বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং তিনটি বইয়ের ভূমিকা

বঙ্গবন্ধুর লেখা এই খাতা উদ্ধার ছিল বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসার প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। বঙ্গবন্ধু যতবার জেলে যেতেন বেগম মুজিব খাতা, কলম দিতেন লেখার জন্য। বারবার তাগাদা দিতেন। আবার বঙ্গবন্ধু যখন জেল থেকে ছাড়া পেতেন তখন বেগম মুজিব জেল গেটে যেতেন বঙ্গবন্ধুকে আনতে আর বঙ্গবন্ধুর লেখাগুলো যেন আসে তা নিশ্চিত করতেন।
ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
  ০৭ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

২০২০ সালের শোকের মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর তিনটি বইয়ের ভূমিকা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করাই বর্তমান লেখাটির উদ্দেশ্য। শুরুতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ আবু নাসের, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মণি, বেগম আরজু মণি, শেখ কামাল, সুলতানা কামাল খুকি, শেখ জামাল, পারভীন জামাল রোজি, শেখ রাসেল, কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুল হক, সুকান্ত আব্দুলস্না বাবু, শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নায়েম খান রিন্টু এবং ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যাকান্ডের শিকার হয়ে শাহাদাতবরণকারী জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এএইচএম কামারুজ্জামান প্রমুখের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বই তিনটি হচ্ছে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজ নামচা' এবং 'আমার দেখা নয়াচীন'। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে স্মৃতিকথা এবং ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর আরও দুটি বই প্রকাশিত হবে। এ তিনটি বইয়েরই ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিহাসেরও একটা ইতিহাস থাকে। বঙ্গবন্ধুর আলোচিত তিনটি বই প্রকাশিত হওয়ার আগে, বইগুলোর পান্ডুলিপি প্রস্তুতকরণ, পান্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়া এবং খুঁজে পাওয়া প্রভৃতি পরিস্থিতি সম্পর্কে এই বই তিনটির ভূমিকা থেকে পাওয়া যায়। যাহোক, প্রকাশিত তিনটি বই একত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয় ও এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি সমকালীন পরিস্থিতি তথা সহজ ভাষায় বাংলাদেশের ইতিহাসের বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর বইগুলো বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে আকর গ্রন্থ। এই বইগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের ধ্রম্নপদী আখ্যান। লেখার স্টাইল, কাহিনির বর্ণনা এবং ঘটনার সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপন, সবদিক দিয়ে এগুলো অতুলনীয়। তবে অত্যন্ত দুঃখ ও হতাশার বিষয় হচ্ছে বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় এই বই তিনটি প্রকাশ করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত ডানপন্থি সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ও চীনপন্থি উগ্রবামগোষ্ঠীর যোগসাজশে দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে ২০১৯ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত 'ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক গ্রন্থে উলেস্নখ করা হয়েছে যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য ১৯৭৩ সালেই ১৮৯৬ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে পাটের গুদামে আগুন দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে একজন এমপিকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে আরও দুজন এমপিকে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে খোন্দকার মোশতাক গংদের দ্বারা মদদপুষ্ট হয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার শোকাবহ ও কলঙ্কময় আগস্ট মাস বাংলাদেশের শোকের মাস।

যে ধাপগুলো অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর বই তিনটি প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে এ সম্পর্কিত ইতিহাসের ইতিহাস এবং তা বই তিনটির ভূমিকা থেকে পাওয়া যায়। বই আকারে প্রকাশের আগে এগুলো ছিল বঙ্গবন্ধুর ডায়েরি বা খাতায় লেখা, যা বইগুলোর মূল পান্ডুলিপি। তবে বঙ্গবন্ধুর বইয়ের পান্ডুলিপি যেহেতু ডায়েরি বা খাতায় লেখা হয়েছিল সেহেতু এই ডায়েরি লেখা এবং তাও আবার কারাগারে বসে লেখার ব্যাপারটি বইগুলোর ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে। লেখা এবং লেখকদের জগতে ডায়েরি থেকে বই বিষয়টি বিশ্বব্যাপী বেশ পরিচিত। যে লেখকরা তাদের অভিজ্ঞতা, চিন্তা অথবা আবেগ আনুক্রমিকভাবে রেকর্ডভুক্ত করেন তাদের সেই লেখাগুলো থেকে ঐতিহাসিক সময়কাল সম্পর্কে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সূক্ষ্ণ বিচার শক্তি লাভ করতে পারি। প্রসঙ্গক্রমে উলেস্নখ করা যেতে পারে, এই শ্রেণির লেখকদের মধ্যে আছেন ইংরেজ প্রশাসক ও পার্লামেন্ট সদস্য স্যামুয়েল পেপি, যার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের মধ্যে সপ্তদশ শতাব্দীর বিভিন্ন ঘটনা এবং বিশেষভাবে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনের বিশাল অগ্নিকান্ড সম্পর্কে বিবরণ উলেস্নখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে আরও একটি বিশ্বখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। ১৩ বছর বয়সে ওলন্দাজ লেখক অ্যান ফ্রাঙ্ক (১৯২৯-১৯৪৫) ডায়েরি লিখেছিলেন। ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত এই ইহুদি বালিকা তার ডায়েরিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন সে সবের বিবরণের পাশাপাশি একজন বয়োঃসন্ধিকালের বালিকা হিসেবে আন্তঃপরিবার পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য জীবন-মরণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া বঙ্গবন্ধু তার সংগ্রামবহুল জীবনের অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছিলেন তার ডায়েরির পাতায়। তবে স্যামুয়েল পেপিসের ডায়েরি বা অ্যান ফ্রাঙ্কের দ্য ডায়েরি অব অ্য ইয়ং গার্ল থেকে বঙ্গবন্ধুর ডায়েরির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধু তার ডায়েরি বা খাতা লিখেছিলেন কারাবন্দি থাকা অবস্থায়। বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থের ভূমিকায় বলা হয়েছে 'বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের সব আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করেছেন। তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করা হয়েছে। তার জীবনে এমন সময়ও গেছে যখন মামলার সাজা খাটা হয়ে গেছে, তারপরও জেলে বন্দি করে রেখেছে তাকে। এমনকি বন্দিখানা থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরতে পারেননি, হয় পুনরায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেছেন অথবা রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে।'

আবার কারাবন্দি থাকাকালে লেখা হয়েছে এবং তা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে এ ধরনের বিশ্বখ্যাত উদাহরণ অনেক আছে। মিগুয়েল ডি সার্ভ্যনটিস কারাগারে থাকাকালে স্প্যানিশ সাহিত্যের সর্বাধিক খ্যাতনামা উপন্যাস 'ডন কুইকজোট' লিখেছিলেন। ইতালীয় পরিব্রাজক, ব্যবসায়ী এবং লেখক মার্কো পোলো ২৪ বছর পর এবং প্রায় ১৫,০০০ মাইল ভ্রমণ শেষে যখন ইতালি ফিরেছিলেন তখন ভেনিস এবং জেনওয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। এই সময় জেনওয়া কর্তৃক ভেনিসের একটি নৌবহরের ওপর চড়াও হওয়ার পর পোলোকে বন্দি করা হয়েছিল। দীর্ঘকাল কারান্তরালে থাকার সময় সহকারাবাসী রুস্টিছেলেস্না দ্যা পিসার নিকট পোলো তার ভ্রমণকাহিনি বর্ণনা করেছিলেন। পিসা এই কাহিনিকে লিখে রেখেছিলেন এবং পরে এটি 'দ্য ট্রাভেলস অব মার্কো পোলো' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। অতিদ্রম্নত এই বইটি সমগ্র ইউরোপে প্রচার লাভ করে। আর এর দ্বারা 'চমকপ্রদ প্রাচ্য' সম্পর্কে পাশ্চাত্যবাসী সম্যক ধারণা লাভ করে। হেনরি ডেভিড থরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচাচুসেটসের কনকর্ডের 'ওয়ালডেন পন্ড'-এর নৈসর্গিক তীরে থাকাকালে সিভিল ডিজঅবিডিয়েন্স সম্পর্কে তার বিখ্যাত বই ওয়ালডেন বা লাইফ ইন দ্য উডস লিখেছিলেন। তিনি সেই অর্থে কারাবাসী ছিলেন না। তবে সরকারের মূল্য সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করে কর দিতে অস্বীকার করার কারণে এক রাত তাকে কারাবাস করতে হয়েছিল। আর এই একরাত কারাবাস থরোকে সিভিল ডিজঅবিডিয়েন্স সম্পর্কে তার ধ্রম্নপদী রচনা লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। থরোর সিভিল ডিজঅবিডিয়েন্সের একজন ভক্ত মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার। আলবামায় বর্ণবৈষ্যম্যের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদ করার কারণে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার আটক করে কারাবন্দি করা হয়েছিল। আর কারাবন্দি থাকাকালেই তিনি লিখেছিলেন তার ঐতিহাসিক প্রবাদপ্রতীম ভাষ্য, যে কোনো স্থানের অবিচার সব স্থানের ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি (ইনজাস্টিস এনি হয়ার ইজ অ্য থ্রেট টু জাস্টিস এভরিহয়ার 'রহলঁংঃরপব ধহুযিবৎব রং ধ :যৎবধঃ :ড় লঁংঃরপব বাবৎুযিবৎব.')

যা হোক, আমাদের বিবেচ্য বিষয় বঙ্গবন্ধুর ডায়েরি বা খাতা। ডায়েরি বা খাতা লেখার আগে এগুলো ছিল বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতা ও চেতনার মধ্যে। জীবনের যে বিপদসঙ্কুল ও সংগ্রামমুখর পথ তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন সেই পথে তিনি যা কিছুর মুখোমুখি হয়েছিলেন তার সামান্য অংশ এই বইগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর লিখিত খাতার বর্ণনার চেয়ে তিনি যে ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন তা ছিল আরও ভয়ঙ্কর। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার সততা, সাহস, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস, ভালোবাসা, কর্তব্যের প্রতি অঙ্গীকার প্রভৃতি দিয়ে তা অতিক্রম করেছেন। এই মহামানব তার জীবদ্দশায় যে 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার' অতিক্রম করে স্বাধীনতার সূর্য আমাদের উপহার দিয়েছেন সেই সব ঘটনা-দুর্ঘটনাবহুল কাহিনিগুলো থেকে বেশকিছু অংশ এই বইতে তুলে ধরেছেন। এ কারণে যে কাহিনি বইতে বর্ণনা করা হয়েছে তার গুরুত্ব, যিনি এগুলো লিখেছেন তার অবস্থা তথা মন-মানসিকতা, যিনি বা যাদের প্রচেষ্টায় বইটি বা বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার বা তাদের অবস্থা এ সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। ১৯৬৬-১৯৬৯ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে একান্ত নিরিবিলি সময়ে বঙ্গবন্ধু তার সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের কাহিনি ডায়েরিতে লিখেছেন।

বঙ্গবন্ধুর বই তিনটির ভূমিকা থেকে আমরা জানতে পারি স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অপরিসীম ও নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং অজানা কিছু তথ্য। বঙ্গবন্ধু যেমন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বসে খাতার পাতায় লিখে রেখেছিলেন এ দেশের ইতিহাসের অনেক অজানা কথা, তেমনি তার কন্যা শেখ হাসিনাও কারাগারে থাকাকালে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র ভূমিকা প্রথম লিখেছিলেন ২০০৭ সালের ৭ আগস্ট। এসময় তিনি শেরেবাংলা নগর সাব জেলে বন্দি ছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এই বইয়ের ভূমিকার পুনশ্চঃ লিখেছিলেন ২০১০ সালের ৩০ জুলাই। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র ভূমিকা থেকে জানা যায় ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরে আসার পর জিয়া সরকার তাকে ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয়নি। পরে ১৯৮১ সালের ১২ জুন সাত্তার সরকার বাড়িটা হস্তান্তর করার পর বঙ্গবন্ধুর 'লেখা স্মৃতিকথা, ডায়েরি ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো পান। কিন্তু আত্মজীবনীর খাতাগুলো তখন পাননি। একপর্যায়ে ওগুলোর আশা তিনি ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন মৃতু্যর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন তখন বঙ্গবন্ধুর অমূল্য আত্মজীবনীর 'চারখানা খাতা' তার হাতে আসে। এই খাতাগুলো ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ারে। সম্ভবত বঙ্গবন্ধু শেখ ফজলুল হক মণিকে এগুলো দিয়েছিলেন আত্মজীবনী ছাপানোর কথা চিন্তা করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণ করায় তা আর করতে পারেননি। কাজটা অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিল।

'কারাগারের রোজনামচা'র ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুর খাতাগুলো উদ্ধারের প্রথম দিকের আরও কিছু ঘটনা জানা যায়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা ও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং কারাগারে বন্দি করে রাখে। সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর দমন-পীড়ন ও পোড়ামাটিনীতি এবং গণহত্যা শুরু করে। এরই এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবার এক মাসে ১৯ বার জায়গা বদল করেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পায়নি, তারা ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, পুত্র লে. শেখ জামাল, কন্যা শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ড. ওয়াজেদ, শেখ রেহানা এবং পুত্র শেখ রাসেলকে ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডের একটি একতলা বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এক সময় পাকিস্তানি হানাদার শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) ঘোষণা দিল যে সবকিছু স্বাভাবিক আছে। এসময় তারা বাচ্চাদের স্কুলে যেতে বলে। স্কুলে যেতে হলে তো বই-খাতা প্রয়োজন। সেগুলো ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যে মেজর স্কুলে যেতে বলেছিলেন তার কাছে একথা বলায় সে ৩২ নম্বরের বাসায় নিয়ে যেতে রাজি হলো। আর সেখানই খাতাগুলো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পেয়েছিলেন। তার কথায়, 'আমি মায়ের কথামতো জায়গায় গেলাম। ড্রেসিং রুমের আলমারির উপর ডান দিকে আব্বার খাতাগুলো রাখা ছিল, খাতা পেলাম ...।'

বঙ্গবন্ধুর লেখা এই খাতা উদ্ধার ছিল বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসার প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। বঙ্গবন্ধু যতবার জেলে যেতেন বেগম মুজিব খাতা, কলম দিতেন লেখার জন্য। বারবার তাগাদা দিতেন। আবার বঙ্গবন্ধু যখন জেল থেকে ছাড়া পেতেন তখন বেগম মুজিব জেল গেটে যেতেন বঙ্গবন্ধুকে আনতে আর বঙ্গবন্ধুর লেখাগুলো যেন আসে তা নিশ্চিত করতেন।

বেগম মুজিব এগুলো অতি যত্নে সংরক্ষণ করতেন। যা হোক, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে অনেক ঝুঁকি নিয়ে খাতাগুলো উদ্ধারের পর সেগুলো ঢাকার আরামবাগে বঙ্গবন্ধুর আর এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেশ শত্রম্নমুক্ত হওয়ার পর এই আত্মীয়রা বেগম মুজিবের হাতে খাতাগুলো পৌঁছে দিয়েছিলেন। এগুলো বৃষ্টির পানিতে কিছু নষ্ট হলেও মূল খাতাগুলো মোটামুটি ঠিক ছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি জিয়া সরকার তখন সিল করে রেখেছিল। ১৯৮১ সালের ১২ জুন সাত্তার সরকার বঙ্গবন্ধুর কন্যার নিকট বাড়িটা হস্তান্তর করে। তখন বঙ্গবন্ধুর লেখা স্মৃতিকথা, ডায়েরি ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো তিনি পান। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনীর' ভূমিকায় বলেন, 'আত্মজীবনী লেখা খাতাগুলো পাইনি। কিছু টাইপ করা কাগজ পাই যা উইপোকা খেয়ে ফেলেছে। ফুলস্কেপ পেপারের অর্ধেক অংশই নেই শুধু উপরের অংশ আছে। এসব অংশ পড়ে বোঝা যাচ্ছিল, এটি আব্বার আত্মজীবনীর পান্ডুলিপি, কিন্তু যেহেতু অর্ধেকটা নেই সেহেতু কোনো কাজেই আসবে না।' প্রথম বই 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'।

'আমার দেখা নয়াচীন' বইয়ের ভূমিকা লেখা হয়েছে ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালে চীন ভ্রমণ করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার পর বঙ্গবন্ধু যখন সমগ্র পূর্ববঙ্গে সফর করছিলেন তখন ফরিদপুর গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পেয়ে আবারও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে আবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রম্নয়ারি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে কারাবন্দি থাকাকালে বঙ্গবন্ধু তার খাতায় লিখেছিলেন ১৯৫২ সালের চীন ভ্রমণের কাহিনি। খাতার ওপর গোয়েন্দা সংস্থার সেন্সর করার এবং কারা কর্তৃপক্ষের যে সিল দেওয়া আছে তা থেকেই সময়কালটা জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর এই তিনটি বইয়ের পান্ডুলিপি তথা খাতাগুলো কীভাবে রক্ষা পেয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেগুলো কীভাবে খুঁজে পেয়েছেন সেকথা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' এবং 'কারাগারের রোজনামচা'র ভূমিকায় বিস্তারিত লেখার কারণে তা' 'আমার দেখা নয়াচীন'-এর ভূমিকায় লেখা হয়নি।

প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: সভাপতি, কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন ফাউন্ডেশন (সিটিইএফ), বাংলাদেশ চ্যাপ্টার; পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল; সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য-সচিব, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<107873 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1