ছাত্র আন্দোলন সড়ক নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা সচেতনতা সৃষ্টিতে জাতিকে ঘুরে দঁাড়ানোর এক নতুন বঁাকে নিয়ে যাবে বলে মনে হয়। সমাজে, রাষ্ট্রে, ঘটনা, দুঘর্টনা কত কিছুই ঘটে থাকে। কত ঘটনা হিসাবভুক্ত হয় না, ইতিহাসে থাকে না। সড়ক দুঘর্টনায় মৃত্যুর যে মিছিল সে ক্ষেত্রে চিত্রটা যেন পারিবারিক বলয় থেকে সমাজে ও রাষ্ট্রে বিস্তৃতি লাভ করে তা যেন মহাশোকের প্লাবন বয়ে দেয়ার পরিণতির উদ্ভব ঘটার অবস্থা। প্রতিদিন সড়ক দুঘর্টনায় এত লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন যে তাকে মৃত্যুর মিছিল হিসেবেই আখ্যায়িত করা যেতে পারে। সড়ক পথের বিশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তাহীনতা যেন ভয়াবহ দুযোের্গ পরিণত হতে যাচ্ছিল। এমনি এক কঠিন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বিবেকের কাছে দায় এড়িয়ে যারা বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার হুলি খেলায় মেতে উঠেছিল তাদের বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়ানোর জন্য কিশোর-কিশোরী, যুব-যুবতী ছাত্ররা রাস্তায় আন্দোলনে নেমে পড়ে। একে আন্দোলনে না বলে নিরাপত্তার জন্য মহড়া বলা যেতে পারে।
ছাত্রদের এ আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে বিতকির্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ কেউ এটাকে সরকার উচ্ছেদের পদক্ষেপ, ক্ষোভ, অসন্তোষ বলতে চেষ্টা করেছেন, কেউবা বিরোধীদলীয় রাজনীতির ভ‚মিকা বলে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলন আপামর জনগণের সুখের ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আন্দোলন। এই আন্দোলনকে কোনোভাবে বিকৃত বা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বরং জাতি যেভাবে শৃৃঙ্খলা জ্ঞান বিবজির্ত হয়ে অসচেতনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে ডুবে যাচ্ছিলÑ সেই অমানিশার ঘোর কাটাতে ছাত্রসমাজ যে ভ‚মিকা রেখেছে তা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিকতার মানদÐেই নিরূপিত হবে। এই আন্দোলন আসলে সরকার বা বিরোধী দল কারও পক্ষের না, বিপক্ষের নয় বরং এ দাবি সবর্সাধারণের এবং তাকে জনগণের পক্ষের আন্দোলন বলেই মনে হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, কোমলমতি শিক্ষাথীর্রা তাদের নতুন ধারার অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের সুশীল সমাজ, মন্ত্রী, এমপি, পেশাজীবী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সবোর্পরি রাষ্ট্রের সামনে এক শিক্ষণীয় উদাহরণ তৈরি করেছে। এ উদাহরণ শৃঙ্খলার এবং সচেতনতাবোধের উদাহরণ। ঘুমিয়ে পড়া জাতিকে শৃঙ্খলা ও সচেতনায় উজ্জীবিত করার উদাহরণ। আন্দোলনের সময়ে শিক্ষাথীর্রা ট্রাফিকের ভ‚মিকায় অবতীণর্ হয়ে যে সেবা দেশবাসীকে দিয়েছে তাতে অনেকের সেবার মানকে ¤øান করে দিয়েছে। তাদের দাবিতে আজ বিপরীতে লাইসেন্স ও ফিটনেস নবায়নের ধুম পড়েছে। সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। এমনকি পথচারীরা রাস্তা পারাপারে সতকর্তা ও নিয়ম রক্ষায় সচেতন হয়ে উঠেছে। যা অনেকেই করতে ব্যথর্ হয়েছে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতেই প্রস্তাবিত সড়ক নিরাপত্তা আইন দ্রæত মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বহুমুখী সফল আন্দোলনের সম্প্রতি যোগ হলো সড়কের বিশৃঙ্খলা ও মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে শিক্ষাথীের্দর যুগান্তকারী এক অনন্য আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। গঠনতান্ত্রিক আন্দোলন, নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন কোনো অথের্ই খারাপ নয়। তবে এসব আন্দোলনকে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন সুষ্ঠু ও সুন্দর আন্দোলন পরিচালনার মূল নায়ক। তিনি যেখানে অনিয়ম দেখেছেন, নৈরাজ্য দেখেছেন এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দেখেছেন সেখানেই সোচ্চার হয়েছেন এবং তা মোকাবেলা করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যায়নকালে অবিভক্ত ভারতের নেতা জওহরলাল নেহরুর সামনে দঁাড়িয়ে ছাত্রাবাসের অব্যবস্থার কথা বলেছেন। দেশ বিভাগের আগে ও পরে স্বৈরাচারী সরকারের তোপের মুখে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন। সেই সূত্র ধরে যদি আমরা দেখি, তাহলে অবশ্যই বলতে হবে যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পযর্ন্ত আমাদের ছাত্র আন্দোলনের অনেক গৌরব গঁাথা আছে। সেই গৌরবময় ইতিহাসের মাধ্যমে ছাত্রসমাজ জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছে। যে ছাত্র রাজনীতি ছিল এককালের অনুকরণীয় আদশর্ তা আজ যেন ভ‚লণ্ঠিত, অবদমিত পযাের্য় এসে পেঁৗছেছে। আজ যে ছাত্রসমাজ বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক পরিসরে পরিণত করেছেন। খেলার পুতুলের গুটির মতো করে তাদের ব্যবহার করতে চেষ্টা করছেন।
আজ বতর্মান ছাত্রসমাজের অনেকেই লেজুরবৃত্তির আবতের্ আবতির্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধারা পযর্ন্ত অজির্ত বাঙালি জাতীয়তাবোধের ধারাকে অঁাকড়ে ধরে রেখেছেন। কিন্তু পযার্য় ক্রমিক সামরিক অভ্যুত্থান, সেনাশাসন, স্বৈরশাসন ইত্যাদির কারণে ছাত্র রাজনীতি বা আন্দোলন যেন এক অবক্ষয়ী নিতে ছাত্রসমাজ তাদের অজির্ত সুনামকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাথাের্ন্বষী বা সুবিধাভোগী রাজনীতির ধারার লেজুরবৃত্তির মাধ্যমে বিতকির্ত ও কালিমালিপ্ত করে তুলেছেন। যদি বাড়িয়ে বলা হয়, তাহলে বলতে হবে যে টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, চঁাদাবাজির মতো কলঙ্কের তিলক মাথায় নিয়ে এক কালো অধ্যায়ই রচিত হয়েছে। যার ফলে বিগত কয়েক দশক থেকে সংগঠিত ছাত্র রাজনীতি বলতে যা বোঝায় তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। তার জলন্ত প্রমাণ হচ্ছেÑ ছাত্র সমাজ আর নিবার্চন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো সংগঠিত ও সুসংহত ছাত্র সংসদ উপহার দিতে পারছে না। এবং সে পরিবেশ তৈরি করতেও সক্ষম হচ্ছে না। পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় ছাত্র সংসদ নিবার্চন দিয়ে ছাত্র সমাজকে এক, অভিন্ন ছাতার নিচে আনতে ব্যথর্ হচ্ছে। উল্লেখ্য, এই আন্দোলনের মাঝপথে এ দেশেরই কুচক্রিমহল ছাত্রদের এ আন্দোলনকে ইস্যু করে দেশে নৈরাজ্য, খুনাখুনি সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। মরিয়া হয়ে উঠছে দেশকে অচল করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভালো-মন্দ দুটি ভাগে বিভক্ত করে দেয়ার এ যেন এক কুৎসিত ষড়যন্ত্র।
তবে সাম্প্রতিক আন্দোলন যে ইস্যুতে হয়েছে তাতে ছাত্র সমাজ তাদের হৃত গৌরব অনেকটাই পুনরুদ্ধার করেছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা আঙুল তুলে যেভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি যারা বেআইনিভাবে লাইসেন্সবিহীন গাড়ি নামিয়েছেন তাদের মুখোমুখি হয়েছেন এবং তাদের আইনভঙ্গকারী আখ্যায়িত করে লজ্জার ফঁাদে ফেলে দিয়েছেন। এই চিত্রে সাধারণ জনগণ খুশিই হয়েছেন। এই কাযর্ক্রমকে প্রকারান্তরে উৎসাহিত করে অনেক অভিভাবকরা, মায়েরা তাদের কিশোর ছেলেমেয়েদের রাস্তার শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে আন্দোলন বা পদক্ষেপ তাকে স্বাগত জানিয়ে ছেলেমেয়েদের বাড়ি ফেরা পযর্ন্ত গাইড করেছেন। কিন্তু এই সুন্দর কাযর্ক্রমকে পুঁজি করে অন্য খাতে প্রবাহিত করণের জন্য কেউ কেউ নেতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টির উস্কানি দিতেও তৎপর ছিলেন। কেউবা তাদের এই সুনাম অজর্ন করা অবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে শান্তিপ্রিয় ছেলেমেয়েদের হেনস্তা করতেও পিছপা হন নাই। কিন্তু তাদের এই কুৎসিত তদারকি ও ঘৃণ্য কাযর্ক্রমকে সফল হতে দেয়া যাবে না।
ছাত্রদের সব দাবি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। তাই আমাদের উচিত কোনো উস্কানি দাতা, মদদদাতার ছোবলে পড়ে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎত নষ্ট হয়ে যেন না পাড়ে। স্ব স্ব অবস্থান থেকে সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে সব কিছুকে ধৈযের্র সঙ্গে মোকাবেলা করে অগ্রসর হতে হবে আজকের ছাত্র সমাজ যদি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হতে পারেÑ তাহলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবেই বা কি করে? আগামীতে দেশের নেতৃত্বে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। তাই এই আন্দোলন থেকে আমাদের যেন বোধোদয় ঘটে। শপথ নিতে হবে সঠিক নেতৃত্বের। শৃঙ্খলা ও সচেতনার মাধ্যমে সুন্দর সমাজ বিনিমাের্ণ আমাদের মনোযোগী হতে হবে।
এখন সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট সব কতৃর্পক্ষকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনকৃত সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস ও তা কাযর্কর করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাহলে সারাদেশের মানুষ উপকৃত হবে। ছাত্রদের অহিংস আন্দোলনে গাড়ি ভাংচুর হয় না। অবশ্য এ আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দিতে আড়ালে-আবডালে কতই-না অপতৎপরতা ছিল।
অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে জাতির বিবেকের দৈন্যতার অবসান ঘটে থাকে। জাতি দীক্ষিত হয় সত্যের অনুসন্ধানে এবং সত্যের আগমনী বাতার্য় অশুভচক্র হয়তো সংশোধিত হয় অথবা নিপতিত হয়। এমন অবস্থায় অশুভচক্রের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জাতিকে সবর্দা সতকর্তার পথ অবলম্বন করতে হবে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: কলামিস্ট ও গবেষক