শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আজ আমি ক্ষমার বিপক্ষে

বাঙালির সামগ্রিক জীবন আটকা পড়েছে ভীমরুল আর মৌমাছির বলয়ে। আমরা বরং মৌমাছিকে ভালোবাসতে পারি কিন্তু ভীমরুলকে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। মৌমাছি হুল ফোটালেও মধু দেয়। পক্ষান্তরে হত্যা ছাড়া ভীমরুলের দেবার কিছু নেই। অনেক রক্ত¯্রােত পেরিয়ে, ষড়যন্ত্রীদের ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে শুভকমর্পথে যে আজ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছেÑ সে পথ থেকে বাংলাদেশের গতিমুখ ফেরানো মোটেই সমীচীন নয়। এখন কোনো ক্ষমা নয়। সহমমির্তা বা করুণা প্রদশর্ন নয়। এখন আমাদের নিজেদের স্বাথের্ই নিমর্ম হওয়া দরকার। যে দুদর্মনীয় শত্রæ দুবর্ল হয়ে পড়েছে এখনই সুযোগ তাকে আরও দুবর্ল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া।
সৈয়দ জাহিদ হাসান
  ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

যার কিছু নেই, তার হারাবার ভয়ও নেই, কিন্তু যার কিছু আছে হারাবার ভয় তার জন্য খুবই বেদনার, মৃত্যুযন্ত্রণার মতোই পীড়াদায়ক। বাংলাদেশ এক সময় গরিব ছিল, সম্পদ ও সম্মানহীন ছিল। একজন ভবঘুরে নিঃস্ব মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা তখন অনায়াসেই দেয়া যেত। বিশ-পনেরো বছর আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশ কোনোভাবেই সমমযার্দার, সমউচ্চতার নয়। দুই বাংলাদেশের পাথর্ক্য আলো-অন্ধকারের, শান্তি-সন্ত্রাসের, সমৃদ্ধি ও সম্পদহীনতার। চিরপরাজিত মানুষ যখন একবার বিজয়ী হওয়ার সুযোগ পায় সে ঐতিহাসিক বিজয় তার মধ্যে এই স্বপ্ন সৃষ্টি করে যে, চেষ্টা করলেই বিজয়ী হওয়া সম্ভব, তখন তা পরাজিত করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ছুটে চলার গতি, বাংলাদেশের উচ্চাশা ও সীমাহীন স্বপ্নÑ বাংলাদেশকে যে মানসিক শক্তিদান করেছেÑ এই শক্তি বিনষ্ট হলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ অসুস্থ-পঙ্গু ঘোড়ার মতো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। ব্যাহত হবে বণির্ল জীবনের বহু বাসনা। তিমির এসে ঢেকে দেবে এর আলোর দিগন্ত, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির সুবণর্পদ্ম নয়, এ দেশের প্রান্তরে প্রান্তরে পড়ে থাকবে মানুষের লাশ, মনুষ্য রক্তের হোলি খেলায় চাপাতি হাতে নেমে পড়বে রক্তপায়ী বিকট জল্লাদ। পাখির ক‚জন নয়- ধষির্তার আতর্স্বরে ভরে উঠবে বাংলার বাতাস।

চারদিকে আজ পাপ স্বীকারের উৎকট উৎসব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকতে যাদের হাতের মুঠোয় লেগে থাকতো নিষ্পাপ মানুষের রক্ত, এখনো যাদের বিষদঁাতের ফঁাকে ফঁাকে লেগে আছে কুমারীদেহের থোকা থোকা মলিন মাংস, তারা আজ ক্ষমা চাচ্ছে পূবর্পাপের। তারা আজ সৎ মানুষের মুখোশ পরে হঁাটু গেড়ে বসেছে ফুটপাতে, রাজপথে, মঞ্চের মিলন মেলায়। এই সব চিহ্নিত পাপীদের পাপস্বীকার যতই আকষর্ণীয় হোক না কেন, ক্ষমা চেয়ে চেয়ে এদের মুখ থেকে যতই কৃত্রিম রক্ত ঝরে পড়–ক না কেনÑ আমি আজ ক্ষমার বিপক্ষে দঁাড়ালাম। এই মুহূতের্ ক্ষমা করা মানেই জেনে-শুনে নিজের সবর্নাশ করা। জেনে-শুনে শত্রæর হাতে জীবনবিনাশী বিষপান করার কোনোই মানে নেই। আমি কিছুতেই চিহ্নিত ঘাতকের হাতে অকারণে জীবন বিসজর্ন দিতে প্রস্তুত নই। আজ আমাকে যে যা-ই বলুক না কেনÑ স্বাধীকারের প্রশ্নে কিছুতেই আমি ক্ষমাশীল হতে পারি না। যে ক্ষমা মৃত্যু ডেকে আনবে, সমাজে জন্ম দেবে সীমাহীন সন্ত্রাস; যে ক্ষমতায় কবিতা মৃত্যুবরণ করবে, সংস্কৃতির হাতে-পায়ে জড়িয়ে যাবে শয়তানের সুকঠিন শৃঙ্খলÑ সে ক্ষমার পক্ষে আমি কিছুতেই অবস্থান নিতে পারি না।

বাংলাদেশ কোমল মাটির দেশ। এ দেশের বাগানে বাগানে ফোটে কোমলকুসুম। পাখির কোমল গানে, কোমল নারীর ভালোবাসায়Ñ বাংলার প্রতিটি গৃহে আজ রচিত হচ্ছে স্বগর্সুখ। এই স্বগর্সুখে হানা দিতে দিকে দিকে তৈরি হচ্ছে শোষণযন্ত্র। এই শোষণ যেই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সমাজের বুকে বৈধতা লাভ করবেÑ তার পোশাকি নাম ‘নিবার্চন’। আগামী নিবার্চন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য জীবন-মরণ পরীক্ষার মুহূতর্। ওই নিবার্চন নিধার্রণ করবেÑ বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়। আজ কারও মিষ্টি কথায়, কিংবা মোলায়েম স্পশের্ ভুলে গেলে চলবে না। আবেগকে সুকৌশলে শাসন করে ধীরে-সুস্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ব্যক্তিস্বাথের্ক বলি দিতে হবে সামষ্টিকস্বাথর্ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। মুহূতের্র লাভালাভের হিসাব-নিকাশ অস্বীকার করতে হবে আগামীর সুন্দর সময়ের জন্য। এ কাজে এখন আলস্য প্রদশর্ন করলে নৈতিক অপরাধ সংঘটিত হবে। যে পাপ ধুয়ে-মুছে গেছে শহীদের রক্তিম শিশিরের ফেনায়, যে পাপী শাস্তি পেয়েছে উন্মুক্ত বিচার সভায়Ñ সেই পাপ ও সেই পাপী আবার আমাদের জীবনে, সমাজে-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হোকÑ এটা আমি কিছুতেই চাই না।

নিন্দুকের মুখে চুনকালি মাখিয়ে বিজয়ীর দৃপ্ত অহংকারে বুক ফুলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ; আমাদের ষোলো কোটি মানুষের শান্তিময় বাংলাদেশ। আমাদের এই বিজয়রথ নিবিের্ঘœ আরও বহুদূর এগিয়ে যাকÑ সেটাই আমরা প্রত্যাশা করি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে নাÑ এই মাটিতে জন্ম নেয়া কিছু মাতাল দেশদ্রোহী এ দেশের উত্থান চায় না, এ দেশের মানুষের শান্তি ও উন্নতি চায় না। এরা এ দেশে ভিনদেশি প্রভুদের জনবিরোধী নিদের্শনামা কায়েম করতে চায়, অগ্রগতির মস্তকে চাপিয়ে দিতে চায় মধ্যযুগের অচলস্বপ্নের বোঝা। এরা গোপন কমর্সূচি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সোনার বাংলায় শ্মশান নিমাের্ণর জন্য। মিলনসংগীতে এরা যোগ করতে চায় বিষাদের করুণকাহিনী, রাখীবন্ধনের পরিবতের্ এরা বাঙালির হাতে হাতে পরিয়ে দিতে চায় লৌহশৃঙ্খল। এরা এখন ক্ষমতার বাইরে গিয়ে অসীম অতৃপ্তিতে ভুগছে। এদের চিন্তাতপ্ত ললাটে লোভের তৃতীয় নয়নে যে হিংসাবহ্নি বষির্ত হচ্ছে সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। পরাজিত শত্রæকে বিজয়ীর আসনে অধিষ্ঠিত করে তাকে নিবির্চার হত্যার অধিকার দিলে আমাদের ভুল হবে, আমাদের আজ ভেবে দেখা দরকারÑ আমরা সেই ভুলটাই আজ করতে যাচ্ছি কিনা।

কবিগুরু একটি কবিতায় বলেছেনÑ

ভীমরুল মৌমাছিতে হল রেষারেষি,

দুজনায় মহাতকর্ শক্তি কার বেশি।

ভীমরুল কহে, আছে সহস্র প্রমাণ

তোমার দংশন নহে আমার সমান।

বাঙালির সামগ্রিক জীবন আটকা পড়েছে ভীমরুল আর মৌমাছির বলয়ে। আমরা বরং মৌমাছিকে ভালোবাসতে পারি কিন্তু ভীমরুলকে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। মৌমাছি হুল ফোটালেও মধু দেয়। পক্ষান্তরে হত্যা ছাড়া ভীমরুলের দেবার কিছু নেই। অনেক রক্ত¯্রােত পেরিয়ে, ষড়যন্ত্রীদের ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে শুভকমর্পথে যে আজ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছেÑ সে পথ থেকে বাংলাদেশের গতিমুখ ফেরানো মোটেই সমীচীন নয়। এখন কোনো ক্ষমা নয়। সহমমির্তা বা করুণা প্রদশর্ন নয়। এখন আমাদের নিজেদের স্বাথের্ই নিমর্ম হওয়া দরকার। যে দুদর্মনীয় শত্রæ দুবর্ল হয়ে পড়েছে এখনই সুযোগ তাকে আরও দুবর্ল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া।

ব্যাধিকে বাড়তে দিয়ে স্বেচ্ছায় রোগভোগ বোকারাই করে। দেশপ্রেমের নামে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা বাস্তবায়নের নামে, আমার পরবতীর্ প্রজন্মের সুখী জীবনের নামেÑ আজ আমি ক্ষমার বিপক্ষে দঁাড়ালাম। আমাকে ক্ষমা করো, স্বদেশ।

সৈয়দ জাহিদ হাসান: কবি ও কথাশিল্পী

ংুবফলধযরফযধংধহ২৯@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<22316 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1