বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

৩৮ বছর ধরে একটি নৃত্যানুষ্ঠান সঞ্চালনা করছি

একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণীশিল্পী লায়লা হাসান। যিনি একাধারে একজন শব্দসৈনিক, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী। নাচের পাশাপাশি অভিনয় করেন নাটক ও চলচ্চিত্রে।
মাসুদুর রহমান
  ০২ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০
লায়লা হাসান

বতর্মানে আপনার ব্যস্ততা প্রসঙ্গে বলুনÑ

নাচ-অভিনয় দুটি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে নাচের পেছনে একটু বেশি সময় দেয়ার চেষ্টা করি। সারা বছর কমবেশি নাচ নিয়ে থাকলেও বিশেষ দিবস উপলক্ষে ব্যস্ততা একটু বেড়ে যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘রুমঝুম’ নামের নাচের অনুষ্ঠানটি নিয়মিত করছি। এর ফঁাকে অভিনয়ও করা হয়। এর মধ্যে ‘জাতীয় মামা’ শিরোনামে ঈদের একটি নাটকের কাজ শেষ করলাম। চ্যানেল আইয়ের জন্য আশফাক নিপুণের একটি ধারাবাহিকে কাজ করছি। দ্বীপ্ত টিভির একটি ধারাবাহিক, হিমেল আশরাফ, তপু খান, ফারুকসহ আরও কয়েকজন পরিচালকের নাটকগুলো হাতে রয়েছে।

বিটিভির ‘রুমঝুম’ অনুষ্ঠানটি কখন শুরু হয়েছিল

১৯৮০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে শুরু হয়েছিল ছোটদের নাচ শেখার অনুষ্ঠান ‘রুমঝুম’। ৩৮ বছর ধরে এ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করছি। সুদীঘর্ বছরে অনুষ্ঠানটির আলাদা একটা গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। নাচ নিয়ে এটিই আমার প্রথম টেলিভিশনের বড় আয়োজন। দেশের একাধিক শিল্পীই এর মাধ্যমে উঠে এসেছে।

চ্যানেলগুলোতে নাচের অনুষ্ঠান তেমন একটা হয় নাÑ এর কারণ কী বলে মনে করেন?

চ্যানেল কতৃর্পক্ষদের নাচের প্রতি এত অনীহা কেন তা আমি ভেবে পাই না। এটি কিন্তু একটি গুরুত্বপূণর্ শিল্প। পৃথিবীর আদিকাল থেকে গানের পাশাপাশি নাচ শব্দটি উচ্চারণ হয়ে এলেও এর প্রতি অনেকের আগ্রহ নেই। গান নিয়ে অনেক কিছু হলেও নাচ নিয়ে তেমন কিছুই হয় না। এটা অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়।

এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি?

নাচ নিয়ে আমরা নৃত্যশিল্পীরা বরাবরই নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। আমাদের চেষ্টার ফলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগ খোলা হয়েছে। শিক্ষাথীর্রা নৃত্যের মাধ্যমে আমাদের দেশ ও তার ঐতিহ্য সারাবিশ্বের সম্মুখে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরবে। এ ছাড়া সংখ্যায় কম হলেও চ্যানেলেগুলোতে যেসব নাচের অনুষ্ঠান প্রচার হয়, তা আমাদের চেষ্টার ফলেই। নাচের অনুষ্ঠান বাড়াতে কিংবা নিয়মিত প্রচার করতে চ্যানেল কতৃর্পক্ষের সঙ্গে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। চ্যানেলের বাইরেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোতে নাচ উপস্থাপন হয়। এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে আমরা আসলে নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

দশর্করা নাচের অনুষ্ঠান কেমন উপভোগ করে বলে মনে হয়?

দশর্ক কিন্তু নাচ দেখতে চায়। নাচের প্রতি মানুষের আলাদা ভালোলাগা কাজ করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মঞ্চে যখন নাচ উপস্থাপন হয় তখন কিন্তু দশর্ক মগ্ন হয়ে তা দেখেন, উপভোগ করেন এবং মুগ্ধ হন। কিন্তু আয়োজক কিংবা কতৃর্পক্ষের কারণেই নাচকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাচ্ছিল্যও করা হয়। তবে আমাদের পাশের দেশ ভারতের চ্যানেলে নাচের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এগুলো বেশ সাড়াও পাচ্ছে। আমাদের দেশেও কিন্তু বিভিন্ন আয়োজনে নাচ দেখানো হয়। দশর্ক না চাইলে তো এসব করা সম্ভব হতো না।

নতুনরা কেমন করছে?

