শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
সিএনএনের প্রতিবেদন

বাগদাদি :ধূম্রজালে ঘেরা এক জিহাদির উত্থান-পতন

প্রতিবেদনটিতে বাগদাদিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে 'ইসলামের বিকৃতকারী' হিসেবে ২০১০ সালে অভিযানে আইএসের শীর্ষ নেতার মৃতু্যর পর বাগদাদি শীর্ষ পদে আসীন হন
যাযাদি ডেস্ক
  ২৮ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
এই গাড়িতে আইএস নেতা বাগদাদি নিহত হন

ঘৃণা প্রচারক, নৃশংস বর্বরতার প্ররোচক ও উসকানিদাতা, দীর্ঘদিন ধরে পলাতক, যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল অসংখ্য ড্রোন, স্বঘোষিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার আগে-পরে যাকে মাত্র একবারই জনসম্মুখে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সেই শীর্ষনেতা আবু বকর আল-বাগদাদির মৃতু্যর খবর এখন ভেসে বেড়াচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে। বছর তিনেক আগেও 'মূর্তিমান এই আতঙ্ক'কে নিয়ে সারা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো ব্যস্ত থাকতো, মার্কিন অভিযানে তার নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার পর গণমাধ্যমগুলো ফিরে দেখছে সেই দিনগুলো। মার্কিন সংবাদমাধ্যম 'সিএনএন' তাদের প্রতিবেদনে বাগদাদিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে 'ইসলামের বিকৃতকারী' হিসেবে। বলা হচ্ছে, তার 'দূষিত' মতবাদ ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মূলে এমন ভূমিকা রেখেছে ১৯৭০-এর পর বিশ্ব আর যা দেখেনি। ইরাকি নাগরিক, কট্টর রক্ষণশীল ধর্মপ্রচারক বাগদাদি জঙ্গি বিদ্রোহী দলগুলোর কর্মকান্ডে সক্রিয় হয়ে ওঠেন গত দশকের শুরুর দিক থেকে। ২০০৩ সালে মার্কিন অভিযানে ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতাচু্যত ও মৃতু্যদন্ড কার্যকর হওয়ার পর ইরাক ও এর আশপাশের দেশগুলোতে তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী। আবু গারিব ও ক্যাম্প বুকাতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আটক থাকার সময়ই বাগদাদির দেখা হয় ভবিষ্যতের জিহাদি নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা অনেকের সঙ্গে। বাগদাদি ইরাকে ফিরে এসে যোগ দেন আল-কায়েদায়; জঙ্গি এ গোষ্ঠীটি যখন আরও অনেকের সঙ্গে মিলে গঠন করেন 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক'- তার উত্থান তখন মধ্যগগনে। ২০১০ সালে মার্কিন-ইরাকি যৌথ অভিযানে ইসলামিক স্টেট অব ইরাকের শীর্ষ নেতার মৃতু্যর পর বাগদাদি সংগঠনটির শীর্ষ পদে আসীন হন। মার্কিন সামরিক বাহিনীর বড় অংশের ইরাক ত্যাগের সুযোগে জঙ্গি এ গোষ্ঠীটি বিস্তার লাভ করতে থাকে। পার্শ্ববর্তী দেশ সিরিয়ায় চলা ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে সেখানকার কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাগদাদি ২০১৩ সালে তার সংগঠনের নাম বদলে রাখেন 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড আল-শাম'। সংক্ষেপে আইএসআইএস। অল্প কিছুকালের মধ্যেই এ জঙ্গিগোষ্ঠীটি সিরিয়া ও ইরাকে অভাবনীয় সাফল্য পায়। ২০১৪ সালে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলের গ্র্যান্ড আল-নূরি মসজিদে বাগদাদি সিরিয়া ও ইরাকের দখলকৃত বিশাল অংশজুড়ে 'খিলাফত' ঘোষণা করেন। এর আগে ও পরে জনসম্মুখে এটাকেই তার একমাত্র উপস্থিতি বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। আনুষ্ঠানিকভাবে তখন থেকেই 'আইএস' নামে পরিচিত বাগদাদির এই বাহিনী তার নিয়ন্ত্রিত অংশ ও আশপাশের অঞ্চলগুলোতে অকথ্য বর্বরতার নিদর্শন দেখানোর পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোতে সাধারণ মানুষের ওপর বেশ কয়েকটি বড় বড় হামলা চালিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আইএসের এমন উত্থানের আগে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল বাশার আল-আসাদবিরোধী শিবিরের তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য আঞ্চলিক দেশ সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে। বাগদাদির তথাকথিত খিলাফত ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র সেই অবস্থান থেকে সরে কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) দিকে হেলে পড়ে। প্রায় একই সময় রাশিয়াও ইরানের মতো বাশারের পাশে এসে দাঁড়ায়। এরপর সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং এসডিএফ আইএস-বিরোধী পৃথক অভিযান শুরু করলে একটার পর একটা অঞ্চল বাগদাদির হাতছাড়া হতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় আইএসের 'স্স্নিপার সেল' ও 'লোন উলফ'রা ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রেও অন্তত তিনটি 'মাস কিলিংয়ের' (গণহত্যা) ঘটনায় হামলাকারীদের বাগদাদির প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইএসের মানচিত্র যতই সংকুচিত হয়ে আসছিল, যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী, রাশিয়া ও ইরানের মতো শক্তিগুলোর বাগদাদিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা ততই বিস্তৃত হচ্ছিল। যদিও আইএসের খিলাফত গুঁড়িয়ে দেয়ার অনেক মাস পরেও বাগদাদি কোথায়, তা ছিল অজানা। তার অবস্থান ও ভাগ্য নিয়ে বেশ কয়েকবারই পরস্পর-বিরোধী তথ্য পাওয়া গেলেও কখনোই সেগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। চলতি বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে রুশ ভাইস অ্যাডমিরাল ইগর কস্তিওকভ বাগদাদির অবস্থান অজানা বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। সিরিয়ার আর যেখানেই থাকুক না কেন, ইদলিবে আইএসপ্রধান নেই বলেও জোর দিয়ে বলেছিলেন তিনি। যদিও শনিবার থেকে মার্কিন গণমাধ্যমে বাগদাদির নিহত হওয়ার খবরে ওই অঞ্চলে বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছে বলে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। ইদলিবে ঘাঁটি ছিল মূলত আইএসের প্রতিদ্বন্দ্বী হায়াত তাহরির আল-শামের। আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট নুসরা ফ্রন্টের সঙ্গে যোগসাজশ থাকা এ গোষ্ঠীটির প্রধান ছিলেন বাগদাদিরই একসময়কার সহযোগী আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। তার আইএসআইএসে যোগ দিতে অস্বীকার করার ঘটনা ওই অঞ্চলের সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ তৈরি করেছিল। বাগদাদি ১৯৭১ সালে ইরাকের সামারায় জন্মগ্রহণ করেন বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাগদাদের ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ইসলামী সংস্কৃতি ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ে উচ্চতর অধ্যয়ন শেষে তিনি সামারার একটি মসজিদে ধর্মের বয়ান ও প্রচারকাজ শুরু করেন। এক জিহাদি ওয়েবসাইটে তার পুরো নাম লেখা হয়েছে 'ইব্রাহিম বিন আওয়াদ দিন ইব্রাহিম আল-বদ্রি আল-রাধোই আল-হুসেইন আল-সামারাই'। ২০০৪ সালে ইরাকে মার্কিন বাহিনীবিরোধী সুন্নি বিদ্রোহের সময় আটক হন তিনি। ২০০৯ পর্যন্ত তিনি মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন বলে বেশকিছু প্রতিবেদনে ধারণা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন বন্দিশিবিরে তার নাম ছিল ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আল-বদ্রি। ২০১৪ সালে মসুলে ওই উপস্থিতির পর বাগদাদিকে আর কখনোই দৃশ্যপটে দেখা যায়নি। ২০১৭ সালে ফের তার আহত হওয়ার খবর ছড়ায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ২০১৮ সালে ইরাক ও সিরিয়ার বেশিরভাগ অংশ হাতছাড়া হওয়া আইএস বাগদাদির একটি অডিও রেকর্ড প্রকাশ করে। ওই রেকর্ডে এ জঙ্গিনেতাকে তার বাহিনীর পিছু হটার কথা স্বীকার করতে শোনা যায়। বক্তব্যে বাগদাদি ধারাবাহিক পরাজয়কে 'আলস্নাহর পরীক্ষা' অভিহিত করে যোদ্ধাদের দৃঢ় মনোবলে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। তারপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। শেষে রোববার যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভিযানে বাগদাদির নিহত হওয়ার খবর দেয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে