বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তুর্কি রোষানলের শিকার কুর্দি জনগোষ্ঠী কারা?

মধ্যপ্রাচ্যের চতুর্থ বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী তারা। কিন্তু এই কুর্দিরা কখনো স্থায়ী একটি রাষ্ট্র পায়নি। বর্তমানে তাদের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্প্রদায় রয়েছে। জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তারা একরকম হলেও তাদের ভাষার কোনো স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গি নেই...
যাযাদি ডেস্ক
  ১২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
কুর্দি সংগঠন পিকেকের কয়েকজন সশস্ত্রযোদ্ধা

কুর্দি মিলিশিয়াদের হটিয়ে 'সেইফ জোন' বা নিরাপদ অঞ্চল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তুরস্কের সেনাবাহিনী গত বুধবার থেকে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় অভিযান শুরু করেছে। সমালোচকরা আশঙ্কা করছেন, এই অভিযানের ফলে স্থানীয় কুর্দি নাগরিকরা জাতিগত সহিংসতার শিকার হতে পারে এবং এর ফলে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিগোষ্ঠীরও পুনরুত্থান ঘটতে পারে। কিন্তু এই কুর্দিরা আসলে কারা?

কুর্দিরা যেখান থেকে এলো

মেসোপটেমিয়ান সমতল ভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চলের একটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এই কুর্দিরা। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক, উত্তর-পূর্ব সিরিয়া, উত্তর ইরাক, উত্তর-পশ্চিম ইরান এবং দক্ষিণ-পশ্চিম আর্মেনিয়া অঞ্চলে তারা ছড়িয়ে রয়েছে। আড়াই থেকে সাড়ে তিন কোটি কুর্দি এসব পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে।

মধ্যপ্রাচ্যের চতুর্থ বৃহত্তম নৃতাত্বিক গোষ্ঠী তারা। কিন্তু এই কুর্দিরা কখনো স্থায়ী একটি রাষ্ট্র পায়নি। বর্তমানে তাদের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্প্রদায় রয়েছে। জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তারা একরকম হলেও তাদের ভাষার কোনো স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গি নেই। কুর্দিদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম এবং উপগোষ্ঠীর উপস্থিতি থাকলেও তাদের সিংহভাগ সুন্নি মুসলমান।

রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী কুর্দি

বিংশ শতকের শুরুর দিকে কুর্দিদের অনেকে নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করে, যেটি কুর্দিস্তান হিসেবে পরিচিত হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর যুদ্ধ জয়ী পশ্চিমা জোট ১৯২০ সালের চুক্তি অনুযায়ী, কুর্দিদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের ব্যবস্থা নেয়।

তবে তিন বছর পরই ওই সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায় যখন লুসান চুক্তি অনুসারে আধুনিক তুরস্কের সীমানা নির্ধারিত হয় এবং কুর্দিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয় না। কুর্দিরা তখন নিজ নিজ দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করতে বাধ্য হয়। পরের ৮০ বছরে নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য কুর্দিদের নেয়া প্রত্যেকটি প্রচেষ্টাকেই নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়।

তুরস্ক কুর্দিদের হুমকি মনে করে

তুরস্ক এবং সে দেশের কুর্দিদের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাসটা অনেক পুরনো। তুরস্কের জনসংখ্যার ১৫ থেকে ২০ ভাগ জাতিগতভাবে কুর্দি। কয়েক প্রজন্ম ধরে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ কুর্দিদের বিষয়ে কঠোর নীতি অনুসরণ করেছে। ১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দশকে কুর্দিদের বিক্ষোভের শুরুর সময় অনেক কুর্দি পুনর্বাসিত হয়, কুর্দি নাম এবং পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, কুর্দি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, এমনকি কুর্দিদের যে একটি আলাদা জাতিগত পরিচয় আছে, সেটিও অস্বীকার করা হয়। কুর্দিদের সে সময় বলা হতো 'পাহাড়ি তুর্কি'।

১৯৭৮ সালে আবদুলস্নাহ ওচালান পিকেকে গঠন করেন, যাদের প্রধান দাবি ছিল স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠন করা। ছয় বছর পর সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে সংগঠনটি। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং লাখ লাখ কুর্দি বাস্তুচু্যত হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে পিকেকে স্বাধীনতার দাবি বাদ দিয়ে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন চালায়। তবে সে সময়ও সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত রাখে তারা। ২০১৩ সালে গোপন আলোচনার পর যুদ্ধবিরতির সমঝোতায় আসে তারা।

সিরিয়ায় কুর্দিরা যা চায়

সিরিয়ার জনসংখ্যার সাত থেকে ১০ ভাগ কুর্দি। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে অভু্যত্থান শুরু হওয়ার আগে তাদের অধিকাংশের বাস ছিল দামেস্ক এবং আলোপ্পোতে। এছাড়াও উত্তর-পূর্বের শহর কামিশলি, কোবানে এবং আফ্রিন শহরেও তাদের কিছু অংশ বসবাস করতো।

সিরিয়ার কুর্দিরাও দীর্ঘ সময় ধরে অত্যাচারিত এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ১৯৬০-এর দশক থেকে প্রায় তিন লাখ কুর্দিকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি এবং তাদের জমি অধিগ্রহণ করে ওইসব কুর্দি অঞ্চলকে 'আরব অধু্যষিত' অঞ্চলে পরিণত করার জন্য আরবদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশারের বিরুদ্ধে হওয়া অভু্যত্থান যখন গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়, তখন প্রধান কুর্দি দলগুলো কোনো পক্ষ নেয়নি।

মার্চ ২০১৬ সালে তারা আইএসের দখলে থাকা কয়েকটি আরব এবং তুর্কি এলাকা নিয়ে 'যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ওই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে সিরিয়ার সরকার, বিরোধী দল, তুরস্ক। পিওয়াইডির দাবি, তারা স্বাধীনতা চায় না, কিন্তু সিরিয়ায় চলমান সংঘাত নিরসনের উদ্দেশে নেয়া যেকোনো রাজনৈতিক সমঝোতায় কুর্দিদের অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি যেন গুরুত্ব পায়, তা নিশ্চিত করতে চায়। প্রেসিডেন্ট বাশার আলোচনা বা যুদ্ধ, যে কোনোভাবে সিরিয়ার প্রতি 'ইঞ্চি' জায়গা পুনর্দখলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিও নাকচ করে দিয়েছে তার সরকার।

আইএসের বিরুদ্ধে মুখ্য ভূমিকায়

২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইসলামিক স্টেট গ্রম্নপ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের তিনটি কুর্দি ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। ওই অঞ্চলে তাদের চালানো একের পর এক হামলা ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কুর্দি মিলিশিয়া বাহিনীগুলো প্রতিরোধ করতে থাকে।

২০১৪ সালের জুনে উত্তর ইরাকে আইএসের আগ্রাসনের ফলে ইরাকের কুর্দিরাও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলের সরকার এমন অঞ্চলে তাদের পেশমারগা বাহিনী পাঠায়, যেখানে ইরাকি সেনাদের অবস্থান ছিল না।

২০১৪ সালে আইএস আচমকা আগ্রাসন শুরু করলে বেশ কয়েকটি অঞ্চল থেকে পেশমারগা বাহিনী সরে আসে। ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘুদের বসবাস ছিল, এমন বেশ কয়েকটি অঞ্চলের পতন হয়; যার মধ্যে একটি হলো সিঞ্জার, যেখানে হাজার হাজার ইয়াজিদিকে আইএস আটক করে রাখে এবং হত্যা করে। ওই আগ্রাসন থামাতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী উত্তর ইরাকে বিমান হামলা চালায় এবং পেশমারগাদের সাহায্য করতে সামরিক উপদেষ্টা পাঠায়।

তিন দশক ধরে তুরস্কে কুর্দি স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে লড়াই করা ওয়াইপিজি এবং পিকেকেও তাদের সহায়তায় যোগ দেয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কুর্দি শহর কোবানেতে হামলা চালায় আইএস, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ তুরস্কের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আশ্রয় নেয়।

তবে ওই সংঘাত তুরস্কের সীমান্তের অনেক কাছে হলেও তুরস্ক আইএস ঘাঁটিতে হামলা করা বা তুরস্কের কুর্দিদের সীমানা পার করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেয়া থেকে বিরত থাকে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এক যুদ্ধের পর কুর্দি বাহিনী কোবানের নিয়ন্ত্রণ পুনর্দখল করে। ওই যুদ্ধে অন্তত ১৬০০ মানুষ মারা যায়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী, সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস জোট এবং একাধিক আরব মিলিশিয়া বাহিনীকে কুর্দিরা বিভিন্নভাবে সাহায্য করে সিরিয়া থেকে আইএসকে সম্পূর্ণ বিতাড়িত করতে।

এখন উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় একটি ৩২ কিলোমিটার 'নিরাপদ অঞ্চল' (বাফার জোর) প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের সীমান্ত রক্ষা করতে এবং ২০ লাখ সিরিয়ান শরণার্থীকে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে তুরস্ক কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এসডিএফ বলছে, তারা যে কোনো মূল্যে তাদের এলাকা রক্ষা করবে। আইএসের বিরুদ্ধে কঠিন যুদ্ধে অর্জিত সুফলও ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে দাবি করছে এসডিএফ। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<70711 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1