বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সংলাপ ও আসন্ন নিবার্চন

সংকটের সমাধান না হলে বিএনপি যে পথে চলার কথা বলেছে, তা কারো জন্যই সুখকর হবে না। অবাধ ও নিরপেক্ষ নিবার্চন অনুষ্ঠানের স্বাথের্ সরকারকে কঠোর হস্তে আইনশৃৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে হবে। নিবার্চন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সরকার গ্রাহ্য করবে না। সব ধরনের সহিংস তৎপরতা দেশ ও জাতির স্বাথের্ সরকারকে দমন করে নিবার্চন দিতে হবে। এ ব্যাপারে মূল বিরোধী দল বিএনপির কাছ থেকে জনগণ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করে। হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, সম্পদ ধ্বংসের রাজনীতি জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে না।
ডা. এস এ মালেক
  ০৮ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

নিবার্চন তো হতেই হবে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে যথাসময়ে নিবার্চন হতে হবে। যারা সরকার পরিচালনা করছেন এটা তাদের আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব। একই কারণে কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নিবার্চন অনুষ্ঠিত করতে হয়েছিল। তখন মূল বিরোধী দল বিএনপি নিবার্চনে অংশগ্রহণ না করে রাজপথে দেশব্যাপী যে সহিংসতা ও ববর্রতার আশ্রয় নিয়েছিল, তার পরিণতি তাদের আজও ভোগ করতে হচ্ছে। তাই মনে হয় একইভাবে ও একই কারণে তারা এবার নিবার্চন বজর্ন করবে না। পরিবেশ যতই প্রতিক‚ল হোক না কেন, নিবার্চনে তাদের অংশগ্রহণ নিতেই হবে। বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত হলে বিএনপি নিবার্চনে যাবে, আর মুক্ত না হলে নিবার্চনে যাবে নাÑ এটা কোনো আইনসংগত রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। যেহেতু রাজনৈতিক কারণে বেগম খালেদা জিয়া কারারুদ্ধ হননি, তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তাকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো আর আদালতকে নিদের্শ দিতে পারেন না যে, সাজা প্রত্যাহার করে বেগম জিয়াকে ছেড়ে দিন। এ পযর্ন্ত পেঁৗছাতে হলে বিএনপি ও তার নেতৃবৃন্দকে সরকারের সঙ্গে অবশ্যই সমঝোতা করতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বাথের্ সমঝোতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নেয়া হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশেও এর নজির রয়েছে। আলোচনার পূবের্ শতাের্রাপ, আলোচনা ব্যথর্ হলে সশস্ত্র সংগ্রাম করার এইরূপ হুমকির মুখে আর কেউ হন না কেন শেখ হাসিনাকে নতিস্বীকার করানো সম্ভব নয়। তা শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের অনেক দেশেও উপলব্ধি করতে পেরেছে। তবে এ কথাও ঠিক শেখ হাসিনা যেমন কঠিন ও কঠোর অন্যদিকে একই ভাবে বিনয়াবনত। এ পযর্ন্ত বাস্তব যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে করে নিবার্চন, সবার অংশগ্রহণে না হলেও অধিকাংশের অংশগ্রহণে যে অনুষ্ঠিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা ছাড়া ক্ষমতাশীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়া যেসব দল নিবার্চনে অংশগ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতেই নিবার্চন অংশগ্রহণমূলক হবে। ফলে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নিবার্চন অনুষ্ঠিত হলে অবশ্যই তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তবে এ কথাও ঠিক বিএনপি একটা বড় দল। তার সমর্থকও রয়েছে প্রচুর। তাই দলটি নিবার্চনে যদি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে নিবার্চনের কিছুটা অঙ্গহানি তো হবেই। সরকারি দল থেকে বলা হয়ে আসছিল যে, নিবার্চনের পূবের্ কোনো সংলাপের প্রয়োজন নেই। এই বক্তব্য রাজনৈতিক সুলভ ছিল কিনা তা নিয়ে কারো কারো মনে প্রশ্ন উঠেছিল।

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বাস্তবতার নিরিখেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মনে হয় সরকারি দল থেকে সংলাপ না করার যেসব কথা-বাতার্ বলা হয়েছে, তা ছিল একেবারেই কৌশলগত। সংলাপ করা হবে না এইরূপ বক্তব্যের বিপরীতেই বিএনপি সংলাপ করার পক্ষে বারবার জোর দাবি জানিয়ে আসছিল। শেখ হাসিনা একজন সুকৌশলী রাজনীতিবিদ। তার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এ পযর্ন্ত তার বিরোধীরা কোথাও যুক্তিতকের্ পেরে ওঠেনি। হঠাৎ করে সংলাপে রাজি হওয়ার যে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন, তার প্রতিপক্ষ বিএনপিকে বেশ কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে। বিগত কয়েকদিন হলো সংলাপ শুরু হয়েছে। এতে সরাসরি বিএনপির নেতৃত্ব বলতে যা বোঝায়, তারা সংলাপে অংশগ্রহণ করলেও বিরোধী দল থেকে ওই সংলাপে যিনি মূল ভ‚মিকা পালন করেছেন, তিনি একসময়ে ছিলেন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। তিনি এমন মাপের নেতা যিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু বলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদশের্ক বুকে ধারণ করেন। তিনি যখনই ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে আসলেন, তখনই আওয়ামী লীগ সংলাপে বসার জন্য সাড়া দিয়েছে। এমনকি সাংবিধানিক ধারায় যুক্তিপূণর্ সমঝোতায় পেঁৗছাতেও রাজি আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি কি তাদের পূবের্র অবস্থানেই থাকবে? না ঐক্য প্রক্রিয়ার ফ্রন্ট গঠনের পর নতুন আঙ্গিকে যুক্ত হয়ে সরকারি দলের সঙ্গে সমঝোতা করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কিছুটা নতিস্বীকার করে হলেও তিনি সংলাপ না করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন, দেশের বৃহত্তর স্বাথের্। তিনি বিরোধী দলকে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টির সুযোগ দিতে চান না। এ কথা ঠিক বিএনপি নিবার্চন বজর্ন করে রাজপথে সংগ্রাম করে আর নিবার্চনে গিয়েও সশস্ত্র সন্ত্রাস করলে উভয় ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের প্রকৃতি একই রকম হবে না। প্রধানমন্ত্রী চান দেশের চলমান উন্নয়ন ধারা যেন কোনো প্রকারে ব্যাহত না হয়। বিরোধী দল রাজপথে প্রতিবাদী আন্দোলন করছে এবং আগামীতেও করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে। তবে সে আন্দোলন যেন সম্পদ বিধ্বংসী না হয়। উন্নয়নের গতি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ করতে স্বীকৃতি জানান। এ কথা সত্য ঐক্য প্রক্রিয়া গঠনের পর দলকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন তিনি। কারণ বিএনপি তো ছিলই, বিএনপির গতি-প্রকৃতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী অবগত আছেন। কিন্তু ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপি যোগদান করায় ও এমন কিছু ব্যক্তি ঐক্য প্রক্রিয়ার ফ্রন্টের সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছে, যারা মূলত সহিংস রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের সঙ্গে সংহতিতেও বিশ্বাসী নন। তাই তাদের সঙ্গে বসতে কোনো আপত্তি নেই। ড. কামাল হোসেন ঐক্য ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিলেও জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে সব সময়ের জন্য মেনে নিয়েছেন। ঐক্য ফ্রন্টের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরও তিনি ভালো করেই জানতেন এ ব্যাপারে বিএনপির অভিমত কী? এবং সেই অভিমতকে অগ্রাহ্য করে তিনি সমঝোতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি দিয়েছেন, তাতেও একাধিকবার জাতির জনক উল্লেখ রয়েছে। বিএনপি যে জোটভুক্ত হয়েছেন, সেই জোটপ্রধান ড. কামাল হোসেনের এই অভিমতে বিএনপির সরাসরি বিরোধিতা করা সম্ভব হয়নি। বরং এইরূপ একটা ব্যাপারে তাদের সহনশীল হতে হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও যদি এরূপ সহনশীলতা সৃষ্টি করা যায় এবং ড. কামাল হোসেন সব সময়ই বলে আসছেন তিনি স্বাধীনতার শত্রæ, জামায়াতের সঙ্গে নয়। তা যদি ড. কামাল হোসেন একসময় বাস্তবায়ন করতে পারেন এবং তাতে যদি আংশিক বিজয় বলে অভিহিত করা যায়, তবে সে বিজয়ের সাথর্কতার অংশীদার তো আওয়ামী লীগই হবে। যে ভাষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপ চলার সময়ে কথা বলেছেন, তা সংলাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধি দলের প্রায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল বিএনপি কিছুটা দ্বিমত পোষণ করলেও প্রথমবার সংলাপের পর দ্বিতীয়বার সংলাপে বসতে রাজি হয়েছে। সংলাপ সম্পকের্ যতদূর জানা গেছে, তাতে সফলতা নিশ্চিত বা অনিশ্চিত এরূপ বলা এখনো ঠিক হবে না।

সংকটের সমাধান না হলে বিএনপি যে পথে চলার কথা বলেছে, তা কারো জন্যই সুখকর হবে না। অবাধ ও নিরপেক্ষ নিবার্চন অনুষ্ঠানের স্বাথের্ সরকারকে কঠোর হস্তে আইনশৃৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে হবে। নিবার্চন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সরকার গ্রাহ্য করবে না। সব ধরনের সহিংস তৎপরতা দেশ ও জাতির স্বাথের্ সরকারকে দমন করে নিবার্চন দিতে হবে। এ ব্যাপারে মূল বিরোধী দল বিএনপির কাছ থেকে জনগণ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করে। হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, সম্পদ ধ্বংসের রাজনীতি জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে না।

এ অভিজ্ঞতা বাংলার জনগণকে এতই সচেতন করেছে যে, পূবের্র মতো ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করলে জনগণই তা প্রতিহত করবে। আর সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় ফিরে এলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পথ সহজ হবে। বিএনপি নেতৃত্ব বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান যে নজির স্থাপন করেছেন, তাহাই ওই দলটি জনগণের দুযোের্গর কারণ হয়ে দঁাড়িয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বিএনপি থেকে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে অপপ্রয়াস দলের একটা অংশ অব্যাহত রেখেছে তা কখনই সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যেই আদালত কতৃর্ক নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। মনে হয় দলের বৃহত্তর অংশ এই উপলব্ধিতে পেঁৗছে গেছে যে, বেগম জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান দলটিতে যে ধরনের নেতৃত্ব প্রদান করেছেন, তাই দলটির বতর্মান দুযোের্গর ঘনঘটার মূল কারণ। সময় ও সুযোগ এসেছে এই দুই নেতৃত্বকে দলের বাইরে রেখে দল পুনগর্ঠন করা। একই সঙ্গে জামায়াত বিবজির্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের মাধ্যমে দলটির সংস্কার সাধন করা যায়, তা হলে স্বাধীনতার সপক্ষে বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সহাবস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির যে দাবি উঠেছে সরকার হোক আর বিরোধী দলে হোক উভয় ক্ষেত্রে এ দেশের রাজনীতির চালিকাশক্তি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদশের্ বিশ্বাসী দলগুলোর মধ্যে পযার্য়ক্রমে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তা হবে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির বিজয়। রাজাকার, আল-বদর, আল-সামস্, মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আর কোনো দিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার না হতে পারে সেই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতায় পেঁৗছানো দরকার।

শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের অথৈর্নতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী কমর্সূচিই গ্রহণ করেননি, সুদীঘর্ একটা রাজনৈতিক সমাধানের চিন্তাও তিনি করে চলেছেন। তিনি দেশের মঙ্গল চান। দেশপ্রেমিক কোনো দল সরকারে বা বিরোধী দলে থাকুক, তাকে তিনি শত্রæভাবাপন্ন মনে করেন না।

তাই জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে সাবির্ক সমঝোতায় তিনি বিশ্বাসী। সুযোগ এসেছে বিএনপির মতো একটা সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী দলের সংশোধনের। বিএনপির নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কি ভাবছেন সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি তাদের ওপর নিভর্র করছে। সংলাপ ফলপ্রসূ হলে রাজনীতিতে টানির্ং পয়েন্ট ফিরে আসবে।

ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<21370 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1