বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক দুঘর্টনায় লাগাম পরাবে প্রধানমন্ত্রীর ছয় নিদের্শনা

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ঢাকা
  ০১ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুঘর্টনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি সড়ক দুঘর্টনা রোধে ছয়টি নিদের্শনাও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নিদের্শনাগুলো হলোÑ ১. গাড়ির চালক ও তার সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ২. লং ড্রাইভের সময় বিকল্প চালক রাখা, যাতে পঁাচ ঘণ্টার বেশি কোনো চালককে একটানা দূরপাল্লায় গাড়ি চালাতে না হয়। ৩. নিদির্ষ্ট দূরত্বে পর পর সড়কের পাশে সাভির্স সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি। ৪. অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা। ৫. সড়কে যাতে সবাই সিগন্যাল মেনে চলে তা নিশ্চিত করা। পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করা। ৬. চালক যাত্রীদের সিটবেল্ট বঁাধার বিষয়টি নিশ্চিত করা। সড়ক দুঘর্টনার গতি থামাতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নিদের্শনাগুলো খুবই গুরুত্বপূণর্। সভ্য দুনিয়ায় গাড়ির চালক হওয়া যথাযথ প্রশিক্ষণের ওপর নিভর্র করে। আমাদের দেশেও খাতা-কলমে একমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য। তবে বাস্তব পরিস্থিতি একেবারে আলাদা। গাড়ি চালকের লাইসেন্স পেতে আবেদনকারী সঠিকভাবে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে কতটা দক্ষ তার বদলে উৎকোচ দানে তার সক্ষমতাই বেশি গুরুত্ব পায়। গাড়িচালকদের লাইসেন্স দানের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কাছে এ চাকরিটি আলাদীনের চেরাগের মতো। যার বদৌলতে সংশ্লিষ্ট দফতরের পিয়নরাও মাসে লাখ টাকা আয়ের যোগ্যতা দেখান। ট্রাফিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে দুনিয়ার যেসব দেশের অবস্থান সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। ফলে গাড়ি চলাচলে যেমন শৃঙ্খলা নেই তেমন রাস্তা পারাপারে কোনো নিয়ম পালন করা হয় না।

আশার কথা দেরিতে হলেও সড়ক নৈরাজ্যের বিষয়টি সরকারের সবোর্চ্চ পযাের্য়র দৃষ্টি আকষর্ণ করেছে। সড়ক দুঘর্টনা ঠেকাতে কড়া আইন প্রণয়নেরও প্রস্তুতি চলছে। তবে আইন প্রণয়নই এ দেশে যথেষ্ট নয়। আইন যারা প্রয়োগ করবেন তাদের সততা নিশ্চিত করাও খুবই জরুরি। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা এ ব্যাপারে একটু যতœবান হলে এবং পরিবহন মালিক এবং চালকদের কাছে তারা নিজেদের বিবেককে বিক্রি করে না দিলে শুধু সড়ক দুঘর্টনা কমিয়ে আনা নয় যানজটও অন্তত ৫০ ভাগ রোধ করা সম্ভব। পরিবহন মালিক ও চালকদের সমিতি ও ইউনিয়নের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাবানদের গঁাটছড়ার নিকৃষ্ট পথ থেকে সরে আসাও জরুরি। এ ব্যাপারে সফল হলে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে উৎসাহিত হবে বিদেশি বিনিয়োগ। জিডিপির প্রবৃদ্ধিও উচ্চপযাের্য় পেঁৗছাবে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, নিষিদ্ধ হলেও এখনো অনেক চালককেই মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। যে কোনো মূল্যে এটি বন্ধ করতে হবে। অদক্ষ চালকরা যেন লাইসেন্স না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে ফিটনেসবিহীন গাড়ি যেন রাস্তায় নামতে না পারে তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। পথচারীদের রাস্তা পারাপারেও শৃঙ্খলা আনতে হবে। জানা যায়, লেগুনা, হিউম্যান হলার, টেম্পো বা এ ধরনের কিছু গাড়ির চালকদের বেশির ভাগেরই লাইসেন্স থাকে না। অপ্রাপ্তবয়স্করাও এসব গাড়ি চালায়। এমনকি খোদ রাজধানীতেও এদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। অভিযোগ আছে, পুলিশকে নিধাির্রত দৈনিক অথর্ পরিশোধের মাধ্যমে এরা গাড়ি চালায়। তাই এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নছিমন, করিমন, টমটম, ভটভটি ইত্যাদি নামের কিছু যানবাহন ইদানীং মহাসড়কেও চলতে দেখা যায়, যেগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি এবং ইঞ্জিনগুলো যানবাহনেরই নয়। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। সাম্প্রতিক সময়ে এই যানবাহনগুলো দুঘর্টনার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। অথচ কোনো এক অদৃশ্য কারণে এগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে অনেক সময় যাত্রীবাহী বাসও দুঘর্টনাকবলিত হচ্ছে। অভিযোগ আছে, গাড়ি চালাতে না জানলেও শুধু কিছু টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স পাওয়া যায়। এমন ভয়ঙ্কর দুনীির্ত দ্রæত বন্ধ করতে হবে।

জীবনধারণের একান্ত প্রয়োজনেই মানুষকে সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করতে হয়। এটা কোনোভাবেই মৃত্যুফঁাদ হতে পারে না। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দুঘর্টনা রোধে দ্রæত কাযর্কর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুঘর্টনা গবেষণা ইনস্টিটিউট দুঘর্টনার কারণ সংক্রান্ত পুলিশি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বলেছে দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুঘর্টনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ঘটে ৩৭ শতাংশ দুঘর্টনা। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুঘর্টনার পরিমাণ ১০ শতাংশ।

ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়ক দুঘর্টনার ৪৩ শতাংশই ঘটছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে। প্রতিদিনই সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। স্বজন হারানো মানুষের বুকফাটা আতর্নাদও বেপরোয়া যানবাহন চালকদের মনে সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করতে পারছে না। যানবাহন চালকদের অদক্ষতার কারণেই অধিকাংশ দুঘর্টনা ঘটছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কতৃর্পক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১৫ সালে সড়ক দুঘর্টনায় প্রাণ গেছে ২ হাজার ৩৯৪ জনের। আর যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে এই সংখ্যা আট হাজার। দেশে যানবাহন চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিআরটিএ সারাদেশে ১০২টি চালক প্রশিক্ষণ স্কুলের নিবন্ধন দিলেও এগুলোর কাযর্ক্রম নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। লাইসেন্স পেতে যে প্রশিক্ষণের দরকার, তা এসব স্কুল থেকে পাওয়ার কথা হলেও বাস্ত বে ড্রাইভিং স্কুলের বেশির ভাগেরই হদিস নেই। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রশিক্ষণ কোনো গুরুত্বই পায় না।

তাছাড়া ফিটনেসহীন যানবাহনের চলাচলও সড়ক ব্যবস্থাপনাকে তছনছ করে দিচ্ছে। ফিটনেস সাটিির্ফকেটের ক্ষেত্রেও চলে লাগামহীন উৎকোচ। সড়ক দুঘর্টনা কমিয়ে আনতে হলে এসব অব্যবস্থার রাশ টেনে ধরার পাশাপাশি পথচারী ও যাত্রীদের সচেতনতাও বাড়াতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে