শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক দুঘর্টনা প্রতিরোধে করণীয়

ঈদের আগে যেসব চালক দিন-রাত গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত হয়েছেন তাদের অনেকেই এখন বিশ্রামে আছেন; যে কারণে অনেক যানবাহন চালাচ্ছেন অদক্ষ শ্রমিক। যাদের অনেকের লাইসেন্স পযর্ন্ত নেই। ফলে রাস্তায় দুঘর্টনাও বেড়েছে।
মো. ওসমান গনি
  ৩০ জুন ২০১৮, ০০:০০

আমাদের সড়ক-মহাসড়কের সবর্ত্রই চলছে বিশৃঙ্খলার মহোৎসব। এতে প্রাণ যাচ্ছে একের পর এক। এভাবেই কি দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে মানুষের মৃত্যুর বিভীষিকা চলতে থাকবে? দেশে এত বেশি সড়ক দুঘর্টনা ঘটছে যে, দুঘর্টনা রোধে হালে বিশেষ বাহিনী গঠনের দাবি উঠছে। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি র‌্যাব বাহিনী গঠন করা যায়, দুঘর্টনা রোধে এ-জাতীয় বাহিনী নয় কেন? কোনোভাবেই তা রোধ করা যাচ্ছে না। সরকারি ও বেসরকারিভাবে সড়ক দুঘর্টনা বন্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবে কাযর্কর করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশের গাড়ি চালকের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা, অতি দ্রæত গতিতে গাড়ি চালানো, ওভারটেক করাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে সড়ক দুঘর্টনার হার বেড়ে যাচ্ছে। আর এই দুঘর্টনার শিকার হয়ে আমাদের দেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সড়ক দুঘর্টনায় প্রাণহানির দিক থেকে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বিশ্বের মধ্যে ১৩তম। বাংলাদেশের উপরে আছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। কিন্তু দেশগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য ১ হাজার ১৩৩ যানবাহন রয়েছে, চীনে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৮ হাজার, ভারতে প্রায় ১৩ হাজার আর পাকিস্তানে পঁাচ হাজার। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি দুজনে একটি করে যানবাহন রয়েছে। অথচ এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক দুঘর্টনার মাত্রা বেশি।

এই প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুঘর্টনা অধেের্ক নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মহাসড়কে ২৬০টির বেশি ঝুঁকিপূণর্ বঁাক আজও সরলীকরণ হয়নি। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়নি। ৩২ লাখ রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত গাড়ির বিপরীতে অবৈধচালকের সংখ্যা প্রায় অধের্ক। সড়ক-মহাসড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান রাজনৈতিক কারণে করা সম্ভব হয় না। বিচার হয় না দুঘর্টনার জন্য দোষী চালকের। এই প্রেক্ষাপটে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে সত্যিই কঠিন তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত তিন কারণে সড়ক দুঘর্টনা হচ্ছে। ওভারস্পিড, ওভারটেকিং, যান্ত্রিক ও রাস্তার ত্রæটি। এ ছাড়া সড়ক দুঘর্টনা হ্রাস না পাওয়ার পেছনে রয়েছে নানা কারণ। চালকের লাইসেন্স প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে যানবাহনের ফিটনেস সনদ, গাড়ির অনুমোদন, সড়কের ত্রæটি, সঠিক তদারকির অভাবসহ সব ক্ষেত্রেই রয়েছে গলদ।

সড়ক দুঘর্টনা রোধে বিভিন্ন সময়ে নানামুখী পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবায়ন গতি খুবই কম। এ নিয়ে প্রতি বৈঠকে হইচই হয়। কিন্তু কাজ হয় না। এটি এখন আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে দঁাড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, রাজনৈতিক স্বাথর্ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করলে কখনই সড়ক দুঘর্টনা হ্রাস পাবে না।

মোট সড়ক দুঘর্টনার ৫৩ শতাংশ দুঘর্টনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি। এদিকে সুনিদির্ষ্ট সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে জাতিসংঘ ঘোষিত ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সড়ক দুঘর্টনা অধেের্ক নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

উন্নত দেশগুলোয় সড়ক দুঘর্টনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা খুবই সুনিদির্ষ্ট হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দায়সারা গোছের। কত বছরে কি পরিমাণ দুঘর্টনা ও প্রাণহানি কমানো হবে। কীভাবে তা অজির্ত হবে, কারা তা সফল করবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার।

স্বল্প ব্যয়ে ফুটপাথ, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারপাস নিমার্ণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে প্রাণহানি অধেের্ক নামিয়ে আনা সম্ভব। ৫৩ শতাংশ দুঘর্টনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি। গতি নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে ছোট যানবাহন বন্ধ ও বেপরোয়া যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরী।

এ ছাড়া এখনও দেশের সড়ক-মহাসড়কে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে ১০ লাখ নছিমন-করিমন-ইজিবাইক। অবাধে আমদানি হচ্ছে অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, ইজিবাইক। দেশব্যাপী ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, কভাডর্ভ্যান, হিউম্যান হলার অবাধে চলছে। নিবন্ধনবিহীন ৪ লাখ অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে সড়ক-মহাসড়কে। এসব যানবাহন সড়ক দুঘর্টনার প্রধান উৎস।

আইন প্রয়োগের দুবর্লতা সড়ক দুঘর্টনা না কমার একটি বড় কারণ। সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা। চালক-মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব এই সেক্টরকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে। সরকার সড়ক নিরাপত্তায় জনবান্ধব যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে তারা বাধা হয়ে দঁাড়াচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সড়ক নিরাপত্তা আজ মারাত্মক হুমকির মুখে।

অ্যাকশন প্ল্যানের ভ‚মিকায় বলা হয়, প্রতি বছর দেশে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। পুলিশের পঁাচ বছরের হিসাব অনুযায়ী, সড়ক দুঘর্টনায় প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ২৮০ জনের মৃতুু হয়। সড়ক দুঘর্টনার প্রধান কারণ হলো ওভারস্পিড, ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং। আবার একই সড়কে ছোট-বড়, ধীরগতি ও অতি গতি এবং অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচলের কারণেও সড়কে দুঘর্টনা ঘটছে। এ ছাড়া ট্রাফিক আইন সম্পকের্ অসচেতনতা ও প্রয়োগের দুবর্লতাও দুঘর্টনার কারণ। এ ছাড়া সড়কে দুঘর্টনার প্রকৃত তথ্য নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরনের তথ্য প্রকাশ করে।

বতর্মান সময়ে সড়ক দুঘর্টনার জন্য ৯টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি, স্থানীয়ভাবে তৈরি দেশীয় ইঞ্জিনচালিত ক্ষুদ্রযানে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, বিধি লঙ্ঘন করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং, জনবহুল এলাকাসহ দূরপাল্লার সড়কে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, দীঘর্ক্ষণ বিরামহীন গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূণর্ বঁাক ও বেহাল সড়ক, ত্রæটিপূণর্ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ। সড়ক দুঘর্টনা বন্ধ করতে হলে সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গাড়ির চালক, মালিক পক্ষসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যতক্ষণ পযর্ন্ত দেশের মানুষ সচেতন না হবে ততক্ষণ সড়ক দুঘর্টনা আইন করে রোধ করা যাবে না। সবার আগে আমাদের সবার মন-মানসিকতার পরিবতর্ন ঘটাতে হবে। দুঘর্টনার কারণে একদিকে চলে যায় মানুষের প্রাণ আর অপরদিকে অথৈর্নতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাড়ির মালিক। নষ্ট হয় দেশের সম্পদ।

গত ২৩ জুন দেশের সাত জেলায় সড়ক দুঘর্টনায় ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সবোর্চ্চ নিহতের ঘটনা ঘটেছে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে। সেখানে বাস উল্টে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া রংপুর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নাটোর, গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা ও সাভারের আমিনবাজারে সড়ক দুঘর্টনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুঘর্টনা ঘটছে। এর দুই দিন আগে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে পঁাচজন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো ৩০ জন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও সরব হয়ে উঠেছে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে অনেকেই সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের কাছে দাবি তুলেছেন।

ঈদের আগে যেসব চালক দিন-রাত গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত হয়েছেন তাদের অনেকেই এখন বিশ্রামে আছেন; যে কারণে অনেক যানবাহন চালাচ্ছেন অদক্ষ শ্রমিক। যাদের অনেকের লাইসেন্স পযর্ন্ত নেই। ফলে রাস্তায় দুঘর্টনাও বেড়েছে।

এ দিকে রাস্তায় একের পর এক দুঘর্টনা ও মৃত্যুর মিছিলের জন্য বিশেষজ্ঞরা অদক্ষ শ্রমিকদেরই দায়ী করলেন। দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে। যাদের দায়িত্ব শ্রমিক তৈরি করা তারা তা করছেন না। সরকারের দক্ষ চালক তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই। সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো সেখানে ব্যথর্ হয়েছে। এ সুযোগে অদক্ষ শ্রমিকেরা গাড়ি চালানোয় দুঘর্টনা ঘটছে।

মো.ওসমান গনি: কলাম লেখক

মধহরঢ়ৎবংং@ুধযড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে