আমারা জানি ‘পানির অপর নাম জীবন’। আবার তা কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। ‘পানির অপর নাম জীবন’ অবশ্যই তা সুপেয় পানি, বিশুদ্ধ পানিতেই সম্ভব। কিন্তু এই পানি যখন জীবাণুযুক্ত, দূষিত, ময়লাযুক্ত হয় তখন মানুষের জন্য তা ক্ষতিকর,পানের অযোগ্য হয়ে ওঠে। তখন ওই পানি স্বাস্থ্যের জন্য, শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সাধারণত ওয়াসার সরবরাহ করা পানির লাইনে ত্রæটি, ফাটল ধরলে তখন বাইরের ড্রেনের, টয়লেটের দূষিত পানি ওয়াসার পানির সরবরাহ লাইনে ঢুকে পানিকে দুগর্ন্ধযুক্ত পানের অযোগ্য, দুষিত করে তুলতে পারে। এ ধরনের ঘটনা রাজধানীতে প্রায়ই ঘটে। বিশেষ করে শুষ্ক ও শীত মৌসুমে রাজধানীতে ব্যাপক হারে এই ঘটনা ঘটে। কিন্তু চট্টগ্রামে এ ধরনের ঘটনার খবর তেমন চোখে পড়ে না। কিন্তু সম্প্রতি তেমন একটি সংবাদ দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
একটি প্রবাদ আছে, ‘মহিষ, গাধা পানি ঘোলা করেই পান করে, আবার রাজনীতিতে একটি প্রবাদ আছে, তা হচ্ছে, ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা।’ স্বচ্ছ পানিতে মাছ শিকার কষ্টসাধ্য বলেই হয়তো পানি ঘোলা করে রাজনীতির মাঠ গরম বা উত্তপ্ত বা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করা সহজ বলেই হয়তো এই প্রবাদ প্রচলিত। আবার অন্য কারণেও পানি দূষিত হতে পারে, তা হচ্ছে নিজস্ব উদ্যোগে স্থাপিত গভীর, অগভীর নলক‚প, কিংবা ওয়াসার সরবরাহ দেয়া পানির লাইন থেকে জেনারেটর দিয়ে নিজস্ব রিজাভাের্র সংরক্ষণ করা পানির ক্ষেত্রেই সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে ট্যাঙ্কি বা রিজাভার্র যদি অপরিষ্কার হয়, ট্যাঙ্কির মুখ বা রিজাভাের্রর মুখ যদি কোনো কারণে খোলা থাকে, ফাটল থাকে, লিকেজ থাকে তাতে বাতাসে বহনযোগ্য কোনো রাসায়নিক পদাথর্ মিশলে, বা পাশ্বর্বতীর্ জমে থাকা পানিতে জš§ নেয়া কীট পতঙ্গ, কেঁচো, ডাবের খোসা, কলা, আম, কঁাঠালের খোসায় জমে থাকা পানি থেকে উৎপাদিত মশা, মাছি, পানিতে পড়লে, পাশ্বর্বতীর্ নালা, নদর্মা, হাজা, মজা পুকুর, ড্রেনের পানি থেকে কোনো পতঙ্গ এসে ট্যাঙ্কি বা রিজাভাের্রর ওই পানিতে মিশলে বা পড়লে তখন সেই পানিতে নানা রকম রোগের জীবাণু মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরসহ সংলগ্ন কিছু এলাকায় সম্প্রতি পানির দূষণ নিয়ে যে প্রশ্ন ওঠেছে তার নেপথ্যে এসব কারণ আছে কি-না, তা অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণার দাবি রাখে।
তবে এটা মনে রাখা দরকার, জলবায়ু পরিবতর্নজনিত কারণে গত কয়েকবছর ধরে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, হালিশহর, মুহুরীপাড়া, সিডিএ আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ ব্যাংক কলোনি, ব্যাপারী পাড়াসহ শহরের পশ্চিমাংশে কণর্ফুলী নদী সংলগ্ন এলাকায় জোয়ারের সময় কোথাও হঁাটু কোথাও আরও বেশি পরিমাণ পানিতে ডুবে থাকে। দিনে, রাতের বেশির ভাগ সময় এসব এলাকায় পানিতে থৈ থৈ করে এটা নিত্যদিনের চিত্র। তা ছাড়া জোয়ারে আসা পানি ময়লা, দুগর্ন্ধ, অধিক মাত্রায় ক্লোরিন থাকার আশঙ্কা থাকে। আর এই পানি কোনো কারণে ওয়াসার পানির সরবরাহ লাইনে বা ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত নলক‚পের পানিতে, রিজাভাের্র, ট্যাঙ্কিতে প্রবেশ করে, তাহলে তা অবশ্যই দূষিত, ময়লাযুক্ত, ক্লোরিন যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। জুনের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রামের সিভিল সাজর্নকে উদ্ধৃতি দিয়ে ‘ওয়াসার পানিতে ক্লোরিন বেশি থাকায় মানুষ জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য পরে মেয়রের সঙ্গে বৈঠকে সিভিল সাজর্নকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত রিপোটের্ তার বক্তব্য ভুলভাবে প্রকাশিত হয়েছে বলে দাবি করেন। যাক সে কথা তবে এ ক্ষেত্রে পানির নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা নিরীক্ষায় ওয়াসাকে এ সময় রাখা হয়নি। অথচ নগরবাসীর সামনে ওয়াসাকে অভিযুক্ত, অপরাধী এবং আসামির কাঠগড়ায় দঁাড় করানো হলো। রহস্যটা এখানেই। ওয়াসাই যদি দায়ী হবে, তাহলে দায়িদের কেন বিষয়টি অবহিত করা হয়নি? বরং ওয়াসাকে নগরবাসীর সামনে আসামি করা ও নগরবাসীর মুখোমুখি দঁাড় করিয়ে কোনো অশুভ শক্তি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে কি-না, তা গণমাধ্যমকমীের্দর অনুসন্ধান করে বের করা জরুরি। তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দিনকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় এ জন্য যে, তিনি পানি নিয়ে ঘটে যাওয়া বিভ্রান্তি, জনমনে সৃষ্ট আতঙ্ক দূর বা নিরসন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ জন্য তিনি তার দফতরে ওয়াসা, চট্টগ্রাম সিভিল সাজর্ন অফিস এবং সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলদের দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ সময় তিনি নগরবাসীর উদ্দেশ্যে এবং তাদের আশ্বস্থ করে বলেছেন, ‘ওয়াসার পানি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ওয়াসার পানি নিরাপদে, নিভের্য় পান করার জন্যও তিনি আহŸান জানান। বৈঠকে ওয়সার পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়াসার পানির কারণে নগরীর কোথাও মানুষ আক্রান্ত হওয়া বা মারা যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। তবুও তাদের পক্ষ থেকে সতকর্তামূলক ব্যবস্থা হিসাবে, পানি নিয়ে যাতে নগরবাসীর সন্দেহ দূর হয় সে জন্য তারা জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রচার প্রচারণা, লিফলেট বিতরণ, মাইকিং করে নিজ নিজ পানির ট্যাঙ্কি, রিজাভার্র পরিষ্কার রাখা, নিয়মিত ঢাকনা ব্যবহার, ফুটিয়ে বা সিদ্ধ করে পানি পান করা, নিকটস্থ ড্রেন, নদর্মা, বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদ পরিচ্ছন্ন রাখা, ওয়াসার পানির লাইনে বা পানিতে কোনো দূষণ, ময়লা দৃষ্টিগোচর হলে তা তাৎক্ষণিক নিকটস্থ অভিযোগ কেন্দ্র জানাতে অনুরোধ জানানো হয়। ‘বস্তুত, ক’দিন ধরে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ওয়াসার পানি নিয়ে যেভাবে ‘পানি ঘোলা করা হচ্ছে’ এবং তা এখনো অব্যাহত আছে, তা বুঝতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু কেন এই বিভ্রান্তি, বিতকর্ অপপ্রচার, কেনই বা আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে এটা বোধম্য নয়। এই বিভ্রান্তি, আতঙ্ক, বিতকর্ এবং পানি ঘোলা করায় ওয়াসার মতো একটি সরকারি সেবাধমীর্ প্রতিষ্ঠানকে নগরবাসীর মুখোমুখি দঁাড় করানো হয়েছে। একই সঙ্গে আসামির কাঠগড়ায় দঁাড় করানো হয়েছে। এতে কার লাভ, কার ক্ষতি, কে উপকৃত হচ্ছেন আবার কে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তার হিসাব মেলাতে এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ওয়াসার কোনো ব্যথর্তা বা গাফিলতি থাকে, তাহলে সেটা যেমন দ্রæত সমাধানের দাবি রাখে, তেমনি নিছক কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে পুরো নগরবাসির মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা কারও কাম্য নয়। সম্প্রতি আমার প্রিয় শহর চট্টগ্রামে বিএফইউজের ভোট ক্যাম্পেইেনে গিয়ে এ নিয়ে নানা কাহিনী শুনেই মূলত এই লেখা। আশা করছি পানি নিয়ে আর জল ঘোলা হবে না।
মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সড়ঃধযবৎনফ১২৩@মসধরষ.পড়স