শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস: এক অদৃশ্য আততায়ী

এই ভাইরাসটি অদৃশ্য। এর সংক্রমণের কয়েকটি লক্ষণ সবার জানা থাকলেও ওই ধরনের কোনো লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও করোনা সংক্রমণ ঘটে এবং ঘটছে। তাই বহুক্ষেত্রে আবার মৃতু্যর পর পরীক্ষা করে জানা যায়, রোগী করোনা আক্রান্ত। তাই এ শত্রম্ন অদৃশ্য, ভয়াবহ ও মারাত্মক। ছোঁয়াচে হওয়ায় এই রোগীকে হতে হয় মারাত্মক অসহায়ত্বের শিকার। স্বামীকে স্ত্রী, স্ত্রীকে স্বামী, সন্তানকে তাদের মা-বাবা, বাবা-মাকে তাদের সন্তান ও রোগী হলে ছোঁয়া দূরের কথা- সে ঘরেই যাওয়া, রোগীর কোনো জিনিসপত্রে হাত দেওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ হওয়ায় যে মর্মান্তিক পরিবেশ সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোতে রচিত হয় তা সহজেই অনুমেয়।
রণেশ মৈত্র
  ০৯ জুলাই ২০২০, ০০:০০

পাবনা শহরে যে বাসায় আমরা বাস করি সেই বাসায় আরও একটি ফ্যামিলি বাস করেন। সেই ফ্যামিলির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির আয়ের উৎস ছিল একটি পথি পার্শ্বস্থ ছোট্ট রেস্তোরাঁর চাকরি। করোনার ধাক্কায় ২৬ মার্চ থেকে (যেদিন থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি এবং দোকান-পাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য-বিপণি, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সব কিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ ঘোষণা করেন মালিক আরও অসংখ্য দোকান মালিকের মতো। ফলে ব্যক্তিটির বেতন বন্ধ থাকে। এর ওপর তার শারীরিক কিছু সমস্যা দেখা দিলে বাসার সবারই করোনা টেস্ট করে আমাদের সবারই নেগেটিভ হলেও তার পজিটিভ রিপোর্ট আসে।

এর ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ এই নিবন্ধ লেখাতক তিনি হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন আছেন। যেদিন তাকে ভর্তি করা হলো সেদিনই অকস্মাৎ পুলিশ এসে পুরা বাড়িটি 'লকডাউন' করে দিয়ে যায়। তাতে অবশ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোনো হেরফের হয়নি। কারণ আমরা ওই মার্চ থেকেই আজতক গৃহবন্দি হয়ে রয়েছি। আদৌ বাইরে বেরুই না। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, চোখে-মুখে হাত না দেওয়া, বাড়ি-ঘর জীবাণুমুক্ত রাখা- এ সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। .

লকডাউন করার পর ১৪ দিন অতিবাহিত হওয়ায় সিভিল সার্জনের মত অনুসারে আজই আনলক করে দেওয়া হবে। বেশ সুখবর। রোগী মোটামুটি ভালোই আছেন হাসপাতালে। রবি সাহা নামক রোগীটির অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে- এটা আর একটি সুখবর। তার করোনা স্যাম্পল ৫-৬ দিন আগে আবার নিয়ে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এখনো না আসায় রবি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাচ্ছে না। আশা করি রবি অন্য একজন করোনাজয়ী হয়ে ফিরবেন।

কিন্তু এই আনন্দের খবর তো নেহাতই পাবনার দুটি মাত্র পরিবারের। কয়েক শো রোগী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন পাবনা জেলায়- সারা দেশে এক লাখ ৭২ হাজার। আর মারা গেছে দুই হাজার ১৯৭ জন।

অনুমান করি, কম-বেশি সংক্রমিত সব রোগীর পরিবারই এভাবে আটকে আছে। এর অর্থ দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের নানা স্থানে এক স্থবির জীবনযাত্রার শিকার হয়ে আটকা আছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কায় আরও অগণিত পরিবার এভাবে স্থবির জীবনযাত্রার অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

আবার মৃতু্যর মিছিলও চলছে। রোগীর মৃতু্য ঘটেছে, যেহেতু তাদের স্যাম্পল নিয়ে টেস্ট করা হয়নি তাই তারা মৃতু্যর সরকারি তালিকায় স্থান পাননি।

