আজকের যায়যায়দিন

বঙ্গীয় ইতিহাসে ২৩ জুন অন্তত দুটি কারণে বাঙালির মনে অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল পরে বাংলা। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন কিছু লড়াকু নেতার নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলার সবর্বৃহৎ দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (প্রথমে এর নাম ছিল পূবর্ পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ)। আওয়ামী লীগের দৃঢ় ও সাহসী নেতৃত্বে দল গঠনের মাত্র দুই যুগের মধ্যেই স্বাধীনতার স্বাদ পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ইতিহাস একসূত্রে গঁাথা। এক ২৩ জুনে ভাগীরথী নদীর তীরে স্বাধীনতার সূযর্ ডুবেছিল, আরেক ২৩ জুনে বুড়িগঙ্গার তীরে উদিত হয় স্বাধীনতার লাল সূযর্।

প্রতিষ্ঠাবাষির্কীতে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমই আওয়ামী প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে পত্র-পত্রিকায় আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের এক তরফা প্রশংসা ও অজের্নর ফিরিস্তি দেখে আমি কিছুটা বিব্রত বোধই করেছি। অজর্ন মানেই আত্মসন্তোষের ব্যাপার, কিন্তু আত্মসন্তোষের পাশাপাশি আত্মসমালোচনাও দরকার। দলীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যারা কেবল আওয়ামী লীগের অজের্নর কথা বলছেন, আমি এই লেখায় ওই সব আওয়ামী বুদ্ধিজীবীর উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে চাই।

আমি দুই যুগ আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় শাসনভার গ্রহণ ও নীতিনিধার্রণেও অংশীদার ছিলাম। দীঘির্দন ধরে সক্রিয় রাজনীতির বাইরে থাকলেও এটা ভুলে যাইনি, আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের নিমার্তা। যে দলের হাতে একটি দেশের ষোলো কোটি মানুষের ভাগ্যরেখা লেখাÑ সে দলের জন্য শুধু স্তুতিবাক্য নয়, নিরপেক্ষ মূল্যায়নও জরুরি। সত্তর বছরে পা দিয়ে আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব সুরম্য দশতলা ভবনের মালিক হয়েছে। একটি অত্যাধুনিক নিজস্ব কাযার্লয় নিমাের্ণর জন্য ১৯৯৬ সালেই আমরা বতর্মান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলাম। কেন আমি অত্যাধুনিক নিজস্ব কাযার্লয়ের বিষয়ে আগ্রহী ছিলাম? আগ্রহী ছিলাম এই কারণে যে, ভাড়া বা চুক্তিভিত্তিক ভাসমান কাযার্লয় যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। নিজস্ব কাযার্লয় থাকলে সেই কাযার্লয় ঘিরে দলীয় কমর্কাÐ বৃদ্ধি পায়, নেতাকমীর্র মনোবল দৃঢ় হয়। ভারতের অজয় ঘোষ ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পাটির্র সাধারণ সম্পাদক ও তাত্তি¡ক, তার নামে নিমির্ত ‘দশতলা অজয় ভবন’ পরিদশর্ন করে আমার মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়, সেই প্রতিক্রিয়ার ফলই ছিল শেখ হাসিনার নিকট ধানমÐি ৭ নম্বর সড়কে ৪২ কাঠা জমির ওপর ১০তলা ভবন নিমাের্ণ আমার উচ্চাভিলাসী প্রস্তাব। উচ্চাভিলাসী এই কারণে বলছি যে, আমার প্রস্তাব শুনে নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা এখন সম্ভব নয়, কারণ পাটির্র ফান্ডে অত টাকা নাই, অনুদান দেয়ার মতো নেতাকমীর্ও দুলর্ভ।

বিগত দশ বছরে শেখ হাসিনার সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে, সেই হারে আওয়ামী লীগের ভোট বেড়েছে কিনা এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের নেতাকমীর্ ও আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের একটু খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানাই। এখনও বাংলাদেশে অ্যান্টি আওয়ামী লীগের সংখ্যাধিক্য দেখে আমি বিস্মিত হই। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না, তাহলে কেন এটা হচ্ছে? যে দল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, মানুষের ভাগ্যের পরিবতর্ন ঘটিয়েছে, কেন তারা এককভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারছে না? শুধু উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে মানুষের মন জয় করা যাবে না। কিভাবে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ জনতার মন জয় করবেনÑ সেই বিষয়টি রপ্ত করার জন্য আমি বঙ্গবন্ধুর রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটি বিশেষভাবে পড়ার জন্য অনুরোধ করছি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেনÑ ‘গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া এই দুই থানা নিয়ে আমাদের নিবার্চনী এলাকা। রাস্তাঘাট নাই। যাতায়াতের খুবই অসুবিধা। আমার নিবার্চন চালাবার জন্য মাত্র দুইখানা সাইকেল ছিল। কমীর্রা যার যার নিজের সাইকেল ব্যবহার করত। আমার টাকা-পয়সারও অভাব ছিল। বেশি টাকা খরচ করার সামথর্্য আমার ছিল না। ... কয়েকটা সভায় বক্তৃতা করার পরে বুঝতে পারলাম, ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব (শেখ মুজিবের প্রতিদ্ব›দ্বী) শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করবেন। টাকায় কুলাবে না, জনমত আমার পক্ষে। আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারণ শুধু আমাকে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানের পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসেবে হাজির করত এবং না নিলে রাগ করত। তারা বলত, ‘এ টাকা নিবার্চনের খরচ বাবদ দিচ্ছে।’ বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন, ‘আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দঁাড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে। আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।’ টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।’ সেই নিবার্চনে বঙ্গবন্ধুর কাছে ধনবান ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় দশ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে এ রকম ঘটনা বহুবার ঘটেছিল। তিনি গণমানুষের কতটা কাছের ছিলেন, মানুষ তাকে কি পরিমাণ বিশ্বাস করতো আর ভালোবাসতো তা ভাবলে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

তীব্র তাপপ্রবাহ ও জনসচেতনতা

মানুষের মন জয় না করে যারা টাকা দিয়ে ভোট কিনতে চায় তাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর জীবনের অভিজ্ঞতা শিক্ষণীয় বলেই আমি মনে করি। একটি রাজনৈতিক দল ও একজন নেতার প্রথম কাজই হওয়া উচিতÑ মানুষের হৃদয় জয় করা। একবার মানুষের মন জয় করতে পারলে তার বিজয় কেউই ঠেকাতে পারে না। দুবৃর্ত্ত, দুনীির্তবাজ, কালো টাকার মালিকÑ আওয়ামী লীগের নৌকাতে যে নেইÑ এমন নয়। অন্যান্য দলের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগেও দুবৃর্ত্ত ও জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য নেতার অভাব নেই। এসব নেতা দিয়ে ভোটের বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। উন্নয়ন এক জিনিস, মানুষের ভালোবাসা অন্য জিনিস। উন্নয়নের পাশাপাশি দলীয় নেতাকমীর্রা যদি সাধারণ মানুষকে ভালোবাসেন এবং তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করেন, তাহলে নৌকার বিজয় কিছুতেই ঠেকানো যাবে না। এককভাবে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে হলে বঙ্গবন্ধুর পথ অনুসরণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। মানুষকে ভালোবাসলে মানুষ কখনো বিমুখ করে না, এটা আওয়ামী লীগের নেতাকমীের্দর মনে রাখা দরকার। সামনে নিবার্চনÑ এই মুহূতের্ আত্মসমালোচনা সবচেয়ে বেশি করা দরকার। দলীয় ত্রæটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে এগিয়ে না গেলে উন্নয়নের রথ মুখ থুবড়ে পড়বে। পাশ্বর্বতীর্ ভারতের কংগ্রেস কিংবা বামফ্রন্টের দিকে আওয়ামী লীগের তাকানো দরকার। কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট সরকার দীঘির্দন ক্ষমতায় ছিল। অথচ আজ তারা এতটাই কোণঠাসা হয়ে আছে যে, দল দুটির ভবিষ্যৎ ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে।

ক্ষমতা চিরদিন কারও স্থায়ী হয় না, এই কথাটি মনে রেখে রাজনীতি করলে মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ এমনিতেই আসে। আওয়ামী লীগের সামনে বতর্মানে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা শুধু শেখ হাসিনার একার পক্ষে সম্ভব নয়, দলের সকল নেতাকমীের্কই সচেতন হতে হবে এবং যথাথর্ ভ‚মিকা পালন করতে হবে।

একটি সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কমবেশি উন্নয়ন করতেই হয়। আওয়ামী লীগের উচিত হবেÑ শুধু উন্নয়ন নয়, সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আদশের্ক মনে-প্রাণে ধারণ করা। ইতিহাসের অনেক রক্তাক্ত পথ, অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বতর্মান জায়গায় এসে পেঁৗছেছে। দলে সৎ, যোগ্য, শিক্ষিত, জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের বেশি বেশি স্থান দিতে হবে, সেই সঙ্গে দলছুট, হাইব্রিড নেতাদের যথাসম্ভব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে গ্রহণ-বজর্ন করতে হবে। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, ধমির্নরপেক্ষতায় এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থায়। দলের প্রত্যেকটি নেতাকমীের্কই এই আদশর্ অন্তরে ধারণ করতে হবে। সত্তর বছর বয়স্ক আওয়ামী লীগ ঊনপঞ্চাশ বছরই ছিল বিরোধী দলে। এমনটা কেন হলো তা দলটির খতিয়ে দেখা দরকার।

শুধু উন্নয়ন আর আত্মতুষ্টি নয়, আত্মসমালোচনা করাও রাজনীতির অপরিহাযর্ অংশ। উন্নয়নের অঙ্গীকার, মুজিব আদশর্ ধারণ আর মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে পথ চলতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলেই ভবিষ্যতে নেমে আসবে বিপযর্য়। ৭০ বছরের আওয়ামী লীগকে কেন বার বার ক্র্যাচে ভর করে ক্ষমতায় যেতে হবে? ১৯৭০ সালের নিবার্চনের মতো কেন আওয়ামী লীগ বতর্মানে নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করতে পারছে না? কথাগুলো শুনতে ককর্শ লাগলেও আওয়ামী লীগের নেতাকমীের্দর এটা বিশ্লেষণ করা দরকার।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক ও কলাম লেখক