শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিশেষ প্রতিবেদন

জানাজা থেকেও বিদ্রোহের প্রত্যয়

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির
যাযাদি ডেস্ক
  ০২ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

একজন বিচ্ছিন্নতাবাদীর মৃতদেহ যখন দাফনের জন্য সবুজ কাপড়ে মোড়ানো হয়, কাশ্মিরি নারীরা তখন সাহস এবং রক্তের বন্দনা করে গান শুরু করেন। মৃতদেহ রাখা হয় উঁচু একটি বেদির ওপর, যাতে জানাজায় আসা লোকজন তার মুখ দেখতে পায়। তরুণ-যুবকরা ভিড় সরিয়ে সামনে এগিয়ে এসে নিহতের কপালে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর তারা মৃতের পা ছুঁয়ে সেই হাত নিজেদের সারা শরীরে বোলাতে শুরু করেন। যেন ধমীর্য় আচার পালন করছেন তারা।

এ রকম প্রতিটি জানাজায় স্রোতের মতো মানুষ আসতে থাকে। ¯েøাগানে মুখর হয়ে ওঠে বাতাস। তরুণ-যুবকরা মাইক্রোফোনে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় জানাতে থাকেন।

মরদেহ ‘শহীদের কবরে’ শোয়ানোর আগ পযর্ন্ত চলছে থাকে এই মাতম।

গত এপ্রিলের এক বিকালে কাশ্মিরের শোপিয়ান জেলার ট্রেঞ্জ নামক একটি গ্রামে এ রকম এক জানাজায় হাজির ছিলেন হাল্কা-পাতলা এক বৃদ্ধা। পাকা চুল, চোখ বসে গেছে। হাতে একটি পলিথিন ব্যাগ। তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আমি আমার ছেলেকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছি।’ তার ১৯ বছরের ছেলে উবায়েদ শফি মাল্লা সেনাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। জুনা বেগম নামে ওই বৃদ্ধা বলেন, তিনি উবায়েদকে জন্ম দেননি, কিন্তু তাকে বুকের দুধ খাইয়েছিলেন।

প্লাস্টিকের চপ্পল পায়ে সাত কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে উবায়েদের জানাজায় হাজির হয়েছিলেন ওই বৃদ্ধা। নিরাপত্তা রক্ষীরা চেষ্টা করে এসব জানাজায় যেন বেশি মানুষ জড়ো না হয়। ফলে রাস্তা এড়িয়ে আপেল বাগানের ভেতর দিয়ে এসেছিলেন তিনি। গুলিতে বিকৃত মুখে চুমু দিয়ে হাতের ব্যাগ থেকে কিছু মিষ্টি নিহত তরুণের শবদেহের ওপর ছড়িয়ে দেন। এরপর বক্তৃতা দিতে শুরু করেন উপস্থিত মানুষদের লক্ষ্য করেÑ ‘তোমরা কি পুলিশ অফিসার হতে চাও?’ উত্তরে সমস্বরে সবাই চিৎকার করে উঠল, ‘না, কখনই না।’ জঙ্গি হতে চাও? মানুষজন চিৎকার করে জবাব দিল, ‘হ্যঁা চাই।’ ওই নারীর পরের আহŸান ছিল, ‘তাহলে চিৎকার করে তা বলো।’ সবাই আবারও সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো- ‘আজাদি’। অথার্ৎ স্বাধীনতা।

কাশ্মিরের তরুণ প্রজন্ম এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে এমন সংখ্যায় জড়িয়ে পড়েছে, যেটা গত ১০ বছরে দেখা যায়নি। তাদের যেসব ‘আদশর্ যোদ্ধা’ ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদের রক্ষায় জীবন বাজি ধরতে এসব কিশোর-তরুণরা তোয়াক্কা করছে না। তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়ির সামনে দঁাড়িয়ে ঢিল ছুড়ছে। বিদ্রোহীরা যখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে, তখন এসব কিশোর-তরুণ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পথ বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। সে সময় অনেকই মারা যায়। চলতি বছরই ৩০ জনের বেশি কিশোর-তরুণ এভাবে মারা গেছে।

২০১৬ সালের জুলাইতে সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর কাশ্মিরে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়। সম্প্রতি ওয়ানির বন্ধু এবং জঙ্গিনেতা সাদাম পাদের নিহত হওয়ার পর তার জানাজায়ও হাজার হাজার মানুষ যোগ দেয়।

একের পর এক এসব জানাজা থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় জড়িত হতে অনুপ্রাণিত হচ্ছে কাশ্মিরের তরুণ প্রজন্ম। তাদের অধিকাংশের বয়স ১৯৮৯ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী অন্দোলন শুরুর পর। তারা সবাই সংঘাতের সন্তান। তাদের একজন ১৭ বছরের জুবাইর আহমেদ। সাদাম পাদেরের জানাজায় জমায়েত ঠেকাতে নিরাপত্তা বাহিনী ছয়টি চেক পয়েন্ট বসিয়েছিল। সেগুলো ফঁাকি দিয়ে সে ওই জানাজায় এসেছিল। দুই বছরে এ রকম ১৬টি জানাজায় হাজির ছিল জুবাইর।

অনেক জানাজায় হাতে বন্দুক নিয়ে অনেক যোদ্ধাও হাজির হয় নিহত সতীথর্ যোদ্ধাদের গান স্যালুট দিতে। পাদেরের মা তার ছেলের জানাজায় আসা এমন একজন বিদ্রোহী যোদ্ধার কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলেন- সেও তার ছেলে। তিনি বলেন, ‘একদিন তারাই কাশ্মিরকে ভারতের বাইরে নিয়ে যাবে।’

গত বছর এ রকম এক জানাজায় একজন যোদ্ধার পাশে দঁাড়ানো তার ছবি ফেসবুকে বেরুলে, নিরাপত্তা বাহিনী জুবাইরকে গ্রেপ্তার করে। সে জানায়, এখন তার বিরুদ্ধে গাদা গাদা মামলা, ফলে তার কোনো চাকরি হবে না। সে জানায়, ‘একদিন দেখবেন আমিও একে-৪৭ হাতে নিয়ে বাতাসে গুলি ছুড়ছি।’ সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে