বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ: করোনা, ডেঙ্গু এবং অতঃপর

আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস একটি সুপার স্প্রেডার। এটি সবাইকে হত্যা করতে না পারলেও যে কাউকে সহজে আক্রমণ করতে পারে। তাছাড়া এ রোগের কোনো ওষুধ এখনো বের হয়নি। তবে যথাযথ সচেতনতা এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা আমাদের এ মহামারি থেকে রক্ষা করতে পারে। আসুন, নাগরিক হিসেবে দায়িত্বশীল আচরণ করে আমরা সবাই মিলে দেশ ও দেশের মানুষকে করোনা মহামারি থেকে রক্ষা করি।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জি এম কামরুল ইসলাম, এসপিপি, এনডিসি, পিএসসি (অব.)
  ২১ জুলাই ২০২০, ০০:০০

বিশ্ববাসী করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আতঙ্কিত। আতঙ্কিত হবেই না কেন? করোনা আধুনিক সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। আমাদের সব কিছুকে ওলট-পালট করে দিয়েছে। আমাদের সবারই স্বাভাবিক জীবন কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মোট কথা সব মানুষের জীবনে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে এবং ভবিষ্যতে কী হবে তা অনুধাবন করা যাচ্ছে না। ১৭ নভেম্বর, ২০১৯ সালে চীনের হুবাই প্রদেশের উহান (ডঁযধহ) শহরে প্রথম করোনা রোগ দেখা গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চীনা অফিস ৩১ ডিসেম্বরে অজ্ঞাত ধরনের নিউমোনিয়ার কথা জানতে পারে আর ০৭ জানুয়ারি চীনা কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাস শনাক্তের ঘোষণা করে। সম্ভাব্য ভয়াবহতা সম্পর্কে একজন ডাক্তারের হুঁশিয়ারি শর্তেও প্রথমে কিছুটা লুকোচুরি ও শীতলতা দেখিয়ে পরবর্তীকালে সব ধরনের সর্বোচ্চ প্রতিকার ও প্রতিরোধকমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরেও রোগটি বিভিন্ন দেশে দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়েছে। তবে চীন বলছে যে, উহানে একটি 'সামরিক মেলা'র সময় মার্কিন সেনাদের মাধ্যমে ভাইরাসটি চীনে এসেছে। এমন কি চীন ও ইরান বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাইলোজিক্যাল যুদ্ধের অংশ হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। বৈশ্বিক কারণে/স্বার্থে এসব কথা এবং আরও অনেক ধরনের দোষারোপ, গুজব, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চলছে।

বাংলাদেশে প্রথমে তিনজনের (দুজন ইতালি ফেরত পুরুষ এবং তাদের একজন দ্বারা সংক্রমিত এক নারী) কোভিক-১৯ এ আক্রান্তের ঘোষণা আসে ০৮ মার্চ। ১৪ মার্চ সকালে পুরাতন তিনজনের রোগমুক্তির এবং রাতে আরো দুজনকে (ইতালি ও জার্মান ফেরত) চিহ্নিত করার ঘোষণা দেয়া হয়।

করোনা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। চিকিৎসা, আর্থ-সামাজিক ও যোগাযোগসহ সব ক্ষেত্রের দুর্বল এবং নাজুক অবস্থা বাংলাদেশের।

\হচীনাসহ অন্যান্য দেশের প্রচুর বিদেশির অবস্থান, প্রায় এক কোটির বেশি অভিবাসী ইত্যাদি কারণে আমাদের দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে করোনা মহামারির বড় ধরনের ঝুঁকিতে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক অষ্টার হোমও সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশে করোনা আরো ১০-১৫ গুণ ভয়ংকর আকার ধারণ করবে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর প্রকোপের সম্ভাবনাও আছে। গত বছর ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে ডেঙ্গুতে প্রচুর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। করোনা আর ডেঙ্গু যদি এবার একসঙ্গে আক্রমণ করে তবে আমাদের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হবে। ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানিসহ কয়েকটি দেশ শুরুতে হালকাভাবে নেয়ার জন্য করোনায় ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। অতএব, করোনাকে হালকাভাবে না নিয়ে বরং এখনই করোনা ও ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রস্তুতি, প্রতিকার, প্রতিরোধ ও হুঁশিয়ারিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সর্বোচ্চ কোয়ারেন্টিন ও চিকিৎসার প্রস্তুতি এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশ করোনার বিরুদ্ধে এতদিন যা করেছে তার চেয়ে বেশি এবং সুনির্দিষ্ট কর্মপরিল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে হবে। তাকে একটি সুচিন্তিত সুদূরপ্রসারী সময়ভিত্তিক (তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি) পরিকল্পনা প্রণয়ন (যাতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রী ও আন্তর্জাতিক উপাদান থাকবে) করে সশস্ত্রবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমন্বয় করে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করতে হবে।

ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে ব্যবস্থাসমূহের দ্বারা মূলত রোগ প্রতিরোধক শক্তিবৃদ্ধি ও নিরাময়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই ধূমপান ও অ্যালকোহল পান করা বন্ধ এবং প্রতিদিন গোসল (যদি সম্ভব হয় অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সাবান বা বডিওয়াশ-ডিটল দ্বারা) করতে হবে। ঠান্ডা খাবার যথা- আইসক্রিম, ঠান্ডা রস, বরফ, ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রচুর পানীয় যথা- পানি, রস, গরম সু্যপ, ইত্যাদি পান করতে হবে।

ভিটামিন-সিসমৃদ্ধ আইটেম যথা- কমলার রস, লেবু, অন্যান্য টক ফল, ইত্যাদি খেতে হবে। সূর্যের এক্সপোজার (ভিটামিন- ডি) অনেক উপকারী। ঘন ঘন হাতধোয়া ও হাতের স্যানিটেশন বজায় রাখতে হবে। ডিম, মুরগি, ইত্যাদিসহ সব খাবার বিশেষভাবে সিদ্ধ করে খেতে হবে। হাঁপানি, পড়ঢ়ফ, ডায়াবেটিস, ঐঞঘ, ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হার্ট-স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। আর ফ্লুর সময় ও হামলার পরে প্যারাসিটামল জাতীয় যথা- এক্সপিএ-এক্সআর / এসেস পস্নাস / নাপা প্রসারিত / নাপা অতিরিক্ত / নাপা দ্রম্নত ইত্যাদি এবং অ্যান্টিহিস্টাসিন জাতীয় যথা- ফেক্সো, রূপা, অ্যালট্রোল, ডেসেল, কেটোটিফেন, ষড়ৎধঃরফরহব, ইত্যাদি ওষুধ খেতে হবে। বাষ্প ইনহেলেশন যথা পেস্নইন টেপ বা লবণাক্ত পানি কিম্বা বাষ্পীকরণকারী বা কেটলি দ্বারা মেন্থল এবং ক্যামোমিল, পূর্ণভা এস্পায়ারার ও প্রয়োজনীয় তেল যোগ করে ব্যবহার করা যেতে পারে। নুনের পানিতে গার্গল করা ভালো। নরসোল অনুনাসিক ড্রপ নেয়া ভালো। পৃথক টয়লেট ব্যবহার করা ভালো। তা সম্ভব না হলে নিয়মিত টয়লেট পরিষ্কার করতে হবে। মুখোশ ব্যবহার এবং হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢাকতে হবে। টিসু্য পেপার ব্যবহার করে তা ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। চুম্বন ও আলিঙ্গন বন্ধ এবং কাছের ও প্রিয়জনের থেকে কমপক্ষে তিন ফুট এবং অন্যান্য ফ্লু রোগীর থেকে দূরে থাকতে হবে।

সমাজ, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করণীয় ঠিক করার সময় মনে রাখতে হবে যে মহামারির মৃতু্য কেবলই অসুখে হয় না, অন্য আরো অনেকভাবেই হয় ও হতে পারে। অনেক সময় অসুখ যতটা দায়ী, তার চেয়ে আমদের আচার-ব্যবহার আর কথা-বার্তা অনেক বেশি দায়ী। অতিত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, বিভিন্নভাবে আতঙ্কিত হয়ে, আতঙ্ক ছড়িয়ে ও অসুস্থ্যদের চিকিৎসাবঞ্চিত রেখে এবং অনেক সময় ওষুধপত্রসহ অন্যান্য জিনিসের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আমরা মহামারির ব্যাপকতা, মাত্রা ও গভীরতা বহুগুণ বাড়িয়ে ফেলি। তাছাড়া মনে রাখতে হবে যে, আমরা যতই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভাইরাস ছড়ান রোধ করি না কেন, কিছু ইনফেকশন হবেই। সেজন্য এসবের পাশাপাশি দরকার সবার নাগালের মধ্যে একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা। করোনা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হলো সংক্রমিত রোগী শনাক্ত করে দ্রম্নত আইসোলেশন করা। করোনা হোক বা না হোক, কোনো সন্দেহভাজন রোগীকে চিকিৎসা বঞ্চিত করা যাবে না বরং তার জন্য চিকিৎসা ও নিরাপত্তা সংবলিত চিকিৎসক কভার করার জন্য পর্যাপ্ত প্রোটেক্টিভ গিয়ারসহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। পারিবারিক কোয়ারেন্টিনের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয়/কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কোয়ারেন্টিন করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অভ্যন্তরীণসহ খেলারমাঠ, হাসপাতাল, ইত্যাদি স্থানে কোয়ারেন্টিন ও চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা যেতে পারে। দেশের সব চিকিৎসক, প্যারামেডিক্স ও নার্সসহ চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সেচ্ছাসেবক, স্কাউট, বিএনসিসি, ফায়ার ব্রিগেডসহ সব সংস্থা, সশস্ত্র বাহিনীসহ সব বাহিনী ইত্যাদিকে সংশ্লিষ্ট করে প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে কাজ করতে হবে। দেশের ভেতরে ও বাহিরে যে যেখানে আছে তাকে সেখানে নিরাপদে থাকতে হবে। তাছাড়া জনগণকে সব সময় সঠিক তথ্য ও বার্তা দিতে হবে যাতে তারাও নিজেদের যথাযথভাবে প্রস্তুত রাখতে পারে।

ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, যুগে যুগে পৃথিবীতে রোগ-শোক, বালা-মুসিবত ও দুর্যোগ এসেছে এবং হয়তো ভবিষ্যতে আসবে। ঈসা আলাইয়ের সালামের সময় মিশরের দুর্ভিক্ষসহ ১৭২০ সালে পেস্নগে বিশ্বের প্রায় বিশ কোটি, ১৮২০ সালে কলেরায় ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লাখ লাখ এবং ১৯২০ সালে স্প্যানিস ফ্লুতে প্রায় পাঁচ কোটি লোক মারা যায়। তারপরেও সময় সময় সার্সসহ আরো অনেক ভাইরাসে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশ ও সমাজ ধৈর্য ও সততার সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছে। করোনার ব্যাপারেও আমাদের একই রকম এবং আরো বেশি করে সতর্কতা ও কার্যকরী চিকিৎসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সম্ভাব্য ডেঙ্গু প্রকোপের বিরুদ্ধেও সর্বাত্মক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস একটি সুপার স্প্রেডার। এটি সবাইকে হত্যা করতে না পারলেও যে কাউকে সহজে আক্রমণ করতে পারে। তাছাড়া এ রোগের কোনো ওষুধ এখনো বের হয়নি। তবে যথাযথ সচেতনতা এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা আমাদের এ মহামারি থেকে রক্ষা করতে পারে। আসুন, নাগরিক হিসেবে দায়িত্বশীল আচরণ করে আমরা সবাই মিলে দেশ ও দেশের মানুষকে করোনা মহামারি থেকে রক্ষা করি।

\হ

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জি এম কামরুল ইসলাম, এসপিপি, এনডিসি, পিএসসি (অব.) : কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<106534 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1