারের কাছে গেলাম। সেখানে সন্ধান পেলাম সেই পাকিস্তান আমলের পিলার।
রোপওয়ের ইতিহাস বলতে গিয়ে আলিম ভাই বললেন ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর সঙ্গে প্রতিবছর বষার্কালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুদ। এই পাথর দিয়ে পঞ্চাশ বছর চালানো যাবেÑ এই হিসাব ধরে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পযর্ন্ত সময়কালে সোয়া দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নিমার্ণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পযর্ন্ত সোয়া ১১ মাইল দীঘর্ রোপওয়ের জন্য নিমার্ণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন পয়েন্ট। মধ্যখানে চারটি সাব স্টেশন। দুই প্রান্তে ডিজেলচালিত দুটি ইলেক্ট্রিক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনি, স্কুল, মসজিদ ও রেস্ট হাউস নিমার্ণও প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। এক্সক্যাভেশন পয়েন্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পযর্ন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও বতর্মানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পযার্প্ত লোকবলের অভাব, পাথরের অপযার্প্ততা ও বিকল ইঞ্জিনের কারণে দীঘর্ প্রায় ১২ বছর ধরে এক্সক্যাভেশন মেশিন বন্ধ রয়েছে। আগে উত্তোলিত পাথর ভাঙা, ধোয়া ও টুকরোর আকার অনুসারে বালু, স্টোন চিপস ও ট্রাক ব্যালাস্ট ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ করা হতো। শ্রেণি অনুসারে সেগুলো পৃথক পৃথকভাবে বের হয়ে রোপওয়েতে ঝুলানো চারকোনা বিশিষ্ট স্টিলের বাকেটে জমা হতো। প্রতিটি বাকেটের ধারণক্ষমতা ২৩৭ কেজি (প্রায় ১২০ ফুট)। পাথরভতির্ বাকেট পাঠানো হতো ছাতকে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ঠিকাদাররা স্থানীয়ভাবে বোল্ডার পাথর ক্রয়ের পর তা ভেঙে বিভিন্ন সাইজে বিভক্ত করে। তারপর তা বাকেটে পুরে ছাতকে প্রেরণ করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পয়েন্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভ‚ত হয়েছে। কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে-পিয়াইন নদীর সঙ্গে। রোপওয়ের আয়তন প্রায় ১০০ একর। দেখতে দেখতে সূযাের্স্তর সময় হয়ে গিয়েছিল। এর আগেও অনেক সূযার্স্ত দেখেছি অন্য কোনো নদীর বুকে বা সমুদ্রের বুকে কিংবা পাহাড়ের গায়ে তাই আমার চোখ সেদিকে ছিল না। আমি চেয়েছিলাম ওই দুই পাহাড়ের কোণায় যেখানে ধলাই নদী হারিয়ে গেছে ভারতের মধ্যে। একই নদী, সীমানার ওপারে হয়তো একই রকম পাহাড়, মানুষজনও একই। কিন্তু কেমন যেন ভুতুড়ে লাগছিল দূর থেকে। আমার দেখতে ইচ্ছা করছিল নদীটা সেখানে কেমন! হয়তো এই কারণে যে ওপাশে গমন নিষেধ। আর মানুষের সুলভ জিনিসের চেয়ে নিষিদ্ধের প্রতি টান বেশি।