শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মফস্বল সাংবাদিকতার নানা দিক

পঞ্চাশের দশকের প্রথমাধর্ আমাদের সংবাদপত্র এবং মফস্বল সাংবাদিকতার জগতে একটি উল্লম্ফন ঘটায়। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুখপত্র রূপে দৈনিক ইত্তেফাকের আত্মপ্রকাশ, মুসলিম লীগ কতৃর্ক প্রকাশিত দৈনিক সংবাদের প্রগতিশীল মালিকানায় হস্তান্তর এবং দৈনিক মিল্লাতসহ আরও কয়েকটি দৈনিকের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে আমাদের সংবাপত্র জগতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর প্রচারণার পরিবতের্ প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার প্রচার ও প্রসার মূল দশর্ন হিসেবে গণ-ভিত্তি অজর্ন করে। পাকিস্তান অবজারভারও এ ব্যাপারে ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই এই ধারায় অন্যতম প্রধান মুখপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর এ সব পত্রিকায় মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ পান প্রধানত প্রগতিচিন্তায় বিশ্বাসী তরুণেরা, যারা ছিলেন নিঃস্বাথর্ দেশপ্রেমিক চিন্তার ধারক ও বাহক।
রণেশ মৈত্র
  ২৩ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

ভারতবষের্ক ধমের্র ভিত্তিতে বিভক্ত করে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রথম রাজধানী ছিল করাচি শহর। আমরা পূবর্পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলাম ঢাকা ছিল আমাদের রাজধানী। অবিভক্ত ভারতবষের্র রাজধানী ছিল প্রথমে কলকাতা ও পরে দিল্লি। এ ছাড়া বোম্বাই ছিল একটি উন্নত বন্দরনগরী। স্বভাবতই সংবাদপত্রের প্রকাশনার কেন্দ্রভ‚মি ছিল কলকাতা-দিল্লি-মোম্বাই এবং আরও কয়েকটি বৃহৎ নগরী। এর মধ্যে করাচি এবং লাহোরও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে এই দুটি নগরীও ভারতবষের্র অন্যতম দুটি সংবাদপত্র প্রকাশনা কেন্দ্র। ঢাকা দেশ বিভাগের পূবর্পযর্ন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো সংবাদপত্র প্রকাশনা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি। বিভাগোত্তর পযাের্য় এসে আজাদ মনির্ং নিউজ প্রভৃতি পত্রিকাগুলো প্রকাশনার মধ্যদিয়ে ঢাকা ধীরে ধীরে তদানীন্তন পাকিস্তানের অন্যতম সংবাদপত্র প্রকাশনা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। আজ তা ফুলে-ফলে বিকশিত হয়েছে এবং এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র নগরী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।কিন্তু আমার আলোচ্য বিষয় মফস্বল সাংবাদিকতা। সংবাদপত্রের বিকাশের সঙ্গেই মফস্বল সাংবাদিকতার বিকাশ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই পূবর্বতীর্ প্যারায় তার ভ‚মিকা হিসেবে কিছু কথার উল্লেখ করতে হলো। ঢাকার বিভাগোত্তর যুগে অতি অল্পকালের মধ্যেই আজাদ, পাকিস্তান অবজারভার, সংবাদ, মনির্ং নিউজ, ইত্তেহার, ইত্তেফাক, আমার বাংলা, মিল্লাত প্রভৃতি দৈনিক পত্রিকা আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু শুরুতেই দৈনিক ইত্তেফাক ছাড়া, আর সবই মুসলিম লীগ সমথর্ক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কোনোটি শুরুতে চার পৃষ্ঠার, কোনোটি ছয় পৃষ্ঠার কোনোটি বা আট পৃষ্ঠা কলেবরে। প্রকাশনার প্রাথমিক