শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ হত্যালীলার শেষ কোথায়

আমরা কি ভাবতে পারি না আজ জীবন না বঁাচলে চাকরিই বা কী? কোটা প্রথা থাকাই বা না থাকাই কী? জীবনের নিরাপত্তা বিধান করতে, সবার জন্য বেঁচে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করতে সব ধরনের উগ্রতার বিরুদ্ধে এক প্রবল জোয়ার, ঢেউয়ের কলরোল, জলোচ্ছ¡াস, সাইক্লোন, গণআন্দোলনের প্রয়োজন সবাের্গ্র। যুবসমাজকেই নিতে হবে সেই জোয়ার গড়ে তোলার দায়িত্ব। ঘটাতে হবে এর সমাপ্তি।
রণেশ মৈত্র
  ৩০ জুন ২০১৮, ০০:০০

বেশ অনেক দিন থেমে ছিল। অন্তত এমন ধরনের হত্যালীলা যা ২০১৫-তে অভিজিৎ রায়ের নিমর্ম হত্যালীলা দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং পরপর কয়েকজনকে তাদের ভাষায় ‘নাস্তিক’-কে কুপিয়ে হত্যা করার খবর বোধ হয় তেমন নাস্তিক, বøগার, প্রকাশক হত্যার কোনো খবর আমরা পাব না। দুই বছরের মতো তেমনটি না ঘটায় এমন ধারণাই পোষণ করছিলাম মনে মনে।

ইন্টারনেটে দেশের খবর ঢাকার পত্রপত্রিকাগুলোতে দেখতেই চোখে পড়ে গেল মুন্সীগঞ্জের একজন বিশিষ্ট গুণীব্যক্তি, একটি প্রকাশনার মালিক, যিনি দীঘির্দন ধরে দেশের প্রখ্যাত কবিদের কবিতার বই প্রকাশ করে আসছিলেন সেই শাহজাহান বাচ্চুকে অকস্মাৎ ঝড়ের গতিতে এসে তার বাড়ির কাছে গুলি করে চলে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন। ক্ষতিটা কার হলো?

শাহজাহান বাচ্চুকে কোনো দিন দেখিনি। আলাপও হয়নি কোনো দিন। কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনাই তার সঙ্গে যেন গভীর এক আত্মীয়তার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পকর্ গড়ে দিল।

শাহজাহান বাচ্চু একজন প্রকাশকই শুধু ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলার কমিউনিস্ট পাটির্র সাবেক সাধারণ সম্পাদক। এ দেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। তার দলের ভ‚মিকা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিল গৌরবোজ্জ্বল। এই উপমহাদেশের নানা সংগ্রাম, লড়াই, আন্দোলনে তার ও তার দলের ভ‚মিকা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিল গৌরবোজ্জ্বল। এই উপমহাদেশের নানা সংগ্রাম লড়াই আন্দোলনে তার ও তার পূবর্সূরিদের ভ‚মিকাও ছিল ঐতিহাসিক। এমন একজন প্রগতিশীল যোদ্ধাকেও আমরা হারালাম।

একই দিন অপরাহ্ণে একটি টিভি চ্যানেলের প্রচারিত খবরে আরও জানতে পারলাম চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা বলাকা প্রকাশনার মালিক, সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিনকে মোবাইল ফোনে প্রতিনিয়ত হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। যেন মানুষ মারা, মানুষকে হত্যা করা, প্রাণনাশের হুমকি দেয়া ডাল-ভাত মাত্র। এসবই যেন মানুষের গা সহা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

শাহজাহান বাচ্চু তার নিজ গ্রাম মুন্সীগঞ্জ জেলার কাঙ্গালদী গ্রামের মোড়ে এলে অকস্মাৎ দুটি মোটরসাইকেলে চারজন ছুটে এসে তার বুকে ঠিকমতো তাক করে গুলি ছুড়ে নিমেষেই উধাও হয়ে যায়। শাহজাহান বাচ্চু ঘটনাস্থলেই মারা যান।

তার মেয়ে দুবার্ জাহান ফেসবুকে তৎক্ষণাৎ একটি পোস্ট দেন ‘আমার বাবা শাহজাহান বাচ্চুকে আমাদের গ্রামেই কারা যেন গুলি করে মেরে গেছে।’

তার এক বন্ধু ওই পোস্টে কমেন্ট দিয়ে বলেন, ‘উনি দোকানে বসেছিলেন। মোটরসাইকেলে করে দুজন ফোনে অপিরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে খবরটি জানিয়ে দেয় তার বাবার মৃত্যুর সংবাদ। তারপর দুবার্ তার বাবার নম্বরে ফোন করলে একজন পুলিশ কমর্কতার্ ফোনটি রিসিভ করেন। এভাবেই জানাজানি হয়।

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল সমিতির সাবেক সভাপতি আজহারুল ইসলাম বলেন, বাংলাবাজারের প্রকাশনা সংস্থা বিপাসা প্রকাশনা নিয়মিত কবিতার বই প্রকাশ করত। প্রকাশনাটি নিমের্লন্দু গুণ, মহাদেব সাহার মতো প্রখ্যাত কবিদের কাব্যগ্রন্থ বের করত। প্রকাশক হিসেবে সজ্জন ছিলেন বাচ্চু।

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল সমিতির সভাপতি ফরিদ আহ্মেদ জানান, বিপাসা প্রকাশনী তাদের সমিতির সদস্য ছিলেন।

তিন বছর আগেকার কথা। ঢাকার জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে ও তার প্রকাশনা কাযার্লয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেটা ছিল ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস।

এভাবে এ পযর্ন্ত দুজন প্রকাশক প্রাণ হারালেন। আজিজ সুপার মাকেের্ট খুন হওয়া দীপনের অপরাধ ছিল তিনি প্রখ্যাত মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করেছিলেন। ওই বছরেই ফেব্রæয়ারিতে একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে সন্ধ্যারাতে অসংখ্য মানুষের ভিড়ের মধ্যে কুপিয়ে অভিজিৎ ও তার সমমনা সহযোদ্ধা সহধমির্নীকেও একইভাবে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। গুরুতর আঘাতে আহত হলেও ঢাকায় ও আমেরিকায় চিকিৎসা নিয়ে অভিজিতের স্ত্রী মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান।

অভিজিৎ, অতঃপর দীপন এবং তারপর একে একে বøগার হিমাদ্রি নিলয়, অনন্ত বিজয় দাস ও অনলাইন একটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমানকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়। তারপরেও ঘটেছে এমন হত্যাকাÐ।

শাহজাহান বাচ্চুকে হত্যাকারীদের সন্ধান এই লেখা শেষ হওয়া পযর্ন্ত জানা যায়নি। তবে তার সহধমির্নী সংশ্লিষ্ট থানায় চারজন অভিযুক্তির নাম উল্লেখ করে এজাহার জমা দিয়েছেন বলে জানা যায়।

পুলিশ কতৃর্পক্ষ জানিয়েছেন, তারা এই মামলার তদন্ত কাজ শুরু করেছেন তবে তাদের সন্দেহ, জঙ্গিরাই এই হত্যালীলা ঘটিয়ে থাকবে। জঙ্গিবাহিনী আনসার-আল-ইসলাম না কি অন্য কোনো গ্রæপ তা এখনই সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। অতীতে যে সব জঙ্গি বøগার বা মুক্তমনা লেখক প্রকাশকদের হত্যা করেছে তাদের হত্যার ধরন ছিল কুপিয়ে হত্যাÑ কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়Ñ তারা গুলি করে হত্যা করেছে। শাহজাহান বাচ্চুর এই হত্যা যে পূবর্পরিকল্পিত ও সংগঠিত তা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। হত্যাকারীরা এসেছে দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে- সংখ্যায় ছিল চারজন। তারা যাওয়ার আগে বিস্ফোরক ফুটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলে যায়। তাদের টাগের্ট ছিল বাচ্চু।

শাহজাহান বাচ্চু ছিলেন বহু গুণের অধিকারী। তিনি একাধারে কবি, সাংবাদিক, লেখক, প্রকাশক, রাজনৈতিক কমীর্ ও দেশপ্রেম ব্যক্তিত্ব। তাদের একটি সংগঠন ছিল শুদ্ধচচার্র উদ্দেশ্যে। তাতে নিয়মিত আলোচনা হতো ধমর্ নিয়ে। বহু ভক্ত জুটেছিল তার। (মুন্সীগঞ্জের) শহরে ও গ্রামে তার জনপ্রিয়তাও ছিল প্রচুর। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানকার সব শ্রেণির মানুষ তার অকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্র তার বাড়িতে ছুটে আসেন, প্রতিবাদে মুখর হয় এবং পরদিনই প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হন এবং বের করেন মশাল মিছিল। এমনটি সচরাচর চোখে পড়ে না।

শাহজাহান বাচ্চু তিন-চার বছর আগে থেকেই প্রাণনাশের হুমকিতেও ছিলেন। কিন্তু তিনি ভয় পাননি। তার মেয়ে দুজন ও স্ত্রী তেমনটাই জানিয়েছেন সাংবাদিকদের। হুমকি একবার দুবার নয়Ñ বহুবার দেয়া হয়েছে তাকে। জঙ্গিদের একটা হিট লিস্ট পুলিশ জানতে পেরেছিল। সেই তালিকায় বাচ্চুর নাম ছিল ১১ নম্বরে। তালিকায় আরও যাদের নাম আছে তা আমার জানা নেই। তবে তাদের সবাইকে রীতিমতো নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব পুরোপুরি রাষ্ট্রের।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত সবের্শষ খবরে বলা হয়েছে, শাহজাহান বাচ্চুকে হত্যার ৩-৪ দিন আগেও হুমকি দেয়া হয় এবং এই বারে তিনি উদ্বিঘœ বোধ করেন। তার দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী থাকেন ঢাকায় এবং দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে। বাচ্চুও ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। শেষ হুমকি পাওয়ার পর তিনি পৃথক রুমে না থেকে পাশের যে রুমে তার দ্বিতীয় স্ত্রী তার মেয়েসহ থাকতেন সেখানেই থাকা শুরু করেন। বাইরে চলাফেরাও যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে দেন। যারা হত্যাকারী তার ‘ইসলাম জঙ্গী’ বলে পুলিশের সন্দেহ। মুন্সীগঞ্জের মানুষও তাই মনে করেন। কারও সঙ্গেই বাচ্চুর কোনো বিরোধ ছিল না। কেউ তার শত্রæ ছিল না। পারিবারিক কোনো বিরোধের খবর কোনোদিন জানা যায়নি। একটি অত্যন্ত ভদ্র এবং মিলমিশ সম্পন্ন পরিবার ছিল তার। পোশাক-আশাক-চলন-বলনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে।

ধমের্র নামে যে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি সম্পূণর্ বিরোধী হওয়ায় জঙ্গিদের বিবেচনায় শাহজাহান বাচ্চু ছিলেন একজন ‘নাস্তিক’। ব্যস, আর যত গুণই থাকুক, ওই তথাকথিত ইসলামপন্থিদের টাগের্ট হয়ে জীবন তাকে দিতেই হলো। ধমর্, সমাজ, কাব্য, সাহিত্য, রাজনীতি, অথর্নীতি সম্পকের্ তার বিপুল জ্ঞান, সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তার পরিচিতি, তার নিষ্ঠা, সততা ইত্যাদি কোনো কিছুই ওই পিশাচদের কাছে ন্যূনতম বিবেচ্য ছিল না। তারা সংহারকের ভ‚মিকায় ঠিকই অবতীণর্ হলো।

সমাজে দুনীির্তবাজরা প্রবল প্রতাপে ঘুরে বেড়ায়, ঘুষখোরেরাও তাই। চোর, ডাকাত, খুনি, ধষর্ক কারও নিরাপত্তার অভাব নেই। কোনো প্রকার হুমকিও নেই। ওই পাষÐ ইসলামের নামে ভঁাওতা প্রদানকারী নিষ্ঠুর, ববর্র জঙ্গিদের তরফ থেকে তাদের অস্ত্র তাদের হুমকি সৎ লোকের বিরুদ্ধে, দুনীির্তবিরোধী, ঘুষবিরোধী চোর, ডাকাত, খুনি, ধষর্কদের বিরুদ্ধে কদাপি উদ্যত হয় না, কোনো নিন্দাবাদও না।

অজস্র মৃত্যুর মিছিল আজ আমাদের বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, শত সহস্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পীঠস্থান বাংলাদেশে, ভাষা আন্দোলনের সুমহান ঐতিহ্যমÐিত বাংলাদেশে চারদিকে দেখা যায় শুধু মৃত্যুরই কারবার। রক্তের হোলিখেলা দেখছি নিত্যদিন। বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচার বহিভ‚র্ত হত্যালীলা, সড়ক দুঘর্টনায় অজস্য প্রাণহানি অজস্র খুন, নানা অজুহাতে চলছে অবিরাম। এ মৃত্যু অস্বাভাবিক, অসহনীয় এবং কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।

রাষ্ট্রের ও সমাজের দায়িত্ব এই মৃত্যুকে রুখে দেয়ার, প্রতিরোধ করার। কিন্তু বøগাররা, মুক্তমনারা জ্ঞানী দায়িত্বশীল, শান্তিকামী জনগোষ্ঠী একের পর নিহতই হচ্ছেন রাষ্ট্র যেন তার অসহায় দশর্ক, সমাজ যেন নীরব নিবার্ক। কোনো ব্যবস্থা নেই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে। মামলা-মোকদ্দমা ঠিকই দায়ের হয়। তদন্ত কাজও শুরু হয় কিন্তু শেষ হয় না তদন্তের। অনন্তকাল ধরে চলে ওই তদন্ত। তাই বিচার হয় না আদালতে। আইনও সেখানে স্তব্ধ।

আন্দোলন? যুব সমাজ? মনে হয় অতিশয় বিভ্রান্তি। অতিমাত্রায় নিঃস্পৃহ দেশকে সুন্দর করে গড়ে তোলার কাজে। অসুন্দরকে পরাজিত করার কাজে। তাই সভ্যতা সংস্কৃতি, শিশু, সংগীত, নৃত্য, কাব্য-সাহিত্য, বিজ্ঞান সবই যেন বিদায় নিতে বসেছে, উধাও হতে চলেছে প্রিয় বাংলাদেশ থেকে।

আমরা কি ভাবতে পারি না আজ জীবন না বঁাচলে চাকরিই বা কী? কোটা প্রথা থাকাই বা না থাকাই কী? জীবনের নিরাপত্তা বিধান করতে, সবার জন্য বেঁচে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করতে সব ধরনের উগ্রতার বিরুদ্ধে এক প্রবল জোয়ার, ঢেউয়ের কলরোল, জলোচ্ছ¡াস, সাইক্লোন, গণআন্দোলনের প্রয়োজন সবাের্গ্র। যুবসমাজকেই নিতে হবে সেই জোয়ার গড়ে তোলার দায়িত্ব। ঘটাতে হবে এর সমাপ্তি।

রণেশ মৈত্র: সভাপতিমÐলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে