মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বজ্রপাতে প্রাণহানি নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে

তাল, নারিকেল, বট, সুপারিসহ নানা ধরনের বড় বড় গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নেয়। ফলে বজ্রপাত হলেও মানুষ বেঁচে যেত। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গাছ কমে যাওয়াসহ কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও মুঠোফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি বজ্রপাত বাড়িয়ে দিচ্ছে!
সাধন সরকার
  ৩০ মে ২০২০, ০০:০০

বছর ঘুরে আবারও আলোচনায় বজ্রপাত। করোনার মধ্যেই বজ্রপাত মহাতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে! এ বছর এপ্রিল মাস থেকেই বজ্রপাতের তান্ডবলীলা শুরু হয়েছে। বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, এপ্রিল মাসে বজ্রপাতে ৬২ জনের মৃতু্য হয়েছে। আর চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছে ৭৯ জন। গত বছরে (২০১৯) পুরো এপ্রিল মাসে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ২১। তবে এ বছর এপ্রিল মাসেই কেন এত প্রাণহানি? সবে তো কালবৈশাখীর মৌসুম শুরু! পুরো বর্ষা মৌসুম তো এখনো বাকি। প্রাক বর্ষা মৌসুম শুরুর এ সময় থেকে কৃষক ও জেলেদের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে। বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণের কথা বললেই প্রথমেই আসবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা। তাছাড়া পরিবেশ দূষণ, বৃক্ষসম্পদ ধ্বংস, নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ তো রয়েছেই। বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার এমন অনভিপ্রেত পরিবর্তন বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টির জন্য বেশি দায়ী। মে-জুন মাসে ঝড়-বৃষ্টিসহ বজ্রপাত বেশি দেখা যায়। কেননা এ সময় বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা আর্দ্র বায়ু আর উত্তরের হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে ব্যাপক বজ্রঝড়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে মৃতু্যর মিছিল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে! গত কয়েক দশকের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, বিশ্বে বজ্রপাতের কারণে যত মানুষের মৃতু্য হয় তার চারভাগের একভাগ মানুষের মৃতু্য হয় বাংলাদেশে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই এক দশকে দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেছে ২ হাজার ৮১ জনের। বজ্রপাতে মৃতু্যর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে 'প্রাকৃতিক দুর্যোগ' হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে বজ্রপাত রোধে নেওয়া হয় বিশেষ পরিকল্পনা ও সতর্কীকরণ কর্মসূচি। কিন্তু মৃতু্যর মিছিল তাতে থামানো যায়নি! ২০১৯ সালে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ও কালবৈশাখীর তান্ডবে বজ্রপাতে প্রায় ২৫০ জনের মৃতু্য হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশে বাংলাদেশের থেকে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি হলেও সেসব দেশে মৃতু্যর সংখ্যা নগণ্য!

তাল, নারিকেল, বট, সুপারিসহ নানা ধরনের বড় বড় গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নেয়। ফলে বজ্রপাত হলেও মানুষ বেঁচে যেত। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গাছ কমে যাওয়াসহ কৃষিতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও মুঠোফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি বজ্রপাত বাড়িয়ে দিচ্ছে!

প্রশ্ন হতে পারে, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই কেন বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানোর ব্যাপারে কর্মপরিকল্পনা করা হয় না? বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মারা যায় কৃষক ও জেলে পেশায় নিয়োজিত খেটে খাওয়া গরিব মানুষ। এই দুই জনগোষ্ঠীকে বজ্রপাতের মৌসুম শুরুর আগে থেকেই যদি সচেতন করা যায় তাহলে বজ্রপাতে প্রাণহানি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই কেন কৃষক ও জেলেদের সচেতনতার ওপর জোর দেওয়া হয় না? কেননা এপ্রিল বা এর পরের সময়টাতে বজ্রপাতে মৃতু্য ঘটবে এটা তো কয়েক বছর ধরেই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে! প্রতি বছর বজ্রপাতে ব্যাপক প্রাণহানির পরই কেবল কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। কৃষক খেতে কাজ করবে, জেলে মাছ ধরবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ঝড়-বৃষ্টির ওই সময়টুকুতে কৃষক-জেলেরা যাতে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে সে ব্যাপারে যেসব এলাকায় বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে সেসব এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে তালগাছ লাগানো একটা ভালো সমাধান। তবে এটা বেশ সময়সাপেক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। প্রযুক্তিগত সহায়তার কথা এক্ষেত্রে ভাবা যেতে পারে। গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রযুক্তির কথা আলোচনা হচ্ছে। এর একটি হলো- বজ্রপাত অঞ্চলে মুঠোফোনের টাওয়ারে লাইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে ঝুঁকি কমানোর বিষয়টি। বলা হচ্ছে, হাওর-বাঁওড় এলাকার ফসলের মাঠে নির্দিষ্ট দূরত্বের পরপর এই যন্ত্র বসালে বজ্রপাত হওয়ার আগে তথ্য পাওয়ার মাধ্যমে বজ্রপাতে মৃতু্যহার অনেক কমে আসবে। কোথায় কখন বজ্রপাত হতে পারে, ওই প্রযুক্তির সাহায্যে ৪০ মিনিট আগেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় মুঠোফোনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানা সম্ভব! ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিনির্ভর এই 'লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর' কাজে লাগাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এই প্রযুক্তির সহায়তা নিতে মার্কিন সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে। যদিও এই প্রযুক্তিতে ব্যয় একটু বেশি! বজ্রপাত যেহেতু প্রাকৃতিক এটা হবেই, তবে কম অথবা বেশি। বজ্রপাত রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণই বজ্রপাতে মৃতু্যর সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে। আবার শহরে ও গ্রামে বিল্ডিংয়ে বজ্রনিরোধক দন্ড বা বিভিন্ন স্থানে ধাতব টাওয়ার বসানোর মাধ্যমেও বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানো সম্ভব। এক কথায়, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিলে ব্যাপক প্রাণহানি রোধ করা সম্ভব- ১. যেসব এলাকায় বেশি প্রাণহানি হয় সেসব এলাকায় ব্যাপক পরিসরে কৃষক ও জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ২. তালগাছ রোপণ কার্যক্রমে ব্যাপক গুরুত্ব দিতে হবে। ৩. ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও প্রযুক্তিগত সহায়তা কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণসহ আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।

\হ

সাধন সরকার: পরিবেশকর্মী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<100595 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1