ফলে দেশের প্রতিটি পরিবারে গভীর আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং তা আরও গভীরতর হয়ে উঠছে দিন দিন। সর্বাধিক বেদনার্ত হয় যখন প্রায় প্রতিদিনই একজন করে অতি আপনজন করোনার আঘাতে হারিয়ে যাওয়ার খবর আসে তখন ছুটে গিয়ে তাদের কাউকেই শেষ দেখাটা দেখতে যাওয়া যায় না। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপার তো আছেই, তার ওপরও রয়েছে যেন জীবনের ভয়, যে ভয় রাষ্ট্রশক্তিকেও পায়নি বাঙালি জাতি।

তবে কি আবারও এক ধরনের পদধ্বনি? মিলবে না কিন্তু চেতনে-অবচেতনে কখনো কখনো তেমনটাই যেন মনে হয়। পেছনে ফিরে একাত্তরের দিনগুলোর কথা ভাবলে দেখা যায় সামগ্রিক স্বার্থকে বড় বলে ভাবলেও শত্রম্ন আসার খবর পেলে অনেকে কাউকে না বলেই অজানা গন্তব্যে চলে যেতেন যেন এই গৃহত্যাগের খবরটি কেউ জানতে না পারে।

আবার শত্রম্নর আক্রমণে কারও বাড়ি-ঘর আগুনে পুড়লে, লুট-পাট হলে, নারী অপহৃত বা ধর্ষিত হলে বা হত্যাযজ্ঞ ঘটে গেলে ওই বাড়ির মানুষ যতই আপন হোন না কেন- অনেকেই হয়তো ছুটে যাওয়ার সাহস পাওয়া পেত না। এ রকম আরও অনেক কথা বলা যাবে যা একাত্তর পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে প্রকাশিত গল্প, কবিতা, উপন্যাসে আমাদের সাহিত্যিক ও কবিসমাজ সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন। যদি একতরফাভাবে ভীতিগ্রস্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা আদৌ না ভেবে লুকিয়ে তাকাই একমাত্র চিত্র একাত্তরে ছিল এবং ছিল অনেক বিপরীত ঘটনাও। সেগুলো বীরত্বের কাহিনী হিসেবে সাহিত্যে বিধৃত হয়েছে। এই দ্বান্দ্বিক ছবি একইভাবে আজ আমাদের সমাজে দৃশ্যমান?

তা আদৌ নয়। সবকিছুই তো ভিন্ন ধরনের। সেদিন আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম একটি শত্রম্ন রাষ্ট্র দ্বারা। ওই রাষ্ট্রের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বের দুই ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র। তাদের লড়াই ছিল ধর্ম বাঁচানোর নামে বাঙালি নিধন। তারা বেশকিছু বাঙালি চাটুকারও গড়ে তুলেছিল নানা অঞ্চলে। তাদেরও অস্ত্র সজ্জিত করা হয়। তারা পথ চিনিয়ে দিত মুক্তিকামী বাঙালির বাড়ি-ঘর। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাক সেনাদের উপহার দিয়ে আসতো তাদের যৌন লালসা মেটানোর উদ্দেশ্যে। ইসলাম রক্ষার নামে বা খাঁটি মুসলমান পয়দা করানোর লক্ষ্যে, গ্রাম-শহরে হাজার হাজার নারী-পুরুষকে কোনো মাঠে বা নদীতীরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করত পাক-সেনারা। এভাবে তাদের স্পষ্টভাবে চেনা যেত যে তারা বাঙালির শত্রম্ন এবং বাঙালিরাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং শেষ পর্যন্ত সাফল্য ছিনিয়ে আনতে দ্বিধা করেননি।

তাই একাত্তরের শত্রম্নদের চিনতে কারও সময় লাগেনি আদৌ। কিন্তু আজকের শত্রম্ন তো শুধু বাংলাদেশের শত্রম্ন নয়- বৈশ্বিক শত্রম্ন নয়, গোটা বিশ্বকে বিশ্বের সাদা-কালো, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ধনী, নিধন অর্থাৎ দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর, যুবক, প্রবীর, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে করোনাভাইরাস নির্দ্বিধায় সংক্রমণ করে চলেছে। সারা বিশ্বে প্রায় প্রতিটি পরিবারে রোগী মৃত-এক আহাজারি।

হাসপাতালগুলো ভর্তি ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বল্পতা। নেই কিট, নেই টেস্ট করার ল্যাব বা অন্যান্য বিজ্ঞানসম্মত কারিগরি ব্যবস্থা। অক্সিজেন, আইসিইউ প্রভৃতিরও নিদারুণ সংকট। অর্ধেকের বেশি রোগীর বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

