শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা ও চিকিৎসায় সংস্কার প্রয়োজন

আসলে আমরা পুরোটাই নষ্ট হওয়ার পথে। যারা ধরা পড়ে শুধু তারাই অপরাধী এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। দুয়েকটা ঘটনা প্রকাশিত হয়ে বুঝিয়ে দেয়- আমরা কতটা নষ্ট হয়েছি, কতটা নিমজ্জিত পাপে। সময় এসেছে শিক্ষা ও চিকিৎসায় মনোযোগী হওয়ার।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ২৩ জুলাই ২০২০, ০০:০০

দেশ কখনো আমেরিকা, কখনো কানাডা, কখনো সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছি বহুদিন। চারিদিকে চোখ ঝলসে যাওয়া আলো আর অট্টালিকার ঝলক। নদী, বন, পাহাড় উজাড় করে উন্নয়নের মহাযজ্ঞে আচমকাই উপস্থিত করোনা।

আমাদের তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের, ভাবনার, পরিকল্পনার মাঝে করোনা উপস্থিত হয়ে সব ভুল আর মিথ্যে প্রমাণিত করে দিল।

সুরম্য অট্টালিকা, সুদৃশ্য উপাসনালয় আর কৃত্রিম সৌন্দর্যের পরিবর্তে আমাদের হাসপাতাল, ডাক্তার, চিকিৎসাসামগ্রীর প্রয়োজন যে অধিক ছিল তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এ মহামারি।

আমাদের কোথায় সমস্যা নেই? সর্বাঙ্গে ব্যথা নিয়েই বসবাস। কোথা দিতে হবে না ওষুধ?

মাথায় সমস্যা হলে সে সমস্যা ছড়িয়ে যায় সর্বত্র। তেমনি আমাদের শিক্ষার গলদ খুব ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজে, দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে।

রমজান, সাধারণ ছুটি মিলিয়ে যথেষ্ট সময় আমরা পেয়েছি, সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধান খুঁজে পেতে কিন্তু আমরা সব সময় মাথা নিযুক্ত করি চুরি করা আর চোর ধরায়। চাল চোরের পেছনে ঘুরতে ঘুরতেই সময় পার।

এদিকে কতভাবে কতরূপে সৃজনশীল পদ্ধতিতে শুরু হয়ে গেছে কারও কারও কোটি কোটি টাকা উপার্জনের পথ সে খবর রাখতে পারিনি।

বিশ্বের বড় বড় দেশ যারা উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে তারা করোনা নিয়ে নাকানিচুবানি খাচ্ছে। আমরা তখন কেউ করোনার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, কেউ মহামানবের কারণে করোনা এ দেশে আসবে না ভেবে নিশ্চিন্ত থাকছি।

ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে আমাদের চিকিৎসার দীনতার সঙ্গে মানবিকতার দীনতাও। মা-বাবাকে ভয়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে, করোনা রোগীর বাড়ি পাথর মারা হচ্ছে, স্বাস্থ্যকর্মীকে বাড়ি ছাড়া করা হচ্ছে, গোরস্তানে কবর দিতে বাধা দেয়া হচ্ছে; এসব খবর অন্য কোনো দেশ থেকে না পেলেও আমাদের দেশে পাওয়া যাচ্ছে।

আমরা যখন অতি দরিদ্র ছিলাম তখন আমাদের পারিবারিক বন্ধন নিয়ে আমরা গর্ব করতাম। খাদ্যে ও বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে আমরা হারালাম আমাদের মানবিক অহঙ্কারের স্থান।

একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতিবিহীন এ দেশ শিক্ষাক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সব সময়ই হ-য-ব-র-ল অবসস্থায় থাকে। মার্চে একটি সাধারণ ছুটি ঘোষণার সময় দফায় দফায় প্রজ্ঞাপন প্রচারের প্রয়োজনীয়তা দেখা গেছে। সমন্বয়হীন সিদ্ধান্তের কারণে ঘণ্টায় ঘণ্টায় একই বিষয়ে পরিপত্র জারি করার প্রয়োজন হয়। আমাদের মহামান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মিডিয়ার সামনে যখন কথা বলেন, তখন তারাও একই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পেশ করে নিজেদেরই হাস্যকর করে তোলেন। তাই তো প্রজ্ঞাপন জারি করে সম্মানিত ব্যক্তির সম্মান রক্ষার প্রয়োজন পড়ল।

খাদ্য, চিকিৎসা এবং শিক্ষা ৩টিই মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ভাবতে হবে কাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই দুঃসময়ে জীবন বাঁচাব আমরা।

বায়ু দূষণে শীর্ষ পাঁচে অবস্থানকারী শহরের মধ্যে ঢাকা একটি। বিষে, বিষ ক্ষয় হয়। ফলে করোনার যতটা ঘায়েল করার কথা ছিল ততটা করতে পারেনি এখনো।

বারবার বলা হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা। এজন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার কথা। শুধু আলু-ভর্তা দিয়ে তিনবেলা খাবার খেতেই যাদের নাভিশ্বাস উঠছে তাদের কাছে এ প্রস্তাব হাস্যকর।

\হকোনমতে জীবন বাঁচানোর জন্য খাবার খাওয়া, বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকা, বিদু্যতের যখন তখন আসা যাওয়া, নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে সারা বছর ঔষধ খাওয়া এ ধরনের নানা জটিলতার সঙ্গে যাদের বসবাস তাদের জন্য 'অনলাইন শিক্ষা' কতটা কার্যকর?

ঘরবন্দি শিশুদের ঘরে রাখার জন্য প্রয়োজন খাদ্য আর বিনোদন। মা-বাবা প্রয়োজনীয় খাদ্যই যেখানে দিতে ব্যর্থ সেখানে লেখাপড়া এসব শিশুদের কাছে যন্ত্রণা সমতুল্য।

একটু অন্যভাবে যদি ভেবে দেখি, আমরা এই লেখাপড়া দিয়ে শিশুদের জীবন বিষিয়ে তুলেছিলাম। প্রযুক্তি দিয়ে তাদের মানবিকতাকে, নৈতিকতাকে ধ্বংস করেছিলাম। শিক্ষা আমাদের আলো না দিয়ে অসুস্থ এক অনৈতিক প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছিল। সরকার, অভিভাবক, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠানসহ সবাই এ অনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল।

ঠিক যেমন আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি বলে প্রতিশোধ স্বরূপ আমাদের ঘরে পাঠিয়ে প্রকৃতি তার আপন মহিমায় জাগ্রত হয়েছে। তেমনি শিশুদের আমরা বাড়তে দেইনি তার শৈশব, কৈশোর নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাই তো প্রকৃতি শিশুদের কষ্ট বুঝতে পেরে রুষ্ট হয়েছে।

ভারী ব্যাগের বোঝা, পরীক্ষার যন্ত্রণা, এ- পস্নাসের দাবি, এ সব অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতেই করোনা চলে এসেছে। ঘরবন্দি করেছে সব কিছু। বন্ধ করে দিয়েছে বিদ্যালয়ের দরজা।

অনলাইন শিক্ষা কতটুকু পৌঁছাতে পেরেছে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে? বেসরকারি অনেক স্কুলের শিক্ষক এখন রিকশা চালাচ্ছে, তরকারি বিক্রি করছে, মাটি কাটছে।

সনদ নির্ভর, এ-পস্নাস প্রত্যাশী শিক্ষা আমাদের গোটা সমাজটাকে অনৈতিক প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছিল। শিশুদের এই প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়ে আমরা শৈশবেই শিখাচ্ছি অপরাধ। আমাদের ভুলগুলোকে ধরিয়ে দিতেই এই করোনা দুর্যোগ।

পঞ্চম শ্রেণি আর অষ্টম শ্রেণির যে পাবলিক পরীক্ষা আমাদের নীতি নৈতিকতাকে ধ্বংস করছে, গরিব অভিভাবকের অর্থ শোষণ করেছে তার বিনিময়ে কী পাচ্ছে দেশ?

শিক্ষা এবং চিকিৎসা মানুষকে ঋণগ্রস্ত করছে, দরিদ্র করছে। যে দুইটি পাবলিক পরীক্ষা অভিভাবকদের পরিশ্রমের অর্থ শোষণ করছে তা কী দিচ্ছে দেশকে? শুধুই সনদ। শুধুই এ-পস্নাসের তৃপ্তি।

উচ্চ শিক্ষায় এ সনদের কোনো হিসাব কাজে লাগে না। এ শিক্ষা শেষে এমন কোনো দক্ষতা অর্জিত হয় না- যা এসব শিশুদের দক্ষ কর্মী হতে সহায়তা করবে। অথচ এ দুটি পাবলিক পরীক্ষা ঘিরে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য।

গাইড ছাপা বন্ধ না করে নির্দেশনা দেয়া হয় গাইড পড়া যাবে না। ফলে পাঁচ / ছয় বছর থেকেই শিশুটি শিখে নেয় গাইড কিনতে হবে, পড়তে হবে। তবে তা লুকিয়ে।

ঔষধ কোম্পানির মতো, গাইড প্রকাশনীগুলো উপহার নিয়ে স্কুলে স্কুলে ঘোরে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি শিশুদের জীবন আরো বিষিয়ে তোলে। তাদের সম্মান-মর্যাদা রক্ষার দায় শিশুর ভালো ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং আয়ের সিংহভাগ সন্তানের লেখাপড়ায় ব্যয় করে। কোচিং নিষিদ্ধ অথচ রাস্তায় রাস্তায় কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন।

দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী সন্তানের শিক্ষার জন্য তার আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করে ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে যখন দিনযাপন করে তখন এ দেশেরই কিছু লোক পঞ্চম শ্রেণিতে না পড়িয়েই সন্তান অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করায়। অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা না দিয়েই অনেক ছেলেমেয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এ কাজগুলো স্কুল, মাদ্রাসা সর্বত্র হয়।

বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব অনৈতিক কর্মকান্ড বছরের পর বছর চলছে। দেখবার কি কেউ নেই?

চিকিৎসা ক্ষেত্রে নানা ভয়ংকর ঘটনা উঠে এসেছে করোনার কারণে। শিক্ষাক্ষেত্রেও খুঁজলে পাওয়া যাবে নানা অকল্পনীয় ঘটনা।

আসলে আমরা পুরোটাই নষ্ট হওয়ার পথে। যারা ধরা পড়ে শুধু তারাই অপরাধী এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

দুয়েকটা ঘটনা প্রকাশিত হয়ে বুঝিয়ে দেয়- আমরা কতটা নষ্ট হয়েছি, কতটা নিমজ্জিত পাপে। সময় এসেছে শিক্ষা ও চিকিৎসায় মনোযোগী হওয়ার।

আমাদের দীনতার, লজ্জার এবং অমানবিকতার স্থানগুলো উন্মোচিত হয়েছে। সংস্কার কোথায় প্রয়োজন তা যদি এবারও বুঝতে না পারি তা হলো কবে বুঝব?

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক ও শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<106719 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1