শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৭০০ পেরিয়ে 'কঞ্জুস'

তারার মেলা রিপোর্ট
  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
'কঞ্জুস' মঞ্চ নাটকের দৃশ্য

'কঞ্জুস'। দেশীয় মঞ্চনাটকে ঐতিহাসিক ও অনন্য এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী নাম। ১৯৮৭ সাল থেকে আজ অবধি সমানতালে মঞ্চ মাতিয়ে যাচ্ছে নাটকটি। গতবছর ৭০০তম মঞ্চায়ন হয়ে গেছে। দেশের কোনো মঞ্চনাটকের এটাই প্রথম ৭০০তম প্রদর্শনী। সম্প্রতি ৭০১তম মঞ্চায়ন দিয়ে ২০১৯ শুরু করল বহুল আলোচিত 'কঞ্জুস'।

৩০ বছর ধরে নাটকটি মঞ্চায়ন করছে লোক নাট্যদল। মানুষের চিরায়ত প্রবৃত্তি লোভ, স্বার্থপরতা, সঙ্কীর্ণতা প্রভৃতি কঞ্জুস নাটকে ফুটে উঠেছে। হাস্যরসের মাধ্যমে মানুষের কুপ্রবৃত্তিগুলোকে বিদ্রম্নপ করে সমাজকে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এ নাটকে। নাটকটির শততম প্রদর্শনী হয় ১৯৯৩ সালের ১২ ফেব্রম্নয়ারি। ৪০০তম প্রদর্শনী হয় ২০০১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর নাটকটির ৫০০তম প্রদর্শনী হয়। এর মধ্যে ১৯৮৮ (লোক নাট্যদল টিএসসি) ও ২০০৫ সালে (লোক নাট্যদল বনানী) লোক নাট্যদল বিভক্ত হয়। পরে লোক নাট্যদল টিএসসি আর সক্রিয় থাকেনি। লোক নাট্যদল, বনানী অন্য নাটকসহ কঞ্জুস নিয়ে তাদের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য কঞ্জুস নাটকের ইতিহাস আরও পুরনো। ১৯৮২ সালে ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি) থেকে বেশ কজন নাট্যকর্মী পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরেন। দেশে ফিরে তারা প্রতিষ্ঠা করেন 'নাট্যদল' নামের একটি মঞ্চনাটকের দল। সঙ্গে আরও কয়েকজন। এর মধ্যে আছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ, তারিক আনাম খান, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, গোলাম সারোয়ার, লিয়াকত আলী লাকী, কামাল উদ্দিন নীলু প্রমুখ। তারিক আনাম খান ফরাসি নাট্যকার মলিয়েরের দ্য মাইজার অবলম্বনে অনুবাদ করলেন কঞ্জুস নাটকটি। ১৯৮৩ সালের প্রথম দিকে নাটকটি মঞ্চে আনা হয়। শুরু থেকেই নাটকটি দর্শকের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছে।

শুধু জনপ্রিয়তা আর দর্শক নয়, দেশে ও বিদেশে বহুবার পুরস্কার অর্জন করেছে কঞ্জুস। ১৯৯৩ সালে দিলিস্নতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিকে অন্যতম সেরা প্রযোজনার পুরস্কার পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় একাধিক বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছে। ইউরোপের মোনাকোয় অনুষ্ঠিত 'বিশ্ব থিয়েটার উৎসব-২০১৩'তে অংশগ্রহণ করে প্রশংসিত হয়। যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডি সেন্টারেও কঞ্জুসের উপস্থাপনা দর্শকনন্দিত হয়।

৭০০ পেরিয়ে যাওয়া 'কঞ্জুস' নিয়ে লোক নাট্যদলের প্রধান লিয়াকত আলী বলেন, 'জীবদ্দশায় মলিয়ের সমালোচকদের দ্বারা নানাভাবে সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু তার নাটক দেশে দেশে মানুষের মধ্যে কত যে শক্তি সঞ্চয় করেছে, তা কঞ্জুস নাটকটি দিয়েই বোঝা যায়। প্রযোজনাটির তুমুল জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে এটি মলিয়েরের নাটক। নাট্যকার হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ইংরেজদের শেক্সপিয়ার, তেমনি ফরাসিদের আছে মলিয়ের। ৩০ বছর ধরে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে। তাই বলে এক জায়গায় থেমে থাকেনি নাটকের ঘটনাপ্রবাহ। গল্পের মূল কাঠামো ঠিক রেখে অসংখ্যবার পরিবর্তিত হয়েছে অন্তর্গত বিষয়। সব সময়ই নাটকের ভেতরে জুড়ে দেয়া হয়েছে সমকালের ঘটনাপ্রবাহ। বিশ্ব শান্তিকে বিঘ্নিত করা ঘটনা ও অমানবিক মানুষগুলোকে নিয়ে বারবার স্যাটায়ার করা হয়েছে এ নাটকে। তাই নাটকে হাস্যরসাত্মক সংলাপের ভেতর দিয়ে এসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা ইরাক আগ্রাসন বা বাস্তুচু্যত মানুষের রোহিঙ্গা ইসু্য। সংলাপের পাশাপাশি একইভাবে মঞ্চসজ্জা ও অভিনয়শিল্পীদের পোশাকেও পরিবর্তন এসেছে অসংখ্যবার।'

ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সাম্মানিক বিশ্ব সভাপতি রামেন্দু মজুমদার বলেন, 'প্রযোজনাটি গল্প, সংলাপ আর অভিনয় মিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে কমেডি আর কঞ্জুস সমার্থক হয়ে গেছে। নাট্য নির্দেশক আতাউর রহমান বলেন, কঞ্জুস নাট্য প্রযোজনা আমাদের দেশে মঞ্চায়নের পরিসংখ্যানে মাইলফলক। দীর্ঘ মঞ্চায়নের পরিক্রমায় এর নির্দেশক দর্শক রুচির সঙ্গে সংগতি রক্ষার জন্য বিভিন্ন সময়ে নাটকটির পরিবর্তন ও পরিমার্জন করছেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি বজায় রেখে প্রযোজনাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন।'

নাট্যজন আতাউর রহমান বলেন, 'কঞ্জুস নাটকের দর্শক জনপ্রিয়তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রযোজনাটির গভীরতাও রয়েছে। তারিক আনামের রূপান্তর যেমন চমৎকার তেমনি লিয়াকত আলী লাকীর নির্দেশনাও সুচারু। দেশজ প্রেক্ষাপটের সঙ্গে দারুণভাবে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে মলিয়েরের কাহিনীকে। নাটকের গল্পের হাড়কিপটে বুড়োর মতোই আমাদের সমাজের চারপাশেও এমন অনেক মানুষ আছে। সেই প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ঢাকাইয়াদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে প্রযোজনাটিতে। আশা করি, বহু বছর মঞ্চস্থ হবে কঞ্জুস।

অভিনেতা, নির্দেশক ও নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, এ ধরনের জনপ্রিয় নাটক আরও বেশি মঞ্চে আসা উচিত। চিন্তাসমৃদ্ধ নাটকের বাইরে হাস্যরসাত্মক নাটকও যে মাইলস্টোন হতে পারে, তারই প্রমাণ কঞ্জুস। দেশের নাট্যচর্চা ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে কঞ্জুস।

কঞ্জুসের মূল্যায়ন করে নাট্য অনুবাদক ও সমালোচক ড. আবদুস সেলিম বলেন, 'কোন নাটকের সাত শ'তম মঞ্চায়ন পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে বিস্তৃত করা রীতিমত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। লোক নাট্যদলের দালিলিক নীতিমালার অন্যতম একটি হলো দর্শক সৃষ্টি করা। এই কাজটি কঞ্জুস নাটকের মাধ্যমে যে আশাতীতভাবে সম্পন্ন হয়েছে তা বাংলাদেশের কোনো নাট্যামোদিই অস্বীকার করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, ১৯৮৭ থেকে ৩০ বছরে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের শৈলিত পরিবর্তন করে যুগপোযোগী হয়েছে কঞ্জুস। আমি মনে করি, নাটকটির দর্শক নন্দনের মূল চাবিকাঠি এইটি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<38647 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1