শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

মনে থাকবে কি সুন্দরবনের কথা?

নতুনধারা
  ৩১ মে ২০২০, ০০:০০

সুন্দরবন, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশের জন্য সুন্দরবনকে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদই বলা চলে। কোনো কিছুর বিনিময়েই যার কোনো ক্ষতি করা যায় না। যুগযুগ ধরে ভয়ঙ্কর, প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় থেকে এ দেশ ও জাতিকে রক্ষা করেছে এই সুন্দরবন। পরম এ বন্ধুটি আমাদের দেশের জন্য বারবার এনে দিয়েছে গৌরব ও সম্মান, দিয়েছে সুরক্ষা। বিশ্বের ইতিহাসে যতসব ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে। 'ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড' নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের ৩৫টি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে। এই তালিকার ২৬টি ঘূর্ণিঝড়ই বঙ্গোপসাগরে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান এ ধররের ২৭তম ঘূর্ণিঝড়। ভয়ঙ্কর এই ঘূর্ণিঝড় আবারও আমাদের বন্ধুটির কথা স্মরণ করিয়ে দিল। আশায় বুক বেঁধে ছিলাম, বন্ধুটি ঠিকই আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে।

সাম্প্রতিককালের ঘূর্ণিঝড় ফণীতে প্রাণহানি অতীতের তুলনায় সীমিত ছিল। এর প্রধান কারণ সুন্দরবন। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের পক্ষেও সুন্দরবনের 'প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর' ভেদ করা সহজতর হয়ে ওঠে না। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের সময়েও সুন্দরবন পয়েন্টে এসে এর গতি লক্ষণীয় হারে কমে গিয়েছিল। আরেকটু পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, ২০০৭ সালে সিডরে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি; অন্যদিকে ২০০৯ সালের আইলায় এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩৫০-র কম। অথচ দুটি ঘূর্ণিঝড়েরই মাত্রা ছিল সমপর্যায়ের। তাহলে এত ভয়ের প্রাণহানি সংখ্যার এ বিশাল পার্থক্যের কারণ কী? এর উত্তর কেবলই একটি- সুন্দরবন। সিডর আঘাত হেনেছিল দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, যেখানে সুন্দরবন নেই। আর আইলা আঘাত হেনেছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে, যেখানে ব্যারিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল সুন্দরবন। এ জন্যই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বা ভোলা-নোয়াখালী-চট্টগ্রাম উপকূলে যদি সুন্দরবনের মতো আরেকটি 'প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর' থাকত, তাহলে ১৯৯১ সালে ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মূল্যবান প্রাণ হয়তো হারাতে হতো না। ভোলায় যদি সুন্দরবনের মতো সবুজ সুরক্ষা থাকত, তাহলে ১৯৭০ সালে স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে পাঁচ লাখ প্রাণ হয়তো ভেসে যেত না জলোচ্ছ্বাসে। এতেই সুস্পষ্ট হয় অন্ধকার ঘনকালো বিপদ থেকে রক্ষায় সুন্দরবন আমাদের কতটা প্রয়োজনীয়। এজন্য ঘূর্ণিঝড় এলেই আমাদের সুন্দরবনের কথা মনে পড়ে। আমরা সুন্দরবনের দিকে তাকিয়ে থাকি। বন্ধুবর সুন্দরবন আমাদের বরাবরের মতোই বাঁচিয়ে দেয়। অতঃপর কদিন বাদে আমরাই আমাদের এই বন্ধুর মাথায় বন্দুক ঠেকাই। আচ্ছা, যে সুন্দরবন আমাদের রক্ষাকবচ, সে সুন্দরবন আজ কেমন আছে? যে বন্ধুটি নিজের বুক ক্ষতবিক্ষত করে হলেও আমাদের সুরক্ষিত রাখে, সে বন্ধুটির প্রতি আমরা কতটা কৃতজ্ঞ? কৃতজ্ঞ থাকলে তবে 'সুন্দরবন বাঁচাও' আন্দোলন কেন করতে হয়? আমাদের একের পর এক যেসব ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন, এর প্রত্যেকটিই ছিল সুন্দরবনের জন্য ভয়ঙ্কর রকমের হুমকি।

কেবল ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতেই এর ৪০ শতাংশ গাছপালা ও জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়ে যায়। আশার বিষয় হচ্ছে, সুন্দরবন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিপরীতে নিজেই নিজের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। কিন্তু মারাত্মক হতাশার বিষয় হচ্ছে- আমরা মনুষ্যজাতিই আজ সুন্দরবন ধ্বংসের কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছি। সুন্দরবনে ঘুরতে আসা পর্যটকদের যত্রতত্র ফেলে দেওয়া খাবারের প্যাকেট ও পানির বোতলসহ নানা রকম পস্নাস্টিক বর্জ্য হুমকিতে ফেলছে বনের পশু-পাখি ও প্রাণীদের।

জোয়ারের পানিতে মিশে খাবারের প্যাকেট ও পানির বোতলসহ নানা রকম পস্নাস্টিক বর্জ্য বনের মধ্যে প্রবেশ করে গাছপালার শ্বাসমূলে আটকে যায়। এর ফলে গাছপালা মারা যাচ্ছে। বনে থাকা পশু-পাখি পস্নাস্টিকের প্যাকেট খেয়ে ফেলায় তারাও মারা যাচ্ছে।

অন্যদিকে এক মহাদুর্যোগ হিসেবে সুন্দরবনের সামনে হাজির হয়েছে বাংলাদেশের উজানে দেওয়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে মিঠাপানি কমে গিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া। সুন্দরবন অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ার আরেকটি কারণ, জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েই চলেছে। লবণাক্ততার ক্রমাগত এ আগ্রাসনে মরতে বসেছে সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের অন্যতম সম্পদ সুন্দরী গাছ। এভাবে চলতে থাকলে খুব বেশিদিন লাগবে না এই সুন্দরবন অস্তিত্বহীন হয়ে কেবলই ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে।

এতসবের মধ্যেই মরার উপর খাঁড়ার ঘা 'রামপাল বিদু্যৎকেন্দ্র।' রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনের পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব কিংবা বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনবে না- সরকারের এই আশ্বাসের বিপরীতে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর প্রভাবের আশঙ্কা পরিবেশবিদদের। এ শঙ্কায়, এপার বাংলা ওপার বাংলা- দুই বাংলাতেই হয়েছে 'বাঁচাও সুন্দরবন' সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এমন অবস্থায় আজ সময় হয়েছে নতুন করে ভাবার। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যখন আজ এ বনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে, তখনই মাস্টারপস্ন্যান করে এ বনের সুরক্ষার পরিবর্তে আমরা পাচার করছি এখানকার গাছ ও প্রাকৃতিক সম্পদ। অদূর ভবিষ্যতে এই অকৃতঘ্ন আচরণের ধাক্কা নেওয়ার সক্ষমতা আদৌ কি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের? ভাবার বিষয়। যে সুন্দরবন বাঁচায় আমাদের, সে সুন্দরবনকেও আমাদেরই বাঁচাতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন, বিপদ কেটে গেলে মনে থাকবে কি সুন্দরবনের কথা? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শেষ করব। ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে তিনি বলেছিলেন- 'আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে এইটা হলো ব্যারিয়ার। এটা যদি রক্ষা না হয় তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিলস্নার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ এ পর্যন্ত সমস্ত এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায়- তো সমুদ্র যে ভাঙনের সৃষ্টি করবে সেই ভাঙন থেকে রক্ষার উপায় আর নাই।'

আরাফাত হোসেন ভূঁইয়া

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<100703 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1