মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
আবরার হত্যাকান্ড ইসু্য

রাজপথ-শিক্ষাঙ্গন: সর্বত্র সতর্ক দৃষ্টি সরকারের

যে-কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষা প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গের্ যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৩৪
আবরার ফাহাদ

বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আন্দোলন স্থগিত করা হলেও মামলার চার্জশিটের পর অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কার না করা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা এবং এ ইসু্যতে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার ঘোষণার বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না সরকার। বরং স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ষড়যন্ত্র চলছে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। তাই এ ইসু্যতে সৃষ্ট যে-কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষা প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গের্ যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। আবরার হত্যাকান্ড নিয়ে আন্দোলনের নামে কেউ অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালালে তা তাৎক্ষণিক কঠোরভাবে প্রতিহত করার পাশাপাশি এ অপতৎপরতায় লিপ্ত ব্যক্তিবর্গ ও তাদের নির্দেশদাতাদের দ্রম্নত গ্রেপ্তার করার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। প্রশাসনের দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, আবরার হত্যাকান্ডের ইসু্যতে বুয়েটের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ষড়যন্ত্রকারী একাধিক চক্র মুখিয়ে রয়েছে। তারা ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উসকানি দিচ্ছে। জামায়াত-শিবির ও হিযবুত তাহরীরসহ মৌলবাদী একাধিক সংগঠন এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে। এ অবস্থায় ঢাকাসহ সব মহানগরী এবং জেলা পর্যায়ের প্রতিটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নজরদারি বাড়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তর এ ব্যাপারে প্রতিটি মহানগরের পুলিশ কমিশনার এবং জেলার এসপিদের অবহিত করেছে। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এদিকে কোনো ষড়যন্ত্রকারী চক্র যাতে আবরার ইসু্যতে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তুলতে না পারে এজন্য দেশের প্রতিটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ ধরনের কোনো অপতৎপরতা নজরে আসা মাত্র তা দ্রম্নত সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অবহিত করারও তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখছে আইসিটি গোয়েন্দারা। এসব ফেসবুক আইডি ব্যবহারকারীর পরিচয় কী, তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আছে কিনা, জামায়াত-শিবির, হিযবুত তাহরীর কিংবা কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে তারা সংশ্লিষ্ট কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি এসব আইডি ফেক কিনা সে ব্যাপারেও গোপন অনুসন্ধান চলছে। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, গত বছরের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কেরর্ যাডিসন বস্নু হোটেলের সামনের রাস্তায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বেপরোয়া বাসের চাপায় নিহত হওয়ার পর তাদের সহপাঠীদের ক্ষোভ প্রাথমিক পর্যায়ে সামাল না দেওয়ায় পরবর্তীতে তা গোটা ঢাকার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ অরাজকতায় রূপ নেয়। ষড়যন্ত্রকারী একাধিক চক্র ওই সময় কৌশলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে চলমান আন্দোলনকে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে ঠেলে নিয়ে যায়, যা পরবর্তীতে সামাল দিতে সরকারকে ভীষণভাবে হিমশিম খেতে হয়। তাই আবরার ইসু্যতে যেন সে ধরনের কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় এবং কোনো ষড়যন্ত্রকারী চক্র যাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আগের মতো একই ফাঁদে ফেলতে না পারে এজন্য আগাম সতর্কতা অবলম্বন করছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা জানান, বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আবরার হত্যা মামলার চার্জশিটের পর অভিযুক্তদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার না করা পর্যন্ত একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। কেননা, নিবিড় পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্পর্শকাতর এ হত্যা মামলার চার্জশিট দিতে আরও অন্তত তিন সপ্তাহ সময় লাগবে, যা তদন্তে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আগেই জানিয়েছেন। আর এই দীর্ঘ সময় বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করলে একদিকে যেমন তারা একাডেমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী তাদের প্ররোচিত করার সুযোগ পাবে। তাই এ সময়টুকু সরকারের 'ক্রুশিয়াল মোমেন্ট' হিসেবে বিবেচনায় রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বুয়েট প্রশাসনকে সতর্ক থাকার জন্য গোয়েন্দারা পরামর্শ দিয়েছে। এ নিয়ে একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'আবরার হত্যায় জড়িতদের অবশ্যই শাস্তি হবে। বিবেকের রায় থেকে ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবে বিএনপি নির্বাচনে ব্যর্থ হয়ে আবরার হত্যাকে ইসু্য করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে।' অন্যদিকে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকান্ডে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। একই সঙ্গে এ মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' হত্যাকান্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমরা দেখেছি দেশে কোনো ঘটনা ঘটলে একটি মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করে। এখনো সেই চেষ্টা হচ্ছে। কেউ এই ঘটনাকে পুঁজি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করবে, সেটি হতে দেওয়া যাবে না।' নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার জন্য দুই দিন আন্দোলন শিথিল করার আগে থেকেই তারা উপর মহলের নির্দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নজরদারি বাড়িয়েছেন, যা এখনো চলমান আছে। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এ ইসু্যতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি অন্য কোনো ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী যাতে শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের উসকানি দিচ্ছে কিনা সে ব্যাপারেও তাদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। এদিকে আবরার হত্যামামলার চার্জশিটের পর অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কার না করা পর্যন্ত একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিলেও এ সুযোগে স্বার্থান্বেষী কোনো সংগঠন যাতে তাদের নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে না পারে সে ব্যাপারে বুয়েটের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও সতর্ক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, আবরার হত্যাকান্ডকে পুঁজি করে অনেকে নানা ফন্দি এঁটেছে। এ ইসু্যতে তারা তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এ ফাঁদে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই পা দেবে না। এমনকি রাজপথের আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করে এসব অপশক্তি যাতে এ ইসু্যটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে না পারে সে ব্যাপারেও তাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানান, ভারতের সঙ্গে সরকারের 'দেশবিরোধী' চুক্তির প্রতিবাদ করায় আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে-বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ একাধিক রাজনৈতিক নেতা এমন বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত নির্যাতনকারীদের স্বীকারোক্তি এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তদন্তকারী গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিবির সন্দেহে তারা আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আবরারের রুমমেট মিজানই ছাত্রলীগ নেতাদের এ তথ্য দিয়েছিলেন। তাই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যে এ ইসু্যতে বিশেষ ফন্দি এঁটে বুয়েটসহ সারা দেশের শিক্ষাঙ্গন অস্থিতিশীল করে তুলতে চাইছে তা তাদের এ ধরনের তৎপরতায় স্পষ্ট হয়েছে। তাই এ ব্যাপারে তারা এখন অনেক বেশি সতর্ক-দাবি করেন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে