মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি আছে তো?

বিএনপি কখনোই আওয়ামী লীগের পায়ের নিচে মাটি দেখে না। কিন্তু বিএনপির দুর্বলতাই যে আওয়ামী লীগের একটি অন্যতম শক্তি সেটা বিএনপি বুঝতে পারে না। বিএনপি যতক্ষণ পর্যন্ত একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হয়ে না উঠবে, ততক্ষণ দেশে যেমন গণতন্ত্রের সংকট দূর হবে না, তেমনি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনও গড়ে উঠবে না। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললে সেটা ফাঁকা আওয়াজের মতোই শোনাবে।
বিভুরঞ্জন সরকার
  ১০ জুলাই ২০২০, ০০:০০

দেশে যে বিএনপি নামের একটি বড় রাজনৈতিক দল আছে, এই দলটি যে এক সময় দাপটের সঙ্গে দেশ শাসন করেছে, এই দলটি যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর জন্য একাধিকবার চরম সহিংস আন্দোলন করেছে, তা কি এখন দেশের মানুষ বুঝতে পারছে? করোনার আগে তবু বিএনপির অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য অন্তত একজন আবাসিক নেতাকে পাওয়া যেত, তিনি রুহুল কবির রিজভী। তিনি দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী। থাকতেন নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সকাল হলে তিনি প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিং করতেন। সরকারের বিরুদ্ধে তার অভিযোগের শেষ নেই। কত যে কথা তিনি বলতেন! এত বলে যান, তবু না ফুরায়, কথা তো হয় না শেষ।

মানুষ রিজভী সাহেবের কথা শুনে বুঝতো বিএনপি নামের দলটি আছে। রিজভী সাহেব আন্দোলনের হুমকি দিতেন। বলতেন, সরকারের দিন শেষ। আওয়ামী দুঃশাসন বিদায় নিয়ে বিএনপির সুশাসন ওই এলো বলে।

না, দিন যায়, আওয়ামী লীগের শাসন শেষ হয় না। বিএনপিরও আর ক্ষমতায় আসা হয় না। এরমধ্যে এসে গেল করোনাভাইরাস। বছরের পর বছর একঘেয়ে কথার ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত রিজভী সাহেব নিজেও বুঝি মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। করোনা তাকে প্রেস ব্রিফিংয়ের রুটিন কাজ থেকে রেহাই দিয়েছে।

রিজভী সাহেব হয়তো স্বস্তিতে আছেন, কিন্তু বিএনপি যে হারিয়ে গেল। আচ্ছা, কেমন আছেন রিজভী সাহেব? যে সাংবাদিকরা নিত্যদিন তার বক্তব্য প্রচারের জন্য হাজিরা দিতেন, তারাও কি বিএনপির এই মিডিয়াবান্ধব নেতার কোনো খবর রাখেন? এক সময় তার সব ছিল। টিভি ক্যামেরা, বুম। করোনা তাকে নিঃস্ব করে ছেড়েছে।

বিএনপির খবরাখবর দেওয়ার দায়িত্ব বর্তেছে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর। এই ভদ্রলোক পড়েছেন মহাবিপদে। বিএনপির মালিকদের (বিএনপির মালিকানা খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের আধাআধি বলে মনে করা হয়।) মন রক্ষা করে মহাসচিবগিরি করার মজা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। একবার ম্যাডামের মন জুগিয়ে এক কথা বলেন, আবার তারেক রহমানের মন জুগিয়ে ভিন্ন কথাও বলতে হয়। বেচারা ভদ্রলোক মানুষ। তাকে কী বেইজ্জতিটাই না করা হচ্ছে। আকালের দিনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও তারেকের ঘূর্ণিচালে শপথ নিতে পারলেন না। এক দলে দুই নীতি। মহাসচিব সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে পারবেন না কিন্তু অন্যরা পারবেন! কতই রঙ্গ দেখবি বল- বিএনপির রাজনীতির জাদুর বাক্সে!

মির্জা ফখরুল ইসলাম সংসদে গেলে খালেদা-তারেক গুরুত্বহীন হওয়ার আশঙ্কা থেকেই কি মির্জা সাহেবকে সংসদের বাইরে রাখা হয়েছে? হতে পারে। খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে, শারীরিকভাবে অসমর্থ, তারপর দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত হয়ে জেলে। আর তারেক রহমান লন্ডন প্রবাসী। আইনের ভাষায় 'পলাতক'। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তারেকের দেশে ফেরার আশা নেই বললেই চলে। বিএনপি নিয়ে তাই অতি আশাবাদীরাও স্বপ্ন দেখতে ভয় পান।

তারপরও বিএনপিতে দ্বন্দ্ব-বিরোধের শেষ নেই। শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূল নেতাও কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে বিএনপি আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে বলে অনেকে আশা করেছিলেন। তিনি জামিন পেলেন। বাসায় ফিরলেন। বিশ্রামে গেলেন। তার সঙ্গে পুরো বিএনপিই চলে গেল বিশ্রামে। বিএনপিকে এখন জাগিয়ে তোলে এমন সাধ্য কার?

মহাসচিব হিসেবে একেবার কড়া আইসোলেশনে যেতে পারেন না মির্জা ফখরুল। তাহলে তাকে ভীরু বলা হতে পারে। তাই নিয়মিত বিরতিতে তিনি অনলাইনে কিছু কথাবার্তা বলছেন। মানুষ সচকিত হচ্ছে। না, না ওই তো বিএনপি আছে! ওই তো বিএনপির বিশ্বস্ত এক স্তম্ভ মির্জা ফখরুলের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়!

৬ জুলাই মির্জা ফখরুল বলেছেন, সরকারের অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়েছে।

এ তো সেই 'যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন, কেষ্টা বেটাই চোর'-এর অবস্থা! সরকারের ব্যর্থতা ছাড়া করোনা সারা দেশে ছড়াতেই পারত না। থাকত এখন বিএনপি ক্ষমতায় দেখতেন, কীভাবে করোনাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে! বিএনপির আমলে আর যে সমস্যাই থাকুক, করোনা তো ছিল না।

বিএনপির মতো এত পপুলার একটি দল সরকারের এই চরম ব্যর্থতার মুখেও এমন নীরব আছে কেন? কেন তারা আন্দোলনের অগ্নিমশাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না? কেন এই ব্যর্থ সরকারের গদিতে ২০ দলীয় মিত্রদের নিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছে না। তারা আগুন জ্বালালে তার উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো।

বিএনপি সমর্থকরা বলবেন, আরে ভাই, সরকার কি দেশে আন্দোলনের অবস্থা রেখেছে। রাস্তায় নামলেই তো হামলা-মামলা! এটাও ঠিক। সরকার বিরোধী দলকে একেবারেই আন্দোলন করার সুযোগ দিচ্ছে না। 'এসো এসো এসো আমারও ঘরে' বলে বিএনপিকে আন্দোলনে নামার জন্য স্বাগত জানাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের মতো অগণতান্ত্রিক দল আর হয় না!

কথাটি কি ঠিক? পৃথিবীর কোন দেশের, কোন সরকার বিরোধী দলের সরকারবিরোধী কার্যক্রমে বাধা দেয় না? চীন-রাশিয়ার কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল, আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারতের মতো দেশে সরকারবিরোধিতা করতে গেলে কি পুলিশ লাঠি-পেটা করে না? বলবেন, ওসব দেশে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া হয় না। হয়তো ঠিক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি কি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করেনি? বিএনপি সন্ত্রাস-সহিংসতার পথ ধরাতেই না সরকারও গরম নীতি অনুসরণ করা শুরু করেছে। বিএনপির কোন সমাবেশ বা মিছিল শান্তিপূর্ণ হবে আর কোনটিতে বোমা ফুটবে- সেটা সরকার বা পুলিশ আগে থেকে বুঝবে কীভাবে?

কেউ হয়তো বলবেন, সরকার কি খারাপ কাজ করছে না? দেশে কি চুরি-চামারি হচ্ছে না? করোনাকালেও কি সরকার দুর্নীতি বন্ধ করতে পারছে?

না, সরকার দুর্নীতি বন্ধ করতে পারেনি। ডোবা চুরি, পুকুর চুরি, নদী চুরি, সাগর চুরি সবই হচ্ছে। এগুলো হতে পারছে কারণ দেশে একটি কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক শক্তি বিএনপির নেই। কারণ ক্ষমতায় থাকতে তারাও কম দুর্নীতি করেনি। দেশের মানুষও প্রতিবাদী হয়ে উঠছে না। কারণ তাদের সামনে কোনো ভালো বিকল্প নেই। দেশের মানুষের সামনে এমন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব নেই যা সুশাসনের গ্যারান্টি দিতে পারে।

বিএনপি কখনোই আওয়ামী লীগের পায়ের নিচে মাটি দেখে না। কিন্তু বিএনপির দুর্বলতাই যে আওয়ামী লীগের একটি অন্যতম শক্তি সেটা বিএনপি বুঝতে পারে না। বিএনপি যতক্ষণ পর্যন্ত একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হয়ে না উঠবে, ততক্ষণ দেশে যেমন গণতন্ত্রের সংকট দূর হবে না, তেমনি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনও গড়ে উঠবে না। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললে সেটা ফাঁকা আওয়াজের মতোই শোনাবে।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105298 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1