নতুনরা খারাপ করছে না। তারা ভালো করছে। তারা দেশের বাইরে গিয়েও নাচের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আগের তুলনায় অনেকেই নাচের প্রতি ঝুঁকছে। তবে, তাদের শেখার আগ্রহের চেয়ে নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টাটা অনেক বেশি। ভালোভাবে না শিখেই তারা মঞ্চে ওঠতে চায়। অনেক ক্ষেত্রে এখন শুদ্ধ নাচের চচার্ কম হচ্ছে। নতুনরা নাচের শাস্ত্রীয় জ্ঞান থেকে দূরে থাকছে। এখন তো নাচের মধ্যে নানা কিছুর সংমিশ্রণ হয়ে গেছে। ফলে নাচের মৌলিকত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। নাচ আত্মস্থ করা খুব সহজ নয়। এর জন্য অনেক সাধনার প্রয়োজন আছে। নতুনরা সেই সাধনা করতে চায় না।

নাচের প্রতি আপনার আগ্রহটা কীভাবে হয়?

পারিবারিকভাবেই নাচের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়। আমার পরিবার ছিল সংস্কৃতিক মনা। পারিবারিকভাবেই আমি সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়েছি। তাই এসব করতে গিয়ে আমাকে কোনো বাধার সম্মুখিন হতে হয়নি। যদিও ওই সময়ে এসব করা খুব কঠিন ছিল, মেয়েদের বেলায় তো বটেই। কিন্তু আমি পারিবার থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। বড়দের কাছে শুনেছি দুই/আড়াই বছর বয়সেই নাকি আমি নিজে নিজে নাচতাম। মিউজিক শুনলেই নাচতে শুরু করতাম। তিন বছর বয়সে আমি মঞ্চে পারফমর্ করি। এভাবেই আমার বেড়ে ওঠা। শুধু নাচই না, ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতাম। অভিনয়ও করি তখন থেকেই।

শুনেছি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আপনার নাম রেখেছিলেন?

হ্যঁা, বাংলাদেশের বিখ্যাত পল্লী সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আমার নাম রেখেছিলেন রোজি। তিনি আমার নানার বন্ধু ছিলেন। আমার নানা তৎকালীন সময়ে রাজনীতি করতেন। নানার সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের যোগাযোগ ভালো ছিল। সুযোগ পেলেই তিনি নানার বাসায় আসতেন। পারিবারিকভাবে আমাকে সবাই রোজি নামেই ডাকতেন। এখনো আত্মীয়স্বজন এই নামেই সম্বোধন করেন। তবে আমার আরেকটি নাম হচ্ছে লায়লা নাগির্স। বিয়ের পর থেকে নাম হয় লায়লা হাসান।

অভিনয়ের অধ্যায় নিয়ে জানতে চাই?

অনেক আগে থেকেই অভিনয় করি, সেই ছোটবেলা থেকেই। বিটিভির যাত্রার শুরু থেকেই অভিনয়ে কাজ করছি। আমি মঞ্চেও কাজ করেছি। ৬৯’র গণআন্দোলনের সময় মঞ্চে ‘রক্তকরবী’ নাটকে অভিনয় করেছিলাম। এ ছাড়াও মঞ্চ নাটক করেছি অনেক। টেলিভিশন নাটকে আমার প্রথম অভিনয় মনে নেই। সম্ভবত নাটকটির প্রযোজক ছিলেন মুস্তাফা মনওয়ার। তবে, বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘দম্পতি’তে আমি অভিনয় করেছি। ‘সমুদ্র অনেক দূর’, ‘রতœদ্বীপ’, ‘মন পবনের নাও’, ‘কাজল রেখা’, ‘ভেলুয়া সুন্দরী’, ‘মহুয়া, রানি ভবানীর পথ, সহ ওই সময়ের প্রথম দিকের অনেক নাটকেই অভিনয় করেছি। এখনো অভিনয় করছি। সম্প্রতি কয়েকটি নাটকে কাজ করলাম। এরমধ্যে অনিমেষ আইচের দুটি, চয়নিকা চৌধুরীর একটি নাটক ও প্রয়াত নায়ক রাজ্জাকের ছোট ছেলে সম্রাটের ‘বাবা’সহ অন্যদেরও আছে। অভিনয় করলেও আমি নাচের পেছনে বেশি সময় দিয়ে আসছি।

চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করছেন না কেন?

খুব বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা হয়নি। ৫-৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। প্রথম ছবির নাম মনে না থাকলেও দু’একটি সিনেমার নাম বলতে পারব। এরমধ্যে গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ এর নাম খুব ভালো করে মনে আছে। এ ছাড়া ‘ঘরে বাইরে’, ‘এইতো প্রেম’, ধ্রæব খানের ‘দাহকাল’, শাহ আলম মÐলের একটি সিনেমা খুব সম্ভব নাম ‘সাদাকালো প্রেম’সহ আরো কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছি। পূণৈর্দঘর্্য ছাড়া কয়েকটি স্বল্পদৈঘর্্য চলচ্চিত্রেও কাজ করেছি।

আপনার জীবনের স্মরণীয় কাজ নিয়ে কিছু বলুন-

দুটো কাজ আমার জীবনের স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একটি রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ আর অন্যটি বাংলা অনুবাদকৃত নাটক। বিদেশি নাটকটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। স্বামী-স্ত্রীর চরিত্রে আমি ও হাসান ইমাম অভিনয় করেছিলাম।

দাম্পত্য জীবনের ৫৩ বছর পার করেছেনÑ এ বিষয়ে কিছু জানতে চাই

গত ৩০ জুন আমাদের বিবাহিত জীবনের ৫৩ বছর পার করেছি। ১৯৬৫ সালে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির পরিবারকে কখনো অচেনা মনে হয়নি। এটাকেই নিজের আসল ঠিকানা মনে করে নিয়েছিলাম। বিয়ের পর থেকেই আমরা দুজন দুই পরিবার থেকে এক পরিবার হয়েছি। দাম্পত্যজীবনে আমরা খুবই সুখী। পরিবার আর ক্যারিয়ারের কোনো কাজ আলোচনা না করে, তিনিও করেননি, আমিও না। সবকিছু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই করতাম। আমার স্বামী ছিল সবচেয়ে বেশি সাপোটির্ভ। শ্বশুরবাড়ি থেকেও কেউ আমাকে কোনো কাজে বাধা দেয়নি। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সবাই খুব ভালো ছিলেন। শ্বশুরবাড়ির সবাই আমার নাচ, আমার নাটক ভীষণ ভালোবাসতেন। আমার শাশুড়ি আমাকে সাংস্কৃতিক কমর্কাÐে উৎসাহ দিতেন। আমি দুই সন্তানের মা হলে বাচ্চাদের দেখাশোনাও তিনি করতেন, আমি নিবিের্ঘœ কাজ করতাম।

দু’জনের একসঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?

আমি ও হাসান দু’জনে একসঙ্গে চলচ্চিত্র ও নাটকে অনেক কাজ করেছি। এতে অনেক ভালোলাগে। অভিনয়ে সুবিধাও হয়। গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রেও একসঙ্গে কাজ করেছি। সম্প্রতি ধ্রæব খান ও শাহআলম মÐলের দুটি সিনেমায় দুজনে একসঙ্গে অভিনয় করেছি। প্রয়াত নায়ক রাজ্জাকের ছেলে সম্রাটের ‘বাবা’ নাটকেও আমরা দু’জনে একসঙ্গে কাজ করেছি।

আপনি ও হাসান ইমাম সফল তারকা দম্পতি। তাই আপনি তারকাদের সংসার ভাঙন নিয়ে কিছু বলুনÑ

সবার মনমানসিকতা এক নয়। সবার সমস্যা-সম্ভাবনাও সমান হয় না। প্রায়ই শোনা যায় তারকা জগতের সংসার ভাঙার খবর। এসব সত্যিই দুঃখজনক। দাম্পত্যজীবনে সমস্যা থাকতে পারে তবে সেগুলোকে মানিয়ে নিতে হবে। দু’জনকেই ধৈযর্্যশীল, সহনশীল এবং সেকরিফাইজের মানসিকতা থাকতে হবে। একে অপরকে বুঝতে হবে। শতভাগ মনের মিল না হতে পারে তাই বলে নিজের চাওয়াকেই প্রাধান্য দেয়াটা ঠিক না। যে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভালো করে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

নতুনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন?

নতুনদের সব সময়ই স্বাগত। তাদের যথেষ্ট মেধা আছে, এটা কাজে লাগাতে হবে। বিনয়ী, ধৈযর্্যশীল, সহনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কাজের প্রতি একনিষ্ঠ না হলে চলবে না। কঠোর পরিশ্রমে সফলতা তোমায় ধরা দেবেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<6091 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1