শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি ও বেসরকারি পযাের্য়র শিক্ষাব্যবস্থা

প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের দাপটে আজ যেন মেরুদÐই ভেঙে যাচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর। স্থানীয় অনেক অভিভাবকদের অভিযোগ রয়েছে সরকারি প্রাথমিকের লেখাপড়ার মান ভালো নয় তাই সন্তানদের প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ান। এই মান দেখার জন্য যে কতার্ব্যক্তি রয়েছেন তিনি কি জানেন এই সমস্যাগুলো?
মো. ওসমান গনি
  ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

শিক্ষা মানবজীবনের একটি মৌলিক চাহিদা। শিক্ষা ছাড়া কোনো মানুষ বা জাতি উন্নতির শিখরে আরোহন করতে পারে না। শিক্ষা যে শুধু দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন, তা নয়। একজন মানুষ কে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে তার জীবনে প্রথম প্রয়োজন শিক্ষা। কারণ শিক্ষাই পারে একজন সুস্থ সবল দেহের অধিকারী জ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ গড়ে তুলতে। দেশের মানুষ কে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেব গড়ে তুলতে হলে তাকে সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। দেশের শিক্ষিত নাগরিক দেশের সম্পদ। তাই দেশের উন্নয়নে সবার আগে চাই শিক্ষা। আমাদের দেশে এমন সময় ছিল স্কুলের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ওই সময় মানুষ কে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য অনেক দূরদূরন্তের স্কুলে হেঁটে যেতে হতো। কাছাকাছি কোনো স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা ছিল না। প্রতিষ্ঠানগুলোতো সে সময় পড়ার জন্য ছাত্র/ছাত্রীদের মারধর করা হতো। তারপর ও মানুষ লেখাপড়া করেছে। আজকে যারা দেশ পরিচালনা করছেন তাদের অনেকের জীবনেই এ ধরনের ঘটনা ছিল। কিন্তু আজকে আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এসেছে ব্যাপক পরিবতর্ন। দেশের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে এখন প্রাইমারি স্কুল, আবার কোনো কোনো গ্রামে হাই স্কুল ও কলেজ রয়েছে। শিক্ষার জন্য যাতে কোনো মানুষ দূরে যেতে না হয় সেই অসুবিধা দূর করার জন্য সরকার দেশের প্রতিটি গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করছে। যাতে করে দেশের কোনো মানুষ শিক্ষার বাহিরে না থাকে। দেশের প্রতিটি ছেলে-মেয়ে যাতে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে সে জন্য এ ব্যবস্থা। দেশের প্রতিটি ছেলে-মেয়েকে শিক্ষার আওতায় আনার জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করছে। কোনো কোনো স্কুলে ছোট ছেলে-মেয়েদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু আমাদের দেশের একশ্রেণির অসাধু লোক শিক্ষার মানকে ধ্বংস করার জন্য সরকারি স্কুলের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করছে ব্যবসার জন্য। যেগুলোতে শিক্ষার চেয়ে টাকার প্রাধান্যই থাকে বেশি। তারা বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে অভিভাকদের কে আকষর্ণ করে থাকে। যাতে করে অভিভাবকরা তাদের প্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য ভতির্ করে থাকে।

আজ আর স্কুল দূরে নয়, বাড়ি থেকে খানিক দূরেই একাধিক স্কুল। তাই সেই আনন্দ-বেদনাগুলো এখন ফিকে হয়েছে। ক্লাসে পড়া না পারলে শিক্ষক ছেলে-মেয়েদের বেত দিয়ে মারতেন, মানুষ হওয়ার জন্য। বাড়ি ফিরে জামা খুললেই মা সবার আগে দেখে কঁাদতেন আর বুঝাতেন বাবা ভালো করে পড়িস তোর গায়ের ব্যথা যে আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। মায়ের আকুতি ভরা কান্নার আড়ালে সান্ত¡না ছিল একটাই শিক্ষক তার ভালোর জন্যই মেরেছে। মায়ের কথায় ছেলে-মেয়েরা পড়ায় মন দিলেও বাবার আত্মা শান্তি পেত না, ছেলে-মেয়েকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করতে কোথায় ভালো শিক্ষক আছেন খুঁজে বেড়াতেন, খবর পেলেই নিয়ে যেতেন শিক্ষকের কাছে পড়াতে। এভাবে অনেক বাবাই তার নিজের স্বপ্ন ছেলে-মেয়েদের দিয়ে পূরণ করেছেন। নতুন সাইকেল কিনে বাবা সারপ্রাইজ দিতেন। আবার অনেক ছেলে-মেয়ে নিজের উদ্যোগে লেখাপড়া শিখে অনেক বিখ্যাত হয়েছেন। ডিজিটাল যুগে বাবা-মায়ের সেই ভালোবাসা আর দেখা যায় না। স্কুলের শিক্ষক এখন আর ছাত্র/ছাত্রীদের মারেন না। সব কিছুতেই কেমন একটা আলগা আলগা মনে হয়। ছেলেদের সঙ্গে এখন মেয়েদের ও লেখাপড়ায় অংশগ্রহণ বেড়েছে। ঘরের কাজ যে মেয়েদের প্রাত্যহিক কাজ ছিল সেই মেয়েরা এখন অফিসের বস, সরকারের গুরুত্বপূণর্ পদে নারীদের সরব অংশগ্রহণ যা বতর্মান সরকারের নারীর ক্ষমতায়নের ইতিবাচক ফল।

সরকার নিয়ম করেছে শিক্ষাথীের্দর শারীরিক ও মানসিক প্রহার করা যাবে না। এটা মেনেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের পাঠ কাযর্ক্রম পরিচালনা করছে। সন্তানের গায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখে মাকে আর কঁাদতে হয় না। তবে আজও বাবাদের খুঁজতে হয় ভালো শিক্ষক কিংবা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এখানেই খঁুজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে অনেক দুঃখজনক ঘটনা, এটাকে প্রতারণাও বলা চলে। সরকারি প্রাথমিক কিংবা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর এখন আর বাবা-মা আস্থা রাখতে পারেন না। তাই দেশসেরা কিছু ক্যাডেট কোচিং নামধারী নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবকদের ধরনা দিতে দেখা যায়। বেশির ভাগ অভিভাবক এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের ভতির্ করিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায় যে তাদের সন্তান সুশিক্ষা আর ভালো মানুষ হতে পারবে। কিন্তু কিছু ঘটনা তাদের চোখের পদার্ খুলে দেয়। আসলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামে বড় হলেও, এখানে শিক্ষকতা করেন উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা সম্মান এ অধ্যয়নরত শিক্ষাথীর্রা। যাদের পাঠদানের ন্যূনতম প্রশিক্ষণ নেই। কথা হলো এসব শিক্ষকদের দিয়ে কতখানি উন্নয়ন হবে শিক্ষাথীের্দর যে শিক্ষক নিজেই লেখাপড়া শেষ করেনি। আর এই শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতো আরও দুবর্লতা প্রকাশ করে। দুই হাজার থেকে পঁাচ হাজার মাসিক বেতনের শিক্ষক দিয়েই চলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রশ্ন হলো শিক্ষা অফিসার কিংবা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কমর্কতার্রা কি এগুলোর খবর রাখেন? নাকি দেখেও না দেখে থাকেন? উত্তর এই দুটির যে কোনো একটি হলে বুঝতে হবে এ জাতি শিক্ষার দুনিয়ায় পিছিয়ে পরতে আর বেশি বাকি নেই। কাউকে ছোট বা অপমান করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। এবার জানতে হবে এসব কোচিং স্কুলে স্টুডেন্টদের মাসিক বেতন কত? প্রতিটি স্কুলে গড়ে বেতন ১২০০-১৮০০ টাকা যেখানে প্রতি ক্লাসে স্টুডেন্ট থাকে ২০ জন। সুতরাং হিসাব পরিষ্কার এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় শিক্ষা নয় বিজনেস করতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে পকেট কাটা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। অনেক বাবার স্বপ্নের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। তাহলে কেন এসব স্কুলের বিরুদ্ধে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতার্ব্যক্তিরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা হচ্ছে না? তাহলে কি আমরা ধরে নেব প্রশাসন এদের খবর রাখেন না?

একটি প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে ১৫০০ শিক্ষাথীর্ হলেও সরকারি প্রাথমিকে খুব বেশি হলে ৩০০-৪০০ জন। এই অনুপাত এটাই নিদের্শ করে যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যথর্তাই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার জন্য দায়ী। সরকার এত টাকা খরচ করে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ভবন, মাঠ, শিক্ষকদের উচ্চ বেতন, উপবৃত্তিসহ আরও কত কমর্কাÐে বড় অঙ্কের বাজেট দিতে হয় অথর্মন্ত্রীকে, আর সেই টাকার জোগান আসে নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকা থেকে। গত দুই বছরে ট্যাক্স বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রশ্ন হলো পঁাচটি সরকারি প্রাথমিকের থেকেও বেশি স্টুডেন্ট একটি প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে ভতির্ হয়? তাহলে কি বলব প্রশাসন দেখেও না দেখে থাকে? এই দুটি উত্তরই আমাদের প্রাণপ্রিয় জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন যে উন্নত ডিজিটাল দেশ তাকে বাধাগ্রস্ত করে।

সরকারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সরকারি খরচে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এতে করে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। সরকারি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরাই জানে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া দেয়া আর তাদের থেকে পড়া আদায় করার কৌশল। প্রশিক্ষিত এই শিক্ষকদের স্কুলে শিক্ষকতা করতে নিয়োজিত করে এবং রাষ্ট্র তাদের জন্য উচ্চ বেতন প্রদান করে পক্ষান্তরে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে দুই হাজার টাকার বেতনের শিক্ষক যাদের কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই তারা পাঠদান করে, যারা নিজেরাই স্টুডেন্ট! স্কুলের শিক্ষাথীর্ বৃদ্ধি করতে, সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? যদি দায়িত্ব থাকে তাহলে এই ব্যথর্তা কি দায়িত্ব অবহেলাকেই নিদের্শ করে না? কেন অভিভাবকরা সরকারি প্রাথমিকে তার সন্তানকে পড়তে দিচ্ছেন না আর কেনইবা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটছেন এর কারণ বের করতে হবে প্রাথমিকের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কতার্ব্যক্তিদেরই। গোড়ায় গলদ রেখে সামনে এগোলে সত্যিই কি আমরা এগোতে পারব? সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ব্যথর্ হলে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের অবমাননা হয়, তা বুঝতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।

প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের দাপটে আজ যেন মেরুদÐই ভেঙে যাচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর। স্থানীয় অনেক অভিভাবকদের অভিযোগ রয়েছে সরকারি প্রাথমিকের লেখাপড়ার মান ভালো নয় তাই সন্তানদের প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ান। এই মান দেখার জন্য যে কতার্ব্যক্তি রয়েছেন তিনি কি জানেন এই সমস্যাগুলো?

উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রধান করে সব সরকারি প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে একটি শিক্ষা কমিশন হতে পারে। এই কমিশন প্রতিটি উপজেলার প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্টুডেন্ট সংগ্রহ করবে যেন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মেরুদÐ সোজা করে দঁাড়াতে পারে। কি এমন মন্ত্র জানে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা পিটিআইর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা জানেন না? তা খুঁজে বের করতে হবে এই কমিশনকে। প্রয়োজনে পিটিআই এর প্রশিক্ষণকে আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। প্রতি মাসে কমিশন উন্নয়ন রিপোটর্ প্রদান করবে জেলা শিক্ষা কমর্কতাের্ক যা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করে সাধারণ নাগরিকদের জানানো হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা শিক্ষার অঁাতুরঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে ঘুণ ধরেছে তা দূর করে মেরুদÐ সোজা করে দঁাড়াতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সহযোগিতা করবে। দূর হবে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য, নজরদারি বাড়াবে প্রশাসন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে শিক্ষায় উন্নত এই প্রত্যাশা প্রতিটি নাগরিকের। এলাকার সচেতন মহলকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলে-মেয়ের ভতির্র ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির লোকজনকে সবসময় বিদ্যালয় তদারকি করার মনমানসিকতা তৈরি করতে হবে।

মো.ওসমান গনি: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<11004 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1