মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
চার পুলিশসহ ৫ জন আহত

পল্লবী থানায় বোমা বিস্ফোরণ

যাযাদি রিপোর্ট
  ৩০ জুলাই ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ৩০ জুলাই ২০২০, ০০:০৫
বোমা বিস্ফোরণের পর পলস্নবী থানার ভেতরে একটি কক্ষের চিত্র -বিবিসি বাংলা

দেশজুড়ে জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় পুলিশ বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা জারির পর সপ্তাহ না ঘুরতেই ইমপ্রোভাইজড এক্সপেস্নাসিভ ডিভাইস (আইইডি) বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল ঢাকা মহানগরীর পলস্নবী থানা। বুধবার সকালে এ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশের চার সদস্যসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। যদিও এ ঘটনার সঙ্গে কোনো ধরনের জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতা নেই বলে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও একই কথা জানিয়েছেন। তবে এতে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও এ ধরনের হামলার আশঙ্কা দেশব্যাপী সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করার পরও পলস্নবী থানা পুলিশ কীভাবে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে পাওয়া একটি বিশেষ ডিভাইস এতটা অসতর্কতার সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে এটির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ বোমাটি আরও শক্তিশালী হলে ব্যাপক প্রাণহানি হতো-এমন উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা বলেছেন, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনা আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এমন ঘটনা না-ও ঘটতে পারত। পলস্নবী থানা পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, বুধবার সকাল ৭টায় থানার ভেতর বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরণের পর গোটা থানা ভবন কেঁপে ওঠে। এ সময় থানার বেশ কয়েকটি জানালার কাচ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। বিস্ফোরণে থানার পরিদর্শক (অভিযান) ইমরানুল ইসলাম, উপপরিদর্শক (এসআই) সজীব খান, উপপরিদর্শক (এসআই) রুমি বেভরেজ হায়দায়, শিক্ষানবিশ সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) অঙ্কুর কুমার এবং পরিদর্শক ইমরানুল ইসলামের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী বেসামরিক ব্যক্তি রিয়াজুল ইসলাম আহত হন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার ওয়ালিদ হোসেন এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ইমরানুল ইসলামের বাঁ পায়ের মাংস থেঁতলে গেছে। বোমা বিস্ফোরণে প্রচন্ড শব্দের কারণে কানে শুনতে পাচ্ছেন না সজীব খান। অঙ্কুশ কুমার বাঁ চোখে আঘাত পেয়েছেন। রুমি বেভরেজ হায়দায়ের শরীর ঝলসে গেছে। রিয়াজুল ইসলামের বাঁ হাতের কবজি জখম হয়েছে। রুমি ও রিয়াজুল ইসলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ইমরানুল ও সজীব ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। অঙ্কুশ কুমার জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বস্নকের আবাসিক সার্জন আলাউদ্দিন জানান, রুমির বাঁ হাতে স্পিস্নন্টারের আঘাত রয়েছে। রিয়াজুল ইসলাম হাতে আঘাত আছে। তার শরীরও ঝলসে গেছে। ইমরানুলের পায়ে স্পিস্নন্টারের আঘাত ও সজীবের কানে শব্দের আঘাত লেগেছে। এছাড়া অঙ্কুশ কুমার চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাকে জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। আহত সবাই আশঙ্কামুক্ত। পলস্নবী থানা পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতে থানার বিশেষ টিম পলস্নবী-কালশী কবরস্থানে অভিযান চালিয়ে তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র, চারটি গুলি ও একটি ডিজিটাল ওয়েট মেশিনের মতো ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। সেগুলো থানার ডিউটি অফিসারের রুমে রাখা হয়। বুধবার সকালে ডিজিটাল ওয়েট মেশিনের মতো ডিভাইসটি বিস্ফোরিত হয়। বোমা বিস্ফোরণে থানার দ্বিতীয় তলার একটি ঘরের জানালার কাঁচ ভেঙে যায়। ডিজিটাল ডিভাইসটির মধ্যে বোমা রাখা ছিল। দুটি তাজা বোমা ছিল। থানা পুলিশের দাবি, গ্রেপ্তারকৃত তিন সন্ত্রাসী শাহাদাত বাহিনীর সহযোগী। পুলিশের কাছে তথ্য ছিল, স্থানীয় এক রাজনীতিককে হত্যার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। তাদের সঙ্গে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতা নেই বলে থানা পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে। তবে বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, এরা জঙ্গি না, এরা সন্ত্রাসী। এ ঘটনায় জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রম্নপের অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উলস্নাহ বলেন, বিস্ফোরণের আলামত সংগ্রহ করা হয়েছেন। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ইম্প্রোভাইজড এক্সপেস্নাসিভ ডিভাইস (আইইডি) জাতীয় কিছু বিস্ফোরিত হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় জানান, পলস্নবী থানা পুলিশ ও মিরপুরের ডিবির নেতৃত্বে একটা টিম কাজ করছিল কয়েকদিন ধরে। একটি গ্রুপ ক্রাইম করতে পারে বা ক্রাইম হতে পারে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত রাত ২টার দিকে কালশী কবরস্থানের দিকে পুলিশের একটি টিম যায়। সেখানে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ সমবেত হয়ে ক্রাইম করার পরিকল্পনা করছে- এমন খবরে পলস্নবী থানা পুলিশ সেখানে অপারেশনে গিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তবে সেখান থেকে বেশ কয়েকজন পালিয়ে যায়। সেখান থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। একটি ডিভাইস উদ্ধার করা হয় যেটি ওয়েট মেশিনের মতো। পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ওজন মেশিনের মতো কোনো জিনিস কেন তাদের কাছে থাকবে? সেটা কী প্রশ্ন ওঠায় রাতেই বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটকে খবর দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট থানায় চলে আসে। তারা ওই ডিভাইসটিকে স্টাডি করে। সেটা দেখার পর তারা আরও বিশদভাবে ডিভাইসগুলো খতিয়ে দেখতে আরও কিছু পর্যবেক্ষণ মেশিনসহ আনার জন্য ইউনিটের অন্য সহকর্মীদের খবর দেয়। তারা যখন আরও পর্যবেক্ষণ মেশিন নিয়ে আসছিল তখন থানার ভেতর একটি বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ ঘটার পরে চার পুলিশ সদস্যসহ পাঁচ সদস্য আহত হন। পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এক্সপার্ট টিম এসে পৌঁছানোর পর তারা পুরো এলাকা সিকিউরড করে। প্রাথমিক স্তরে থেকে তারা ধারণা দেয় যে, আরও কিছু বিস্ফোরক অবিস্ফোরিত থাকতে পারে। এরপর আরও দুটি অবিস্ফোরিত এক্সপেস্নাসিভ নিষ্ক্রিয় করে থানা ভবন নিরাপদ করা হয়। এদিকে এ ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও বিস্ফোরিত বোমাটি ইআইডি হলে এ বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা জানান, ইমপ্রোভাইজড এক্সপেস্নাসিভ ডিভাইস একটি বোমা যা প্রচলিত সামরিক পদ্ধতি ছাড়া অন্যভাবে নির্মিত। আইইডি সামরিক সদস্য, যানবাহন, স্থাপনা প্রভৃতির ক্ষতি সাধনের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিছু ক্ষেত্রে আইইডিগুলো একটি বিরোধী পক্ষকে বিভ্রান্ত করতে, তাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে বা বিলম্ব করতে ব্যবহৃত হয়। আইইডি সাধারণত সামরিক বা বাণিজ্যিক বিস্ফোরক সহযোগে তৈরি। তবে প্রায়ই উভয় প্রকারের সংমিশ্রণ ঘটে থাকে। তবে বাড়িতে তৈরি বিস্ফোরক হোমমেইড এক্সপেস্নাসিভের (এইচএমই) ব্যবহারও হয়। একটি এইচএমই ল্যাব একটি হোমমেড বিস্ফোরক ল্যাব বা ভৌত অবস্থান যেখানে ডিভাইসগুলো তৈরি করা হয়েছে তা বোঝায়। একটি আইইডির পাঁচটি উপাদান রয়েছে। এর একটি সুইচ (অ্যাক্টিভেটর), একটি ইনিশিয়েটর (ফিউজ), ধারক (দেহ), চার্জ (বিস্ফোরক), এবং একটি পাওয়ার উৎস (ব্যাটারি)। সেনা বহনকারী যান বা ট্যাঙ্কের মতো সাঁজোয়া লক্ষ্যগুলোর বিরুদ্ধে শেইপড চার্জ ব্যবহার করা হয়। আইইডি ডিজাইনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বৈচিত্র্য থাকে। অ্যান্টিপারসনেল আইইডিগুলোতে সাধারণত ক্ষত তৈরি করার জন্য পিন, বল বিয়ারিং এমনকি ছোট ছোট কাচ বা পাথরের মতো বস্তু থাকে। আইইডিগুলো রিমোট কন্ট্রোল, ইনফ্রারেড বা চৌম্বকীয় ট্রিগার, চাপ-সংবেদনশীল বার বা ট্রিপ ওয়্যারসহ বিভিন্ন পদ্ধতি দ্বারা সক্রিয় করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে, একাধিক আইইডি একসঙ্গে চেইনে তারযুক্ত করা সড়কপথ ধরে ছড়িয়ে থাকা যানবাহনের একটি কনভয়ে আক্রমণ করার জন্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে