বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেধা পরিমাপের মানদন্ড হতে পারে না

নতুনধারা
  ৩১ মে ২০২০, ০০:০০

মেধা বিকাশের সর্বোচ্চ স্তর হলো বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষিত করানোর জন্য উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু। বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাস। বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, এই তিন ক্যাটাগরিতে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে যেমন নিজস্বতা, তেমনি রয়েছে একে অন্যের ভিন্নতা। ভিন্নতার কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সবসময় অধিক গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়। চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার লক্ষণীয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কঠিন ভর্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ মেধাবীদের বাছাই করা হয়ে থাকে। যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় না, তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, ধনী পরিবারের সন্তানরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তুলনামূলক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবৃত্ত ঘরের সন্তানরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এটি অনেকাংশেই ভুল ধারণা। সবাইকে তো আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো সম্ভব নয়। এসব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা নিয়ে বৈষম্যতা দেখা দেয় ও বাকবিতন্ডা চলে। আজকাল শিক্ষার্থীদের এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বেশ তর্ক-বিতর্ক করতে দেখা যায়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রম্নপ ও পেজে স্ট্যাটাস ও কমেন্টের মাধ্যমে কাদা ছোড়াছুড়ি চলে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দাবি করে, তারা সবচেয়ে মেধাবী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তারা শিক্ষার্থী মনে করে না এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুচোখে দেখতে পারে না। শুধু তাই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে। সরকারি-বেসরকারি-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেধার পরিমাপ নিয়ে প্রায়ই বেশ দ্বন্দ্ব চলে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানেই সেখানে মেধাবীরা পড়ে আর বেসরকারি কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মানে সেখানে কম মেধাবীরা পড়ে, বিষয়টা কিন্তু মোটেও তেমন নয়। শিক্ষার্থীরা জেনে ও বুঝে তর্ক করে। যা মোটেও সমীচীন নয়। এ প্রসঙ্গে আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই।

দেশে বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪২টি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। সবাই ভর্তি পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তারপরও দেখা যায়, অসংখ্য শিক্ষার্থী আছে, যাদের মাথায় গোবর ছাড়া কিছু নেই। ভাজা মাছটা উল্টিয়ে খেতে পারে না। অথচ ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়েছে। হয় কপালের জোরে পেয়েছে, নয়তো দুর্নীতি করে ঢুকেছে। পাস করে বেরও হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বা পড়েছে বলেই তাকে কি আমরা প্রকৃত মেধাবী বলতে পারি? আবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী আছে, যাদের কথা সবাই জানে। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে মেধা তালিকায় স্থান পায়। তাদের প্রকৃত মেধাবী বলা যেতে পারে। বছর বছর ভালো ফলাফল করে। স্নাতক শেষে গোল্ড মেডেলিস্ট হয়। বিসিএস ক্যাডারে নির্বাচিত হয়ে সরকারের উচ্চপদে চাকরি করে। কেউ কেউ বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমায়, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে। এসব উচ্চতর লেখাপড়ায় মেধা যেমন লাগে, তেমনি লাগে পারিবারিক সচ্ছলতা। যেসব শিক্ষার্থী কঠোর পরিশ্রম করে প্রকৃত মেধাকে উপস্থাপন করতে পারে, তাদের নিয়ে সবাই গর্ব করে। তারা আমাদের জন্য অহংকার।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়াশোনা করে? যারা কম মেধাবী, তারা? মোটেও সত্য নয়। যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে টিকতে পারেনি, কোনো কারণে যাদের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল খারাপ হয়েছে, তারা। তাই বলে তাদের আমরা কটাক্ষ করতে পারি না। এটা সত্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী আছে, যারা সীমিত জ্ঞান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে। ২৪ ঘণ্টা শিক্ষকের দেওয়া লেকচার শিট পড়ে, অতঃপর মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে ঢেলে দেয়। স্নাতক শেষে সিজিপিএ ৪ পায়। আদৌ তারা কিছু জানে কিনা সন্দেহ আছে। এ দলের বেশির ভাগ ধনী ঘরের আদুরে সন্তান হয়ে থাকে। যাদের অধিকাংশরই বিকল্প কিছু ভাবার সক্ষমতা নেই। বন্ধুরা দুষ্টুমি করে 'বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী' বা 'রোবট' বলে ডাকে, যদিও ঠিক নয়। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী আছে, যারা শুধু পড়াশোনা করে না, অতিরিক্ত নানান কিছু করে বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজের সুনাম বয়ে আনে। এরা বিভিন্ন সংগঠন করে, সামাজিক কাজ করে। আবার ভালো ফলাফলও করে। স্নাতক শেষে ভালো চাকরিও করে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশেও পাড়ি জমায়। বড় বড় ব্যবসায়িক হয়ে ওঠে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিস্তৃত পরিসরে বাংলাদেশে চালু আছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পায়। শহরমুখী হতে হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও অসংখ্য শিক্ষার্থী আছে, যারা স্নাতকেও প্রাইভেট পড়ে। নার্সারির বাচ্চাদের মতো আচরণ করে। হাবাগোবা টাইপের। শহর-নগর চেনে না। অনেকে ভালো আচরণও জানে না। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী আছে, যারা নিয়মিত পড়াশোনা করে, ভালো ফলাফল করে। পাশাপাশি পার্টাইম চাকরিও করে। টিউশনি করায় কেউ কেউ। সরকারি চাকরিতে সহজে টিকে যায়। এমনও আছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে বিসিএসে প্রথম হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মেধাবী হয়, এসবই তার প্রমাণ। তাহলে তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে আলোকপাত করে বোঝা যাচ্ছে, ভেরিয়েশন বা ভিন্নতা সব জায়গায় আছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান কখনো কোনো দায় বা ক্রেডিট সরাসরি বহন করে না। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেধা পরিমাপের মানদন্ড হতে পারে না। শিক্ষার্থীরা কে কেমন হবে, কত ভালো না মন্দ হবে, সেটি তার মেধাচর্চার ব্যাপার। যে বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক না কেন কেউ যদি ভালো করে পড়াশোনা করে, তবে সে ভালো ফলাফল করবে, নিশ্চিতরূপে বলা যায়। আদৌ পড়াশোনা না করলে ভালো ফলাফল কখনো কি সম্ভব?

অতএব, শিক্ষার্থীদের বলতে চাই, অহেতুক এসব বিষয় নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ির কোনো দরকার নেই। নিজে কেমন, তা যাচাই সবার আগে করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সফলতা সবার, ব্যর্থতা একার। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও যদি কাঙ্ক্ষিত চাকরি জোটাতে না পারা যায়, এ দায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, এ দায় শিক্ষার্থীর নিজের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সরকারি উচ্চপদে চাকরি করার সফলতা শুধু শিক্ষার্থীর নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার এবং সবার। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনো এককভাবে বাধা কিংবা সাফল্যের কারণ হতে পারে না। কার মেধা কতটুকু, এসব বিষয় পরিমাপের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের ওপর বর্তায় না। পড়াশোনা করে জীবন-জীবিকার জন্য একটি যথোপযুক্ত চাকরি জোগাড় করতে পারা, বেকারত্ব দূর করতে পারা এবং একজন ভালো মানুষ হতে পারাই প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। যে বা যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে মাপকাঠি বানিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধাবী পরিমাপ করে, তাদের কাছে প্রশ্ন- তারা সত্যই কি মেধাবী?

মোহাম্মদ অংকন

তরুণ লেখক, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<100705 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1