মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সবার আগে প্রয়োজন দেশপ্রেম

বাংলাদেশকে একসময় সোনালি অঁাশের দেশ বলা হতো। এর কারণ বাংলাদেশের পাটের বিশ্বময় সুখ্যাতি। এ ছাড়া বৈদেশিক আয়ের সিংহভাগ আসত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে। সেই পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এ জন্য পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হলে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
ড. হারুন রশীদ
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আমরা দেশের খাই দেশের পরি। কিন্তু দেশের জন্য আসলে কী করি! আমাদের দেশপ্রেম কি কেবলি লোক দেখানো ব্যাপার? নইলে দেশের ক্ষতি হয়, দেশের মানুষ কষ্টে থাকে এমন কাজ আমরা কী করে করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের একটি গানের স্মরণ নিতে পারি।

কেন চেয়ে আছ, গো মা, মুখপানে।/ এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে, আপন মায়েরে নাহি জানে।/ এরা তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভাণে।

তুমি তো দিতেছ, মা, যা আছে তোমারি স্বণর্শস্য তব, জাহ্নবীবারি,/ জ্ঞান ধমর্ কত পুণ্যকাহিনী।/ এরা কী দেবে তোরে! কিছু না, কিছু না। মিথ্যা কবে শুধু হীনপরানে\/ মনের বেদনা রাখো, মা, মনে। নয়নবারি নিবারো নয়নে\

মুখ লুকাও, মা, ধুলিশয়নে ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে।/ শূন্য-পানে চেয়ে প্রহর গনি দেখো কাটে কিনা দীঘর্ রজনী।/ দুঃখ জানায়ে কী হবে, জননী, নিমর্ম চেতনাহীন পাষাণে\

এই গানটি শুনলে মনটা আদ্রর্ হয়ে যায়। সত্যি তো দেশ আমাদের এত কিছু দিচ্ছে কিন্তু আমরা নিজেকে ছোট করে রেখেছি। দেশের জন্য প্রকৃতাথের্ তেমন কিছু করছি না। এর হাজারটা উদাহরণ আছে। কয়টার কথা বলব। সাম্প্রতিক সময়ে চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিই ধরা যাক। এমনকি হলো যে হঠাৎ করেই চালের দাম বেড়ে গেল? কথায় বলে ‘দুজের্নর ছলের অভাব হয় না।’ তাই এ ক্ষেত্রেও নানা অজুহাত দেখানো হচ্ছে। শুধু চাল নয় যে কোনো উসিলায় দ্রব্যমূল্য বাড়ানো একটি দুভার্গ্যজনক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে কাযর্কর কোনো ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। টিসিবিকে সক্রিয় করে বাজারে একটি প্যারালাল সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখার কথা বলা হয় সবসময়। কিন্তু আজও টিসিবিকে সেই মাত্রায় কাযর্কর করা যায়নি। অনেকদিন ধরেই চালের বাজার অস্থিতিশীল। চালের দাম বাড়লে তা সীমাহীন দুভোর্গ সৃষ্টি করে ভুক্তভোগীদের। এই চালের দামবৃদ্ধির বিষয়টিকে পুঁজি করে এখন আবার নতুন শতর্ দেয়া হচ্ছে। চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাটের পরিবতের্ প্লাস্টিকের বস্তায় চাল আমদানি ও সংরক্ষণ করতে দিতে হবে।

উপায়ন্তর না দেখে সরকারও রাজি হয়ে গেল। আর এতে হেঁাচট খেল সোনালি অঁাশের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। জরুরি পরিস্থিতিতে প্লাস্টিকের বস্তায় চাল সংরক্ষণের সিদ্ধান্তে ঘুরে-ফিরে লাভ হলো চাল ব্যবসায়ীদের। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন পাটচাষি এবং সরকার। অনেক চালকল মালিকেরই প্লাস্টিকের বস্তা তৈরির কারখানা আছে। ১৭টি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় সেই কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় বলছে, সেগুলো চালু করার জন্যই চালকল মালিকরা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তবে সরকার বলছে এটা আপদকালীন সময় অথার্ৎ তিন মাসের জন্য। বাস্তবতা হচ্ছে, পাটের বস্তা ব্যবহারের ফলে দেশের জুটমিলগুলোতে লাখ লাখ পাটের বস্তা উৎপাদন হচ্ছে। পাটের উৎপাদনও বেড়েছে। পাটচাষিরা পাটের ভালো মূল্যও পাচ্ছেন। এ অবস্থায় পাটের ব্যবহার বন্ধের যে কোনো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কাযর্কর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

দুই.

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্র উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বেশ সঙ্কুচিত। তবুও সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বাংলাদেশি গবেষক ও বিজ্ঞানীরা দেশে-বিদেশে নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন।

তোষা পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের পর এবার দেশীয় পাটের জীবন রহস্যও উদ্ভাবন করেছেন আমাদের দেশের একদল মেধাবী বিজ্ঞানী। প্রয়াত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম ও তার দল তোষা পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করে ২০১০ সালে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে উন্মোচন করেন ছত্রাকের জীবন রহস্য। এবং সবের্শষ তারই নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী এবার দেশীয় পাটের জিন রহস্য উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। পাটের এই জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্সি) উদ্ভাবনের ফলে এসংক্রান্ত গবেষণায় পূণর্তা পায় বাংলাদেশ। অথার্ৎ পাট বললেই এবার বাংলাদেশকে বোঝাবে। পাট কথাটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ কথাটি চলে আসবে।

প্রথমে তোষা পাট এরপর পাটের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাক এবং সবশেষ দেশীয় পাটের জীন রহস্য উদ্ভাবন করায় উন্নত জাতের পাট উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। আর এসবের স্বত্ব বা পেটেন্ট পেলে বিশ্বের যে কোনো স্থানে এ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য অথর্ পাবে বাংলাদেশ। এই উদ্ভাবনের ফলে বাংলাদেশের মযার্দাও বৃদ্ধি পাবে বহিবিের্শ্ব। বলতে গেলে পাট নিয়ে এক অমিত সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসংক্রান্ত উদ্ভাবনকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে পাটই বদলে দেবে বাংলাদেশকে।

জিন রহস্য উদ্ভাবন করেই থেমে নেই বিজ্ঞানিরা। উন্নত জাতের পাট কী করে অতিদ্রæত কৃষকের কাছে পেঁৗছে দেয়া যায় সে লক্ষ্যেও কাজ করছেন তারা। এক ধরনের ছত্রাকের কারণে পাটের খুব ক্ষতি হয়। সেই ছত্রাকের জিন রহস্যও উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ছাড়া লবণাক্ত পানিতে কী করে পাট চাষ করা যায় এ জন্য লবণাক্ততা সহনশীল পাটের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। বিজ্ঞানিরা চেষ্টা করছেন পাটের জাতের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত করা দেশীয় এবং আন্তজাির্তক বাজারে যার চাহিদা রয়েছে। দেশের বস্ত্রশিল্পে কাপড় তৈরির উপযোগী সুতা বতর্মানে পাট থেকে উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে না। বিজ্ঞানিরা চেষ্টা করছেন পাটের অঁাশকে আরও শক্ত এবং সূক্ষ করা যায় কিনা। এটি করা গেলে বস্ত্রশিল্পের জন্য উন্নতমানের সুতা পাট থেকেই পাওয়া সম্ভব হবে।

বাংলাদেশকে এক সময় সোনালি অঁাশের দেশ বলা হতো। এর কারণ বাংলাদেশের পাটের বিশ্বময় সুখ্যাতি। এ ছাড়া বৈদেশিক আয়ের সিংহভাগ আসত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে। সেই পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এ জন্য পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হলে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

বড় পাটকলের চেয়ে পাটজাত পণ্য তৈরি করতে পারে এমন ছোট ছোট শিল্পের সম্ভাবনা বেশি। কাজেই এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে হবে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশকে শক্ত অথৈর্নতিক ভিত্তির ওপর দঁাড়াতে হলে কৃষির ওপর ভর করেই তা করতে হবে। আর সেজন্য অন্যতম কৃষিপণ্য পাটের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। পাটের সুদিন ফিরে এলে বহু মানুষ তাতে উপকৃত হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অজর্নও বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। ক্রমবধর্মান জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখানে অধিকহারে খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়। ধানের বেশ কিছু উন্নততর জাত উদ্ভাবন, ফসল ও বীজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেলেও বিভিন্ন ধরনের রোগবালাইয়ের কারণে ফসলের উৎপাদন প্রতি বছর আশানুরূপ হয় না। এ প্রেক্ষাপটে পাটের জন্য ক্ষতিকারক ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনের ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত তাৎপযর্পূণর্। বিজ্ঞানীদের বতর্মান সাফল্যকে চ‚ড়ান্ত পযাের্য় নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারকে এ বিষয়ে আরও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিজ্ঞানী দলকে সবর্প্রকার লজিস্টিক সাপোটর্ প্রদান করে তাদের গবেষণা কাজকে চ‚ড়ান্ত লক্ষ্যে পেঁৗছাতে সহযোগিতা করতে হবে।

জৈবপ্রযুক্তি এবং জিনোম গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের আন্তজাির্তক বাজার অনেক বড়। স্বত্ব বা পেটেন্ট প্রতিষ্ঠা করা গেলে ওই বাজারে প্রবেশ করতে পারলে বাংলাদেশের চেহারাই পাল্টে যাবে। কারণ জিনোম গষেণার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের বাজারটি কমপক্ষে এক ট্রিলিয়ন (এক লাখ কোটি) ডলারের। জিনোম গবেণার ফলাফলকে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিয়ে যেতে পারলে সেটি আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা যে এনজাইমটির জীবন প্রক্রিয়া জানতে পেরেছে তা বিশ্বের এনজাইম বাজারের ২০ শতাংশ মেটায়। স্বত্ব পেলে কয়েক হাজার কোটি টাকার ওই বাজারেও অংশ নিতে পারবে বাংলাদেশ। ছত্রাকের ওপর যে স্বত্ব দাবি করছে বাংলাদেশ সেটি পেলে বিশ্বের যে যেখানে ওই বিষয় নিয়ে গবেষণা করবেন তাদের বাংলাদেশকে স্বত্ব বাবদ অথর্ দিতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশের অথর্নীতির চেহারাই পাল্টে যাবে।

বাংলাদেশের গবেষণা ক্ষেত্রটি এখনো অনেকটাই সীমিত। গবেষণা খাতে বরাদ্দও কম। এরপরও সীমিত সাধ্যের মধ্যেই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা যে সাফল্য দেখাচ্ছেন সেটি অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে এই যুগে সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদেরও গবেষণা ক্ষেত্র আরও বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে পাট গবেষণায় বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে সেটিকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের অথের্র কমতি থাকতে পারে কিন্তু মেধাবী এবং দেশের জন্য কাজ করার মানুষের যে অভাব নেই সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক কমর্কাÐ নিয়ে যত বেশি আলোচনা হয় তার কিয়দশংও যদি অন্যান্য ক্ষেত্র বিশেষ করে গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়ে সাফল্যের জন্য হতো তাহলে গবেষণা ক্ষেত্রটা এগিয়ে যেত। আমরা কথায় কথায় দেশের কথা বলি। কিন্তু ব্যক্তি স্বাথের্র ঊধ্বের্ উঠতে পারি না। তাই পাটের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য সরকার উদ্যোগ নিলেও ব্যক্তি স্বাথের্ তার বিরোধিতা করি। নানা ক‚টকৌশল খঁুজি। যাতে আখেরে নিজেরই ক্ষতি। পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হলে সত্যিকার দেশপ্রেমিক নাগরিকের এই আত্মোপলব্ধি আজ অত্যন্ত জরুরি।

ড. হারুন রশীদ: সাংবাদিক, কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<13119 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1