শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রয়োজন ‘অফিস সহকারী’ অথচ তৈরি হচ্ছে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’-এর ফঁাদ

শিক্ষকের উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার সাবির্ক উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে আনন্দের সঙ্গে, তৃপ্তির সঙ্গে পাঠদানের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নানা ধরনের কাজের জন্য ‘অফিস সহকারী’ এখন সময়ের দাবি।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ০২ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

এ জাতির ইতিহাস রক্তদানের ইতিহাস। রক্ত ছাড়া এ জাতি কিছুই অজর্ন করতে পারেননি। এ দেশের প্রতি ধূলিকণায় আত্মত্যাগ আর রক্তদানের কাহিনী লেখা আছে।

স্বাধীনতা, ভাষা থেকে শুরু করে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী যে কোনো আন্দোলন এবং সফলতার নেপথ্যে আছে জীবন উৎসগের্র ইতিহাস।

৪৭ বছরের রাষ্ট্র আমাদের। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে। অচিরেই উন্নত দেশে পা রাখার স্বপ্ন আমাদের চোখে।

এই তো কিছু দিন আগে সরকারের উন্নয়নের সাফল্য তুলে ধরে দেশব্যাপী হয়ে গেল উন্নয়ন মেলা। এই উন্নয়ন মেলায় সারা দেশের বিভিন্ন অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠান তাদের স্টল নিয়ে, উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেছে দেশবাসীর সম্মুখে। এই উন্নয়ন মেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’।

এবার প্রশ্ন হলোÑ দেশের সবচেয়ে অবহেলিত, বৈষম্যমূলক অবস্থার শিকার যে ‘প্রাথমিক শিক্ষকসমাজ’ সেই অধিদপ্তর কেন প্রথম হবে? আর এই অধিদপ্তর যদি প্রথম হয় তা হলে ৪৭ বছরের অচলায়তন বৈষম্য কেন নিরসন হয় না, বরং দিন দিন কেন এই বৈষম্য বেড়েই চলে?

শিক্ষা ভিত্তি প্রাথমিক স্তর। শিক্ষার উন্নয়নের সামগ্রিক চিত্র অবলোকন করতে গেলে দৃষ্টি দিতে হবে প্রথম প্রাথমিক শিক্ষার দিকে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে অনেকেই একসঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু মূল যারা তারা ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষাথীর্।’

সদ্য স্বাধীন দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষাকদের মেধা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে নজর দেয়া সম্ভব ছিল না সংগত কারণেই। কিন্তু একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া ধাপে ধাপে উন্নয়নের সিঁড়ি অতিক্রম করা দেশে শুধু এসএসসি পাস থাকেনি প্রাথমিক শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ অতিক্রম করা শিক্ষাথীর্রা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ উন্নত দেশের শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণসহ নানা দিক দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকরা আজ অনেক পরিণত এবং দক্ষ। কিন্তু মেরুদÐ সোজা করে, সত্য এবং ন্যায়ের জন্য, উন্নত জীবনমান নিয়ে মাথা উঁচু করে বঁাচার জন্য যে নিভীর্ক শিক্ষক প্রয়োজন তা অনুপস্থিত। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সরকারি ড্রাইভারের স্কেলের বেতনের চেয়ে কম। এক পযের্লাচনায় দেখা গেছে, সুইপারের চেয়েও নিচের ধাপে প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন। (কারও পেশাকে ছোট করা উদ্দেশ্য নয়)।

অন্যান্য সরকারি কমর্চারী থেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা কম। কারণ হিসেবে বলা হয়Ñ এটা ভ্যাকেশনাল ডিপাটের্মন্ট। ৭৫ দিন সরকারি ছুটির তালিকা প্রতি বছর প্রকাশ করা হলেও সপ্তাহে একদিন ছুটি, বিশেষ দিবসগুলো পাঠদান কাযর্ক্রম স্থগিত হলেও নানা আনুষ্ঠানিকতায় নিধাির্রত সময়ের চেয়েও দ্বিগুণ কমের্ক্ষত্রে অবস্থান সব মিলিয়ে যারা ননভ্যাকেশনাল ডিপাটের্মন্ট তাদের চেয়ে অনেক কম প্রাথমিকের শিক্ষকদের ছুটি। ভ্যাকেশনাল ডিপাটের্মন্ট নামে এক শুভংকরের ফঁাকি এই ৭৫ দিন ছুটি।

শিক্ষকদের অবহেলা আর বৈষম্যের চিত্রটা অনেক পুরনো সাহিত্য সমাজের দপর্ণ। আমাদের সাহিত্য শিক্ষকের ললাটে অংকন করেছে ‘সামান্য’ নামক বিশেষণ। কালজয়ী চরিত্র ‘পÐিতমশাই’ আর ‘তালেব মাস্টার’। শিক্ষকদের জীবনমান বিশ্লেষণে এ চরিত্র আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। উল্টো যে চরিত্র সমাজে বিদ্যমান তার পথটাও উল্টো, সহজ পথে শিক্ষকদের জীবনমান অতিক্রম করতে পারেনি তালেব মাস্টারের দুঃসহ জীবন।

ফিরে আসি আন্দোলন প্রসঙ্গে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলন, পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। ক্ষুদিরামের ফঁাসি, নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সংগ্রামসহ নানা বিপ্লবের কাহিনী শিক্ষক তার শিক্ষাথীের্দর কাছে তুলে ধরেন।

অথচ শিক্ষকদের শত শত বছরের বৈষম্যের, দারিদ্র্যের, অবহেলার যে চিত্র তা বদলের জন্য যে আন্দোলন তা এতগুলো বছরে আন্দোলনই হয়ে উঠতে পারেনি। ‘শিক্ষক’ শব্দটির মধ্যেই মেরুদÐ সোজা, সত্য প্রকাশের নিরঙ্কুশ সাহস, মাথা উঁচু করে সম্মান এবং মযার্দার সঙ্গে বঁাচা বোঝায়। শিক্ষক নামক শব্দটির সঙ্গে তোষামোদ, দালালি এই শব্দ দুটি সাংঘষির্ক। কিন্তু যুগে যুগে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে, গুরু নামক শব্দটির তাৎপযর্ সমাজের কাছে তুলে ধরতে, দরিদ্র্যতার করাল গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করতে শিক্ষক সমাজ যখনই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের সম্মান এবং মযার্দার কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন তখনই এই শিক্ষকদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছে একদল প্রতারক, বেইমান। পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি আর দ্ব›েদ্বর কারণে এই ৪৭ বছরেও শিক্ষকের শিক্ষক হয়ে ওঠা হয়নি। একটি যৌক্তিক আন্দোলন, সংখ্যায় যারা সরকারি কমর্চারী হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের নেতৃত্ব থাকবে একটা সংগঠনের হাতে। অথচ অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের জালে আটকে পড়া শিক্ষকরা একাধিক নেতৃত্বের কারণে বিভক্ত। তৃতীয় শ্রেণির কমর্চারী সহকারী শিক্ষকরা। তৃতীয় শ্রেণির গুরু দিয়ে প্রথম শ্রেণির আত্মমযার্দা বোধসম্পন্ন জাতি গঠনের স্বপ্ন আমরা কীভাবে দেখবো?

সহকারী এবং প্রধান শিক্ষকরা একসঙ্গে শুরু করেছিল একটি যৌক্তিক আন্দোলন। প্রধান শিক্ষকদের দাবি মেনে নিয়ে সহকারী শিক্ষকদের দমন করার এক সূ² চাল চালা হয় এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। সততা আর প্রকৃত শিক্ষকের পরিচয় দিলে প্রধান শিক্ষকরা এই প্রাপ্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন। কারণ একই উদ্দেশ্য নিয়ে সহকারী এবং প্রধানদের যে পথচলা তা একই সঙ্গে বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই সততা প্রদানে প্রধান শিক্ষকসমাজ ব্যথর্ হয়ে তারা স্বাথর্পরতার স্বাক্ষর রাখল।

সহকারী শিক্ষকদের দাবি প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপেই তাদের বেতন নিধার্রণ করতে হবে। এই দাবিকে না মেনে ভিতরে ভিতরে আবার সূ² চাতুযের্র জাল বিছিয়ে শুরু করা হয়েছে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ পদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০টির উপরে নানা ধরনের রেজিস্টার। তার উপর আছে আবার উপবৃত্তির মাথা খারাপ করার কাজ। শিশু জরিপ, নিবার্চন, হোম ভিজিট, নানা দিবস পালনসহ হাজারটা কাজে লেখাপড়া ছাড়া অন্যসব কাজই নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করতে শিক্ষকদের বাধ্য করা হয়।

একজন ‘অফিস সহকারী’ এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন। অথচ তা না দিয়ে শিক্ষকদের জন্য তৈরি হচ্ছে নিযার্তনমূলক পদ ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক।’

যে পদোন্নতি আটকে আছে যুগের পর যুগ সে পদোন্নতি চালু হলে সহকারী শিক্ষকের পরের পদ প্রধান শিক্ষক। কিন্তু এই নতুন পদ চালু হলে ‘সহকারী’র পরের পদ হবে ‘সহকারী প্রধান’, তারপর ‘প্রধান’। ফলে আরও উচ্চ পদে যাওয়া একজন্মে আর সম্ভব হবে না। একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্যসব ক্ষেত্রে পদোন্নতি পেয়ে বন্ধুরা যখন চলে যায় শীষের্। গাড়ি, বাড়ি, সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি নিশ্চিন্ত জীবন কাটায়, ঠিক তখন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শেষ জীবনে মেয়ের বিয়ে, নিজের চিকিৎসা খরচের জন্য স্কুলে স্কুলে হাত পাতে সাহায্যের জন্য। একজন মেধাবী শিক্ষাথীর্র কাছে এ দেশ, এ জাতি কেন আশা করবে সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে চির অসম্মান আর দারিদ্র্যকে ধারণ করবে জীবনে?

এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষক তার মযার্দা রক্ষার আন্দোলনে যখন পুলিশের পিপার স্প্রের কারণে মৃত্যুবরণ করে তখন সেটা আন্দোলনে মৃত্যু হয় না। সেটা হয় দুবর্ল শরীরের অপুষ্টির মৃত্যু। বিভক্ত করো, শাসন করো শিখিয়ে ছিল ব্রিটিশরা। অসংখ্য শিক্ষক সংগঠন, সহকারী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষকদের পারস্পরিক দ্ব›দ্ব শিক্ষকদের চাটুকারী মনোভাব, জি হুজুর শিক্ষক ৪৭ বছরেও পরিবতর্ন আনতে পারেনি প্রাথমিক শিক্ষকদের ললাটে। নানা ধরনের বৈষম্য অথোর্পাজের্নর বঁাকা পথ সৃষ্টিতে শিক্ষকদের ঠেলে দিয়েছে অসততার পথে।

গত বছর তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে ছুটে এসেছিল হাজার হাজার শিক্ষক। প্রতিশ্রæতির আর আশ্বাসের বাণী দিয়ে তাদের পাঠিংে দেয়া হয়েছিল কমের্ক্ষত্রে। এক বছর পর ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’-এর চাতুযর্ যদি প্রাপ্তি হয় তা হলে এ দায় কে নেবে? ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, দেশের শীষর্ নেতৃত্ব, পরিকল্পক প্রত্যেকেই তাদের উচ্চশিক্ষার ধাপ অতিক্রম করার শুরুটা করেছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে। শত শত বছরের বঞ্চনা ফুলেফেঁপে আজ যে বিশাল আকার ধারণ করেছে তা সমাজের কাছে তুলে ধরে এ অবস্থার পরিবতের্নর জন্য, শৈশবের শিক্ষাগুরুর মযার্দা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো দায়বদ্ধতাই কি নেই কারও?

পরিশেষে বলতে চাই,

শিক্ষকের উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার সাবির্ক উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে আনন্দের সঙ্গে, তৃপ্তির সঙ্গে পাঠদানের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নানা ধরনের কাজের জন্য ‘অফিস সহকারী’ এখন সময়ের দাবি।

প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপে সহকারী শিক্ষকদের বেতন নিধার্রণ করে এক বছর আগে দেয়া প্রতিশ্রæতির বাস্তবায়ন করে এ জাতিকে প্রমাণ দিতে হবে দুযোর্ধনই শুধু নয়, এ দেশের গুরুরা অজুের্নরও সৃষ্টি করতে সক্ষম।

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: কবি, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক ও শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<20446 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1