বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিসিএস : চাকরির বাজার ও অন্যান্য

চাকরির বাজারে অসম প্রতিযোগিতা রুখতে, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য সম্মান দিতে, মানবসম্পদ বৃদ্ধি করতে, চাকরির বাজারে চাপ কমাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা-ক্ষমতা বণ্টন, উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রণোদনা দিতে হবে সরকারকে।
ইকবাল হাসান
  ১১ জুলাই ২০২০, ০০:০০

বাংলাদেশের চাকরির বাজারে বিসিএস সোনার হরিণ। হঠাৎ পাওয়া লটারির টিকেটের মতো বিসিএস পাস করে চাকরি পাওয়া লোকের অবস্থা হয়। সম্প্রতি, ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হয়েছে। মঙ্গলবার (৩০ জুন) বিকালে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) বিশেষ সভায় দুই হাজার দুইশ চারজনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। প্রতিটি বিসিএসের মতো এটিও একটি সাধারণ বিসিএস। প্রিয়জনের চাকরি পাওয়ার খুশিতে সাধারণ জনগণ তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। সুপারিশকৃত দুই হাজার দুইশ চারজনকে শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। জীবনে অনেক ব্যর্থতার মাঝে হয়তো একটু হাসি হিসেবে এসেছে এই সাফল্য। সেই সাফল্যে শুধু তাদের আত্মীয়, প্রিয়জন খুশি না পুরো বাংলাদেশই খুশি। কারণ, বাংলাদেশের জনগণের সেবার জন্যই তারা। আশা করি, তারা তাদের সেবা দিয়ে সব জনগণের মাঝে সরকারি সুযোগ-সুবিধা সুষ্ঠুভাবে পৌঁছে দেবে।

তবে এই বিসিএস অন্যান্য বিসিএস থেকে একদিকে একটু ভিন্ন। প্রথমত, এই বিসিএস থেকে কোটা পদ্ধতি উঠে যাচ্ছে। এত দিনের আন্দোলন সফল হয়েছে তার জন্য আন্দোলনকারীদের অভিনন্দন। দ্বিতীয়ত, টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকে অনেকে ঝুঁকছেন সাধারণ ক্যাডারে। ৩৮তম বিসিএসে বেশ কিছুসংখ্যক ডাক্তারি পাস করা বাংলাদেশের নাগরিক স্বাস্থ্য ক্যাডার বাদ দিয়ে ফরেন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। এই তালিকায় শুধু ডাক্তার নয়, ইঞ্জিনিয়ারাও আছে; আছে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পড়া শিক্ষার্থীরাও। বাংলাদেশের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান থেকে প্রসব হচ্ছে একের পর এক সাধারণ ক্যাডার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের নাগরিক যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো চাকরি গ্রহণ করতে পারবে। সেই হিসেবে এরকম নিয়োগ স্বাভাবিক মনে হলেও রাষ্ট্রের লাভ-ক্ষতির দিক থেকে তা বড় বিপর্যয়। এটা নির্দ্বিধায় মেধার অপচয়।বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিসিএসে এরকম নজির দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো ভালো শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে গুটি কয়েক শিক্ষার্থী ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে পারে। একজন পররাষ্ট্র ক্যাডার যে কোনো বিভাগে পড়া একজন শিক্ষার্থী হতে পারে কিন্তু একজন ডাক্তার যে কেউ হতে পারবে না। তার জন্য চাই নির্দিষ্ট মেডিকেল ডিগ্রি এবং সেই সমান দক্ষতা। ডাক্তারদের প্রয়োজনীয়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে করোনা। এই পর্যন্ত মৃতু্যর মিছিলে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তাতে রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ডাক্তাররাও আহত-নিহত হয়েছে এবং এরকম সম্মুখযোদ্ধা করোনার মতো দুর্যোগে হারানো রাষ্ট্রের জন্য বিরাট ক্ষতির। টেকনিক্যাল ক্যাডার যে একজন রাষ্ট্রের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আরো প্রকট হয়েছে এবং ডাক্তারদের সুরক্ষা দেয়ার বিষয়ও। ধীরে ধীরে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার থেকে সাধারণ ক্যাডারে চাকরি লাভের খবর আরো শোনা যাবে। এতে দেশ হারাবে অমূল্য সম্পদ এবং মেধার অপচয় হবে ব্যক্তির। কিছু নির্দিষ্ট বিষয়গুলোতে শুধু স্কুল-কলেজ জীবনে দেখা প্রথম সারির ছাত্র শুধু পড়তে পারবে বলে জেনে এসেছি আজকে তারা কেন তাদের সেই প্রিয় এবং বহু আকাঙ্ক্ষিত পেশা ছেড়ে কেনই বা যোগ দিচ্ছেন অন্যদের সঙ্গে। তাহলে মেধারভিত্তিতে ক্লাসে তৈরি করা প্রথম সারি, দ্বিতীয় সারি, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? নাকি আমাদের রাষ্ট্র তাদের সঠিক সম্মান দিতে পারছে না! যখনই একজন ডাক্তার পোস্টিংয়ে যাবে তখন থেকেই বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় প্রশাসন ক্যাডারের। অথচ সেই 'প্রশাসন ক্যাডারপ্রাপ্ত বন্ধুটি হতে পারে ব্যাক বেঞ্চার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর সহজ ডিসিপিস্ননে পড়ে এবং ডাক্তার থেকে কম ক্রেডিটে পড়াশোনা করা ছাত্র। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, এত খেটে প্রথম সারির শিক্ষার্থী হয়ে ডাক্তারির মতো মহৎ পেশা বেছে নিয়েও ছেড়ে দিচ্ছেন অনেকে এবং যোগ দান করছেন সাধারণ ক্যাডারে। এছাড়া যদি আর্থিক দিক চিন্তা করি তাহলে দেখবো যে, জেনারেল ক্যাডারের (এডমিন, ফরেন, পুলিশ, ট্যাক্স, কাস্টমস, ইত্যাদি) উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে ২৫-৩০ লাখ টাকা দামের প্রাইভেট গাড়ি প্রদান করা হয় এবং সেই গাড়ির মেইনটেনেন্স খরচ হিসেবে মাসিক ৪০ হাজার টাকা দেয়া হয়। অপরদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল ক্যাডারের সমপর্যায়ের কর্মকর্তার জন্য এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি! এর ফলে বৈষম্য বেড়েই যাচ্ছে। ক্যাডার বদলের ক্ষেত্রে আর্থিক, মানসিক দিক বাদেও রয়েছে আরো কিছু ক্ষতিকর দিক। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের সিলসিলাপ্রাপ্ত আমাদের সিভিল সার্ভিসের সিস্টেম এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের সিস্টেমের একটাই কথা, এডমিন ক্যাডাররাই সব কাজের কাজি। তাহলে কেনইবা একজন ডাক্তার তার পছন্দের জায়গা ছেড়ে সাধারণ ক্যাডার হবেন না! এরকম চলতে থাকলে মেধার অপচয় হয়েই যাবে। আমাদের চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না তখন!

অ্যাডাম স্মিথ তার গ্রন্থ ওয়েলথ অব নেশনে বহু আগেই বলেছেন, কোনো একটা সুনির্দিষ্ট আচরণ যদি আমাদের পছন্দ না হয়, তাহলে এই আচরণের পেছনে যে প্রণোদনা কাজ করে সেটায় হাত দিলেই ওই আচরণ পরিবর্তন সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে ধরি একজন ব্যবসায়ীকে। যিনি ব্যবসা করে তার পরিবারের ভরণ-পোষণ করেন। এখন ব্যবসা থেকে যদি তাকে চাকরি অধিক নিরাপত্তা ও অধিক টাকা দিতে পারে তাহলে কেন সে ব্যবসায়ী হবে! তার যদি সুযোগ থাকে তাহলে সে তো চাইবেই উন্নত পর্যায়ে চলে যেতে। এখন তাকে যদি তার ব্যবসায় রাখতে হয় তাহলে সরকারকে তার প্রতি দিতে হবে অধিক গুরুত্ব, অধিক প্রণোদনা। এরকম না হলে সব ব্যবসায়ী চাইবে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে চাকরিজীবী হতে।

যে প্রণোদনা কাজ করছে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারকে তাদের পেশা ছেড়ে সাধারণ ক্যাডারের দিকে ঝুঁকতে এবং তাদের সেই যাওয়া কিংবা মেধার অপচয় যদি বন্ধ করতে চাই তাহলে সরকারকে সেই প্রণোদনার জায়গায় কাজ করতে হবে। কাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সেটা ভাবতে হবে। অর্থনীতির তিনটি সমস্যা: কী বানাব, কার জন্য বানাব, কী উপায়ের মতো সরকারকেও সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী রকম সুযোগ-সুবিধা দেব, কাকে দেব, কি উপায়ে দেব। তাহলে আমাদের দেশের প্রথমশ্রেণির শিক্ষার্থীরা চাকরিতেও প্রথমশ্রেণির মর্যাদা পাবে এবং দেশ পাবে যোগ্য সন্তান।

বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে মানবসম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের মানব রয়েছে সেগুলোকে সম্পদে পরিণত করে তুলতে হবে। তার জন্য চাই বিশেষ প্রণোদনা। যাতে উপযুক্ত ব্যক্তি তার উপযুক্ত কাজ পায় এবং এর ফলে সে সেই ক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চটা দেবে। এতে দেশের লাভ, দশের লাভ।

ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা সুষ্ঠুবণ্টন ছাড়াও সরকার যদি উদ্যোক্তা তৈরিতে মনোযোগী হয় তাহলে সরকারি চাকরির ওপর চাপ কমবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট  প্রস্তাব করা হলেও উদ্যোক্তাদের জন্য সেরকম কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি এই বাজেটে।

তারপর আসছে চাকরির বাজারের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এই করোনা সময়ে একাধিকবার রিপোর্ট হয়েছে 'সরকারি চাকরিজীবীরাই একমাত্র সুখে আছেন এ সময়ে' এই শিরোনামে। কেননা, তাদের নেই ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার ভয়, নেই বেতন কম পাবার ভয়। যথা সময়ে তারা বেতন বোনাস পেয়ে যাচ্ছে এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হচ্ছে না। কিন্তু আমরা যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখব তারা যে কোনো সময় ছাঁটাই করে দিচ্ছে কর্মী, বেতন দিচ্ছে না ঠিকমতো, পেনশন সুবিধা দিচ্ছে না। তাই, তরুণরা একটি নিশ্চিত জীবনের আশায় তাদের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে নেমে পড়ছে বিসিএসের দৌড়ে। এর ফলে, চাকরির বাজারে দেখা যাচ্ছে অসম প্রতিযোগিতা। প্রথম সারির শিক্ষার্থী প্রথমই হচ্ছে এবং যারা পেছনের সারি তারা সারাজীবন পেছনেই পড়ে থাকছে। এর ফলে মেধার ভিত্তিতে করা সারিটা রূপ নিচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সারিতে।

চাকরির বাজারে অসম প্রতিযোগিতা রুখতে, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য সম্মান দিতে, মানবসম্পদ বৃদ্ধি করতে, চাকরির বাজারে চাপ কমাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা-ক্ষমতা বণ্টন, উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রণোদনা দিতে হবে সরকারকে।

বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সরকারকে বেঁধে দিতে হবে নির্দিষ্ট নিয়ম- যাতে খেয়াল খুশি মতো তারা কর্মী ছাঁটাই করতে না পারে। তখনই আমরা পারব দুধ বিক্রি করে মদ কেনার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে এবং মানবসম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করতে।

ইকবাল হাসান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105419 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1