এই ভাইরাসটি অদৃশ্য। এর সংক্রমণের কয়েকটি লক্ষণ সবার জানা থাকলেও ওই ধরনের কোনো লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও করোনা সংক্রমণ ঘটে এবং ঘটছে। তাই বহুক্ষেত্রে আবার মৃতু্যর পরে পরীক্ষা করে জানা যায়, রোগী করোনা আক্রান্ত। তাই এ শত্রম্ন অদৃশ্য, ভয়াবহ ও মারাত্মক। ছোঁয়াচে হওয়ায় এই রোগীকে হতে হয় মারাত্মক অসহায়ত্বের শিকার। স্বামীকে স্ত্রী, স্ত্রীকে স্বামী, সন্তানকে তাদের মা-বাবা, বাবা-মাকে তাদের সন্তান ও রোগী হলে ছুঁতে দূরের কথা- সে ঘরেই যাওয়া, রোগীর কোনো জিনিসপত্রে হাত দেওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ হওয়ায় যে মর্মান্তিক পরিবেশ সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোতে রচিত হয় তা সহজেই অনুমেয়।

একাত্তরের শত্রম্নকে চিহ্নিত করা যেত, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা যেত, সশস্ত্র যুদ্ধ করা যেত কারণ ওই শত্রম্নরাই প্রথম অস্ত্র হাতে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত বাঙালি জাতিকে আক্রমণ করেছিল।

সে আক্রমণ প্রতিরোধ করা গেল ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে। ভিয়েতনামিরা জিতেছেন বছরের পর বছর ধরে মূলত গেরিলা যুদ্ধে অজস্র প্রাণের বিনিময়ে। এসব জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ছিল পরিচিত দেশি-বিদেশি শত্রম্নর বিরুদ্ধে। একের সঙ্গে অন্যের নৈকট্য, সামাজিক ঐক্য ও পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতাই সেদিনের সাফল্যের মূলে। এতে বাঙালি সেদিন শুধু ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাই নয়- ওই ঘোর দুর্দিনের মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতি ও মমত্ববোধকে উজ্জীবিত করেছিল।

আর আজ? নৈকট্য নয়, দূরত্ব। ঐক্যবদ্ধ নয়, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাই হলো সাফল্যের মাপকাঠি। এই নৈকট্যহীনতা, এই পারস্পরিক ব্যবধান- তাও আবার অনির্দিষ্টকাল ধরে মানুষকে সহ্য করার ক্ষমতা হারাতে উচ্ছৃংখল হতে, নিয়ম-কানুন না মানতে যেন সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে, প্রতি দেশে। এতে কি শত-সহস্র বছর ধরে গড়ে তোলা সভ্যতা-সংস্কৃতি মানুষ বিস্মৃত হবে? নতুন অন্য একটা গড়ে উঠবে? প্রশ্নটা মনকে আলোড়িত করে। করে আরও এ কারণে সাবধানতা মানা, না-মানা উভয় ধরনের মানুষই সংক্রমিত হচ্ছে এবং মৃতু্যর শীতল গহ্বরে ঢলে পড়ছেন- আত্মীয়-বন্ধু ও স্বজনদের নিষেধ করা হচ্ছে হাসপাতালে রোগীতে বা তার মৃতু্যর পরে মৃতদেহকে চোখের দেখাটুকু দেখতেও। এমনই অস্বাভাবিক ব্যাপার, দূরদেশে বা দূরবর্তী কোনো শহরে বা গ্রামে নিকটজনরা কেউ কেউ দেখতে আসতে চানও- তার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে না মৃতদেহ সৎকার। কদাপি কেউই আমরা এমন ভয়াবহ এবং অজানা এক অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হইনি।

কোনোক্রমেই কমে আসছে না করোনায় সংক্রমিতদের সংখ্যা বা ছোট হয়ে আসছে না বরং প্রতিদিনই বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়ে উঠছে শবের মিছিল। এ ভয়াবহ একাত্তরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এবং আহ্বান জানাচ্ছে একাত্তরের মতো জাতীয় ঐক্য নয়- নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক ঐক্য এই ভাইরাসকে ধীরে ধীরে পরাজিত করতে। মানুষ তা অবশ্যই করতে পারবে- হতে পারবে সফলও বিজ্ঞানের জয়যাত্রার এই যুগে। তবে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে নিয়ম মানতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে, একজন থেকে অন্যজনের ছোঁয়া এড়িয়ে চলতে ঠিক ততদিন পর্যন্ত যতদিন না বিজয় অর্জিত হয়।

রণেশ মৈত্র: সাংবাদিক, রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105226 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1