পযাের্য় বিশেষত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পূবর্পযর্ন্ত পত্রিকাগুলোতে প্রাধান্য ছিল দেশের খবরের চেয়ে মুসলিম লীগ ও ওই দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের গুণকীতর্নমূলক সংবাদ, সম্পাদকীয় ও মন্তব্য প্রভৃতি প্রকাশ করা। এর ব্যতিক্রম কখনো কখনো ঘটত না তা নয়Ñ তবে তা একান্তই ব্যতিক্রম। ফলে দেশের সংবাদের প্রধান্য না থাকায় মুসলিম লীগের দলীয় সংবাদ প্রকাশের স্বাথের্ স্বভাবতই বিভিন্ন জেলায় সংবাদ পাঠাতে উৎসাহী মুসলিম লীগ নেতাদেরই নিয়োগপত্র দেয়া হতো। তারাই কোনো পারিশ্রমিক তো দূরের কথা সংবাদ পাঠানোর খরচ, কালি, কলম, কাগজ, খাম বা ডাক টিকেটের মূল্য বা ঘটনাস্থলে যাতায়াতের খরচও দেয়া হতো না। ফলে তৎকালীন মফস্বল সংবাদিকের ছিলেন একান্তই দলীয় এবং তারা পালনও করতেন দলীয় দায়িত্বই। এই অবস্থাটার মোড় ঘুরিয়ে দিল ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন বিশেষ করে তার পরে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ তার আগেই ১৯৪৮-এ পূবর্পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন প্রভৃতির মধ্যদিয়ে। ১৯৪৮ এই পাকিস্তানোত্তর প্রথম অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক’ যুবলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। কিন্তু দেশের বামপন্থীদের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে গঠিত এই যুব সংগঠনটি মুসলিম লীগ সরকারের নিমর্ম নিযার্তনের ফলে বেশিদিন টিকতেই পারেনি অকালমৃত্যুবরণ করতে হয় এই সংগঠনটিকে। ভারতবষর্ যখন বিভক্ত হয় তখন কিন্তু মুসলিম বেশ কটি বিরোধী দল পূবর্পাকিস্তানে কমর্রত ছিল। যেমনÑ পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পাটির্, র‌্যাডিকাল ডেমোক্রেটিক পাটির্ প্রভৃতি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত¡ তথা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতার কারণে জনগণের মধ্যে তার প্রভাবের ব্যাপক হ্রাস এবং তার সঙ্গে সরকারি তীব্র দমননীতি ওই দলগুলোকে কাযর্ত অবলুপ্তির পথে ঠেলে দেয়। তাই মুসলিম সরকারের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জনগণের কাছে দলটি দ্রæতই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিশাল ব্যাপ্তি, তার পূবর্ ও পরবতীর্ ধারাবাহিক ছাত্র আন্দোলন একই সালে দেশের প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন হিসেবে পূবর্পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম ও ত্বরিতগতিতে দেশব্যাপী তার বিস্তার লাভ, ১৯৫৩-তে আবার বামপন্থী অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন পূবর্পাকিস্তান যুবলীগ এবং প্রথম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল গঠন প্রভৃতি আমাদের দেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এক নতুন ও কল্যাণকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে সক্ষম হয়। এক কথায় সংবাদপত্রে তখন আমাদের দেশ ও আমাদের জনগণ ঠঁাই পেতে শুরু করে। আর সে কারণেই দেখা যায় সরকারি দলের লিফলেট নয় দেশের সংবাদপত্রগুলোতে একদিকে গণআন্দোলনের খবর জনজীবনের সমস্যা জজির্রত চিত্রগুলো স্থান পেতে শুরু করে।

মফস্বল সাংবাদিকরাও তাদের কলমকে সমমুখী করে তোলেন দেশের বাস্তবচিত্র পত্রিকায় পাবার তুলে ধরতে উদ্যোগী হন। একদলীয় সাংবাদিকতার স্থলে বহুদলীয় সাংবাদিকতার উন্মেষ ঘটে। সংবাদপত্রগুলোর সাম্প্রদায়িক চরিত্র পরিবতির্ত করে ধীরে ধীরে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধারণ করতে শুরু করে। বলাই বাহুল্য, তৎকালীন পূবর্-বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ একদিকে মুসলিম লীগ ও তার সরকার এবং তাদের দলীয় দশর্ন সাম্প্রদায়িকতাকে কোণঠাসা করে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিরায়ত ধারাকে নতুন করে বাঙালির জাতীয় আন্দোলনের মূলধারায় পরিণত করে তুলছিল এবং তারই আমলে পূবর্শতর্ বাঙালি মানুষ ও তার মানসকে সংবাদপত্রসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে সামনে টেনে আনছিল এক অভাবিত পূবর্ ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ করে। এরই প্রতিফলন ঘটছিল আমাদের জাতীয় সংবাদপত্রগুলোয় সাংবাদিকদের লেখনীয় মাধ্যমে। মফস্বল সাংবাদিকরাও এই কমর্কাÐে পিছিয়ে থাকেননি। ফলে ধীর লয়ে হলেও তারা সমাজে একটি স্থানও অধিকার করে নিচ্ছিলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

পঞ্চাশের দশকের প্রথমাধর্ আমাদের সংবাদপত্র এবং মফস্বল সাংবাদিকতার জগতে একটি উল্লম্ফন ঘটায়। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুখপত্র রূপে দৈনিক ইত্তেফাকের আত্মপ্রকাশ, মুসলিম লীগ কতৃর্ক প্রকাশিত দৈনিক সংবাদের প্রগতিশীল মালিকানায় হস্তান্তর এবং দৈনিক মিল্লাতসহ আরও কয়েকটি দৈনিকের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে আমাদের সংবাপত্র জগতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর প্রচারণার পরিবতের্ প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার প্রচার ও প্রসার মূল দশর্ন হিসেবে গণ-ভিত্তি অজর্ন করে। পাকিস্তান অবজারভারও এ ব্যাপারে ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই এই ধারায় অন্যতম প্রধান মুখপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর এ সব পত্রিকায় মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ পান প্রধানত প্রগতিচিন্তায় বিশ্বাসী তরুণেরা যারা ছিলেন নিঃস্বাথর্ দেশপ্রেমিক চিন্তার ধারক ও বাহক।

ফলে এদের পাঠানো প্রতিবেদনগুলো যেহেতু জনতার কাছাকাছি অবস্থান থেকে রচিত হতো সেগুলো পত্রিকার পৃষ্ঠায় পূবাের্পক্ষা বেশি গুরুত্বসহকারে ছাপাও হতো। কিন্তু সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর বৈষম্য (রাজনৈতিক কারণে) এবং মফস্বল সাংবাদিকদের এক এক ধরনের অবহেলাপূণর্ মনোভাব (মালিক ও ডেকে কমর্রত বেতনভ‚ক সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে) পোষণের ফলে মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য কোনো পারিশ্রমিক বা সংবাদ পাঠানো ও সংগ্রহের নিছক খরচটুকুও দেয়ার ব্যবস্থা ছিল না। তদুপরি মফস্বল সাংবাদিকরাও তাদের সামাজিক ও দেশপ্রেমিক দায়িত্ব হিসেবে পত্রিকায় খবর পাঠাতেন বলে তারাও কোনো পারিশ্রমিক বা অনুষাঙ্গিক ব্যয়াদি দাবিও করতেন না। ফলে মফস্বল সাংবাদিকরা ধীরে ধীরে সমাজে এবং পত্রিকার কাছে গুরুত্বপূণর্ শক্তি হিসেবে আবিভ‚র্ত হলেও মফস্বল সাংবাদিকতা আদৌ পেশাগত ভিত্তি অজর্ন করছিল না কোনো মহলের চিন্তার ক্ষেত্রে। তবে মফস্বল সাংবাদিকতার এই নব উন্মেষলগ্নে বেশ একগুচ্ছ তরুণ সাংবাদিক তৈরি হচ্ছিল পূবর্-বাংলার বিভিন্ন জেলায়। অথৈর্নতিক প্রশাসনিক গুরুত্ব বিবেচনায় এদের কাউকে কাউকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে চট্টগ্রাম, খুলনা প্রভৃতি বড় বড় শহরে (ঢাকার বাইরে) সাবর্ক্ষণিক পাঠক হিসেবেও নিয়োগ দেয়া শুরু হয়।

ইতোমধ্যে দেশ বিভাজন সৃষ্টি হয়ে যায় ঢাকায় কমর্রত সাংবাদিক এবং মফস্বল কমর্রত সাংবাদিকদের মধ্যে। প্রথমোক্ত অংশ অধিকতর গুরুত্বপূণর্ বলে সরকার ও মালিকপক্ষ কতৃর্ক বিবেচিত হতেন মফস্বল সাংবাদিকরা গুরুত্বপূণর্ অবদান রাখলেও গুরুত্বহীন ও খানিকটা যেন অপাঙ্ক্তেয় তাই বেতন-ভাতাহীন। ডেকে যারা কাজ করতেন তাদেরও অবশ্য বেতন ছিল অবিশ্বাস্য রকমের কম এবং তা দেয়া হতো অত্যন্ত অনিমিতভাবে। তবুও তাদের গুরুত্বটা ছিল স্বীকৃত মযার্দাও ছিল সব মহলে। সাংবাদিকতার দিনগুলো এভাবেই চলতে চলতে ওই দলেরই দাবি ওঠে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতার কাঠামো নিধার্রণ করতে হবে। দাবিটি তোলেন পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-পূবর্পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রভৃতি। এগুলো হলোÑ কমর্রত সাংবাদিকদের অথার্ৎ বেতনভুক্ত সাংবাদিকদের অথার্ৎ সাবর্ক্ষণিক সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান। ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে স্বীকৃত ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত। এরা এই আন্দোলন চালাতে চালাতে আইয়ুবের সামরিক শাসন আসে। সামরিক শাসকদের কাছেও এ দাবি উত্থাপিত হয়। আন্দোলনের এক পযাের্য় দাবিটি স্বীকৃত হয় এবং কমর্রত সাংবাদিকদের বেতন বোডর্ গঠিত হয়। এই বোডের্র রোয়েদাদ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালের শেষ দিকে। সাংবাদিকদের আন্দোলনের প্রথম বিজয় হয়। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য মফস্বল সাংবাদিকরা সংঘঠিত না হওয়ায়, তারা এ জাতীয় কোনো দাবি উত্থাপন না করায় এবং অন্যপক্ষে তারা বেতনভুক্ত নন এবং সেই অথের্ কমর্রত সাংবাদিকদের সংজ্ঞার আওতায় তারা পড়েন নাÑ এ সব কারণে সাংবাদিক বেতন বোডের্র রোয়েদাদে তাদের জন্য কোনো বেতন স্কেল প্রভৃতি নিধাির্রত হয়নি। তবে জেলা সংবাদদাতাদের জন্য একটি লাইনেজ, রিটেইনার ভাতার (নাম মাত্র) ওই রোয়েদাদে বিধান রাখা ছিল। ঢাকার পত্রিকাগুলোতে এই রোয়েদাদের পূণর্ রায় ছাপা হলে তা আমাদের নজরে পড়ে ডিসেম্বর ১৯৬০-এ। তখন আমরা পাবনায় প্রথম উদ্যোগ নিই ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে রাজশাহী-খুলনা বিভাগীয় মফস্বল সাংবাদিকদের সম্মেলন অনুষ্ঠানের। এ খবর ঢাকার সংবাদগুলোতে ভালোভাবেই ছাপা হয়। খবরটি ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুরা পড়া ও জানার পর তারা পাকিস্তান অবজারভারের রংপুর সংবাদদাতা আবু সাদেকের সঙ্গে আলাপ করেন এবং আমার কাছে আবু সাদেকের (প্রয়াত) মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠান ওটাকে বিভাগীয় সম্মেলনের পযাের্য় রেখে পূবর্-পাকিস্তান প্রাদেশিক মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলনের রূপ দিতে। আবু সাদেক এই প্রস্তাবে নিয়ে পাবনা আসেন ক’দিন অবস্থান করেন এবং দফায় দফায় আলোচনার পর প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। আহŸান করা হয় পূবর্-পাকিস্তান মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলন প্রথমবারের মতো আমাদের দেশে। পাবনায় এই সম্মেলন ১৯৬১ সালে অনুষ্ঠিত হয় ৮ ও ৯ মে তারিখে। বনমালী ইনস্টিটিউটে। পাবনার সাংবাদিকরা এবং পাবনাবাসী চিরকালের জন্য এ গবর্ তাদের বুকে ধারণ করতে পারেন। পারেন পূবর্-বাংলার সব মফস্বল সাংবাদিকই। আসল কথায় ফিরে আসি। এই সম্মেলনে যে দাবি সবর্সম্মতিভাবে গৃহীত হয়েছিল তা হলোÑ মফস্বল সাংবাদিকদের কমর্রত সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। যতদিন তা না হয় ততদিন সাংবাদিকদের প্রথম বেতন বোডর্ রোয়েদাদে জেলা সংবাদদাতাদের জন্য যে বেতন-ভাতা প্রভৃতির বিধান রাখা হয়েছে তা অবিলম্বে সব মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য কাযর্কর করতে হবে। মফস্বলের সংবাদ প্রতিদিন প্রতিটি দৈনিকে অন্তত ৮ কলাম করে ছাপতে হবে। মফস্বল সাংবাদিকদের প্রেরিত সংবাদ অধিকতর গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করে। আর দাবি তোলা হয় সব মফস্বল সাংবাদিককে সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্যপদ দিতে হবে এবং তার মাধ্যমে সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী সাংবাদিকদের একটি মাত্র সংগঠনের পতাকাতলে সমবেত করতে হবে। সাংবাদিকদের ব্যাপকতম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবং পূবর্-বাংলার সব সাংবাদিকের জন্য বেতন বোডের্র রোয়েদাদে প্রকাশিত বিধানগুলো বাস্তবায়নের দাবি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সব মফস্বল সাংবাদিককে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সবর্সম্মতিক্রমে ‘পূবর্-পাকিস্তান মফস্বল সাংবাদিক সমিতি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হলো। এই সংগঠনের নাম পরবতীের্ত রাখা হয় পূবর্-পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতি যা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি নাম পরিগ্রহ করে। এই সম্মেলন প্রস্তাব কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন প্রয়াত একেএম আজিজুল হক এবং সাধারণ সম্পাদক রণেশ মৈত্র (বতর্মান নিবন্ধের লেখক)। সমিতিটির প্রথম সভাপতি ও নিবাির্চত হয়েছিলেন আজিজুল হক সাহেব আমি নিবাির্চত প্রথম যুগ্ম সম্পাদক। সাধারণ সম্পাদক নিবাির্চত হয়েছিলেন কুমিল্লার এম বশারতুল্লাহ্ (প্রয়াত)। সম্মেলনে বিপুলভাবে সহায়তা করেছিলেন পূবর্-পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন ও পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন কমর্কতার্। তার মধ্যে তৎকালীন ঊচটঔ সভাপতি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, ঊচটঔ’র যুগ্ম সম্পাদক কেজি মুস্তাফা এবং অন্যতম নেতা এবিএম মুসার নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে এসেছিলেন পাকিস্তান অবজারভারের স্বনামধন্য সম্পাদক আবদুল সালাম ও মনির্ং নিউজের সম্পাদক এসজিএম বদরুদ্দিন। অপরিহাযর্ কারণে শেষ মুহ‚তের্ এই সম্মেলনে আমার কমর্সূচি বাতিল করতে বাধ্য হয়েও বিপুলভাবে সহযোগিতা করেছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জুল হোসেন মানিক মিয়া এবং দৈনিক সংবাদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী। এই সম্মেলন থেকে জোরকণ্ঠে দাবি তোলা হয়েছিল নিরাপত্তা আইনে আটক সব সাংবাদিক ও রাজবন্দিদের মুক্তি, নিরাপত্তা আইন ও প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অডির্ন্যান্সসহ নাগরিক ও মানবাধিকার হরণকারী সব আইন বাতিল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের পূণর্ স্বাধীনতা প্রভৃতির। সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হাবিবুর রহমান। এই সম্মেলনে তখনকার উল্লেখযোগ্য প্রায় সব দৈনিক পত্রিকারই বাতার্ সম্পাদক বা মফস্বল সম্পাদকরাও এসেছিলেন। তারা সারা পূবর্-পাকিস্তান থেকে আসা নিজ নিজ সংবাদদাতাদের নিয়ে পৃথক পৃথক বৈঠকও করেন এবং তাদের সংবাদ ও তা পরিবেশনের মান প্রভৃতি নিয়েও আলোচনা করেন। প্রচÐ চাপ দেয়া হয় পারিশ্রমিকের ওপর, চাপ দেয়া হয় মফস্বল সংবাদের জন্য অধিকতর ঝঢ়ধপব এবং সেগুলো গুরুত্বসহকারে প্রকাশের ব্যাপারে। এ সব ব্যাপারে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার অঙ্গীকারও পাওয়া যায়। সংবাদপত্র প্রদশর্নী, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি খুবই আকষর্ণীয় হয়। এই সম্মেলনের পর থেকে মফস্বল সংবাদ সব দৈনিক পত্রিকাতেই গুরুত্বসহকারে ছাপা হতে শুরু করে। প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠাতেও মফস্বল সংবাদ স্থান পেতে থাকে। সবর্ত্র সাংবাদিক সমিতির শাখা গঠিত হতে থাকে বিপুল উদ্যমে। মফস্কল সাংবাদিকদের কমর্রত সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দান এবং স্বীকৃতি সাপেক্ষে বেতন বোডর্ রোয়েদাদে জেলা সংবাদদাতা হিসেবে যে সম্মানী ও রিটেইনার প্রভৃতি প্রদানের বিধান কাযর্কর করার দাবিতে সবর্ত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে একই সঙ্গে ওই আন্দোলনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, বন্দিমুক্তি প্রভৃতির দাবিও। একপযাের্য় পূবর্-পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নও মফস্বল সাংবাদিকদের এই দাবির প্রতি আনুষ্ঠানিক সমথর্ন জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সমিতির পক্ষ থেকে ঢাকায় সব পত্রিকা ও বাতার্ সংস্থার মালিক সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি নামাসহ স্মারকলিপি পেশ করা, আলোচনা করা ইত্যাদিও চলতে থাকে। ফলও বেশ অল্পদিনের মধ্যেই সম্মেলনের ২/১ বছরের মধ্যেই পাওয়া শুরু হয়। অবজারভার ও ইত্তেফাক সবর্প্রথম এই দাবি মেনে নেয়। এভাবে প্রতিটি যাত্রা শুরু হয়। পরে মনির্ং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তানও রোয়েদাদটি এভাবেই ধীরে ধীরে অনেক পত্রিকাতেই কোথাও পুরোপুরি কোথাও আংশিকভাবে ওই রোয়েদাদের বিধানগুলো কাযর্কর করা হয়। অন্যান্য প্রায় সব পত্রিকাই সংবাদ পাঠানোর খরচসহ কিছু কিছু সম্মানী হিসেবে দিতে শুরু করে। এই বিজয় পাবনা সম্মেলনের পাবনায় গঠিত সমিতির এবং এর মূল উদ্যোক্তা পাবনার সাংবাদিকদের এগুলো অজির্ত হয় পাকিস্তান আমলেই ষাটের দশকেই। কিন্তু মূল দাবিটি মফস্বল সাংবাদিকদের কমর্রত সাবর্ক্ষণিক এবং বেতনভুক্ত সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতির দাবি আজও উপেক্ষিত। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বহু নতুন পত্রিকার জন্ম হয়েছে। আগেকার ওই আন্দোলনের ফল হিসেবে ওই সব পত্রিকার মধ্যে যেগুলো প্রধান তারাও মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়ার বিধান চালু করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাংবাদিক সমিতিটি দুঃখজনকভাবে ব্যক্তির পকেটে চলে যাওয়া, আন্দোলন সংগঠন না করায় অসংখ্য সংগঠন (মফস্বল সাংবাদিকদের) গড়ে ওঠায় এবং সবোর্পরি স্বৈরাচারী সামরিক শাসককে দিয়ে জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করার প্রশ্নে সংগত ভিন্নতর অগ্রাহ্য করায় কাযর্ত সংগঠনটি এসে বিক্ষুপ্তির পথে চলে যায় অত্যন্ত দুঃখজনভাবে। আজ মফস্বল সাংবাদিকরা জাতীয় ভিত্তিতে অসংগঠিত, অনৈক্যের শিকারে অসহায়ভাবে পরিণত। তাই মফস্বল সাংবাদিকদের কোনো আন্দোলন নেই নতুন কোনো অজর্নও নেই। এ এক দুঃখজনক পরিস্থিতি। মূল কথা হলো সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে সাবর্ক্ষণিক ও বেতনভুক্ত এবং জবাবদিহিতার আওতায় তাকে আনতে হবে। উপযুক্ত এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। আজকের পরিস্থিতি কী করুণ। যশোরের শামছুর রহমান, সাইফুল ইসলাম মুকুল, টিপু সুলতান, প্রবীর শিকদার এবং আরও অসংখ্য সাংবাদিক গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে খুন হচ্ছে, আহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কাযর্কর আন্দোলন নেই প্রতিরোধ নেই। ঢাকার সাংবাদিকরা দলীয়ভাবে বিভক্ত। তাই আজ তারা স্মারকলিপি দিয়ে মুখরক্ষা করছেন। অত্যন্ত পীড়িত বোধ করছি প্রয়োজন বোধ করছি নতুন করে ঐক্য ও সংগঠন গড়ার। কেউ কি এগিয়ে আসবেন? আজ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মালিকের স্বীধনতায় অনেকটাই পরিণত সাংবাদিকের স্বাধীনতা এখনো অজের্নর অপেক্ষায়। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এখনো নবনিমির্ত। এ সব বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয় ও পেশা হিসেবে তার স্বীকৃতি এ দেশে জাতীয় ও সুস্থ সাংবাদিকতার বিকাশের স্বাথের্ই। হলুদ সাংবাদিকতা- ইষধপশসধরষরহম-এর সাংবাদিকতার অস্তিত্ব অনস্বীকাযর্ যদিও তা আজও অনুল্লেখযোগ্য পযাের্য় আছে। কিন্তু সেগুলো দূর করতে হলে বা ওই পথে কোনো সাংবাদিক যাতে অগ্রসর না হন সেদিকে এগোতে হলে তার পূবর্শতর্ই হবে সাংবাদিকতাকে পেশাগত ভিত্তির ওপর অবিলম্বে দঁাড় করানো। হানাহানিসহ এখনো বেশ কিছু আইন আছে যা আমাদের কলমের এবং সত্য প্রকাশের পরিপন্থী। এগুলোকে বাতিল করার কাজও রাখছি না আমরা। অনেকাংশে আমরা অনেকে নিরাপত্তা হারিয়ে ফেলেছি সংকীণর্ দলীয় অথবা স্বাথির্সদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। নিরপেক্ষ অথর্ এ নয় যেÑ আমরা ভালো এবং মন্দকে এক দৃষ্টিতে দেখব বা আলো ও অন্ধকারকে সমান মূল্য দেবো। আমরা অবশ্যই থাকব সত্য, ন্যায় ও আলোর পক্ষে নীতির পক্ষে- মিথ্যা, অন্যায় ও অন্ধকারের বিপক্ষে। আমরা যে ভালো তাকে ভালো বলবোÑ যে খারাপ তাকে খারাপ বলবো। আমরা হবো দলনিরপেক্ষ-নীতি নিরপেক্ষ নয়। নইলে নীতি-আদশর্ বিদুরিত হবে। বিদায় নিচ্ছে অথবা পঙ্গু হচ্ছে শামছুর রহমান, মুকুল, টিপু সুলতান ও প্রবীর সিকদারেরা। তারা আমাদেরই ভাই-এ কথা মুখে বলাই কি যথেষ্ট? ভাবতে হবে সবাইকে গভীরভাবেই ভাবতে হবে।

রণেশ মৈত্র : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

ৎধহবংযসধরঃৎধ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<18906 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1