বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুদিের্ন নৌকার নিভীর্ক মাঝি সৈয়দ আশরাফ

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মাথা থেকে পা পযর্ন্ত ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন সৎ ও নিলোর্ভ মানুষ। তার স্ত্রীর অসুখের সময় নানাজন নানাভাবে তাকে সাহায্য করতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ঢাকা শহরে ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত বাসার সামান্য জায়গাটুকু বিক্রি করে তিনি তার স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ মিটান। তার মতো নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ সত্যই বাংলাদেশে বিরল।
নিতাই চন্দ্র রায়
  ০৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

সৈয়দ আশরাফ বলতেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়; একটি অনুভ‚তি।’ এই অনুভ‚তির সঙ্গে সত্যই মিশে আছে বাঙালির ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৬ দফা আন্দোলন, ’৭০-এর নিবার্চন, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম। মিশে আছে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জয়নুল আবেদীন, মুনির চৌধুরী, জহির রায়হান, জিসিদেব ও শহীদুল্লা কায়সারের আত্মত্যাগের উষ্ণ ও অমর ইতিহাস।

আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বতর্মান প্রেসিডিয়ামের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামে মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার শোক বাণীতে বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মতো রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে দেশ ও জাতি আজ মুহ্যমান। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় চার নেতাদের অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের অত্যন্ত সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ আশরাফ ছিলেন পুরোদস্তুর সৎ ব্যক্তি, দক্ষ সংগঠক ও গণমানুষের নেতা। প্রধানমন্ত্রী ১/১১-এর দুঃসময়ে তার বলিষ্ঠ ভ‚মিকার কথা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি আরও বলেন, মানুষের হৃদয়ে এই জননেতা চিরদিন তার কীতির্র মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন। এই আদশর্বান রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রমুখ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। শোক প্রকাশ করেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহŸায়ক ড. কামাল হোসেন ও বিএনপির মাহসচিব মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আওয়ামী লীগের এই সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী বেশ কিছু দিন ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারে ভোগছিলেন। গত ৩ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টায় ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যগ করেন। মৃত্যুকালে সৈয়দ আশরাফের মেয়ে রীমা ইসলাম, ভাই ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাফায়েতুল ইসলাম ও তাদের দুই বোনসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তার পাশে উপস্থিত ছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থাতেই তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করেন। তার অনুপস্থিতিতেও এলাকার মানুষ তাকে বিপুল ভোটে জয়ী করেন। এতেই বোঝা যায়Ñ তিনি ছিলেন জনগণের খুব কাছের মানুষ এবং কমীের্দর অত্যন্ত প্রিয় নেতা। গত ৪ ডিসেম্বর, সকালে নতুন সংসদ সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি, ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। ছাত্র জীবন থেকেই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ওই সময়ে ময়মনসিংহ জেলা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন ময়মনসিংহ-৩ ( গৌরীপুর) আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের নিবাির্চত সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদ। সাংসদ নাজিম উদ্দিন আহমদের সঙ্গে ছিল তার ময়মনসিংহের ছাত্র রাজনীতি, আন্দোলন ও সংগ্রামের অ¤ø-মধুর স্মৃতি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি মুক্তিবাহিনীর একজন সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর, নিমর্ম জেল হত্যাকাÐে তার পিতাসহ জাতীয় চার নেতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বুকভরা বেদনা নিয়ে জন্মভূমি ত্যাগ করে যুক্তরাজ্যে গমন করেন এবং লÐনের হ্যামলেট ট্ওায়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন কাযর্ক্রমে জড়িত ছিলেন। সে সময় তিনি লন্ডনের বাংলাদেশ যুবলীগের সদস্য হন। লন্ডনে থাকাকালে তিনি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ ইয়ুথ অগার্নাইজেশনের শিক্ষা সম্পাদক নিবাির্চত হন।

১৯৯৬ সালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মাতৃভূমির মাটির টানে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নিবার্চনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নিবাির্চত হন। পরে বেসামরিক পরিবহন ও পযর্টন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নিবাির্চত হন। ২০০১-০৫ সাল পযর্ন্ত তিনি পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পকির্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময়ে আব্দুল জলিল গ্রেপ্তার হলে, সৈযদ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিভের্য় নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবতীর্ সময়ে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পযর্ন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের নিবার্চনের তিনি সংসদ সদস্য নিবাির্চত হন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে গঠিত মন্ত্রিসভায় স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নিবার্চনেও তিনি সংসদ সদস্য নিবাির্চত হন এবং একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৫ সালের ৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্থানীয় সরকা ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করেন। এক মাস এক সপ্তাহ দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকার পর প্রধানমন্ত্রী তাকে প্রধানমন্ত্রীর নিজের অধীনে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন।

ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ব্রিটিশ ভারতীয় শীলা ঠাকুরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শীলা ঠাকুর লন্ডনে শিক্ষকতা করতেন। ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রিয়তমা পতœী শীলা ঠাকুরের মৃত্যু তাকে বেদনা বিদ্ধ করে; ভীষণ ব্যথা দেয়। তাদের একটি মেয়ে রয়েছে। সে লÐন এইচএসবি ব্যাংকে চাকরি করেন।

সৈয়দ আশরাফুল ছিলেন শেখ হাসিনার দুঃসময়ের সহযাত্রী। দুদিের্ন নৌকার নিভীর্ক মাঝি। একজন নিভর্রযোগ্য ও আস্থাবান মানুষ। ওয়ান ইলেভেন পরবতীর্ (২০০৭) আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে জিল্লুর রহমানের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি নিভের্য় সাহসের সঙ্গে দলের হাল ধরেন। একই সঙ্গে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিতাড়নের অশুভ খেলার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার এবং সাহসী ভ‚মিকা পালন করেন।

পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ এবং সাদা মনের মানুষ হিসেবে তিনি সারা দেশের মানুষ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকমীের্দর কাছে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ত্রিশাল পৌরসভার মেয়র এ বি এম আনিছুজ্জামানের পিতা আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা; মরহুম আবুল হোসেন ও মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক সঙ্গে এক সময় ময়মনসিংহের জেলখানায় বন্দি ছিলেন। মেয়র আনিছুজ্জামান তার পিতার সঙ্গে দেখা করার জন্য মাঝেমধ্যে ময়মনসিংহ জেলাখানায় যেতেন, সেখানেই পরিচয় হয় সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে মেয়র আনিছুজ্জামানের। কথা-বাতার্ ও আলাপ-আলোচনায় তাদের মধ্যে গড়ে উঠে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। নিবিড় সখ্যতা। সেই সখ্যতা মৃত্যুর পূবর্ দিন পযর্ন্ত অক্ষুণœ ছিল। সত্য কথা বলতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখে এই বরেণ্য নেতা ত্রিশাল নজরুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূতির্ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে তাকে বসিয়ে রেখে পরপর ২০ জন বক্তার বক্তৃতা শুনে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, বতর্মান বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল যুগেÑ এভাবে বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে বিরক্ত করা ও মূল্যবান সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

নিবার্চনে আগে শেখ হাসিনা স্বয়ং আশরাফুলের জন্য ভোট চেয়ে ছিলেন কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে। তিনি বলেছিলেন, যেহেতু এখন সৈয়দ আশরাফ সাহেব অসুস্থ, সবাই মিলে তার জন্য কাজ করে যাবেন, যেন তিনি নিবার্চনে জয়ী হন। সুস্থ হয়ে তিনি যেন আমাদের মাঝে ফিরে আসেনÑ এই দোয়া করি। সৈয়দ আশরাফ জয়ী হলেও তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারেননি প্রিয় মাতৃভূমিতে। ফিরে এলো তার কফিন। ফিরে এলো তার সাদা কাপড়ে মোড়া ফুলের পাপড়িতে ঢাকা নিথর-নিস্প্রাণ দেহ।

ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীঘির্দন ধরে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদ থেকে ছুটি নেন। এই অসুস্থতা নিয়েই এই বষীর্য়ান রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা, জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মাথা থেকে পা পযর্ন্ত ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন সৎ ও নিলোর্ভ মানুষ। তার স্ত্রীর অসুখের সময় নানাজন নানাভাবে তাকে সাহায্য করতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ঢাকা শহরে ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত বাসার সামান্য জায়গাটুকু বিক্রি করে তিনি তার স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ মিটান। তার মতো নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ সত্যই বাংলাদেশে বিরল।

তার বুক ছিল বাংলাদেশের হৃদয়। তিনি ভালোবাসতেন বাংলার মাটি, মানুষ, বঙ্গবন্ধু এবং তার পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের রেখে যাওয়া নীতি ও আদশর্। এই আদশর্ই তাকে দলের নেতা, কমীর্ ও সমথর্কদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। করে তোলে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, মহান মানুষ, যা দেশবাসী এবং আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকমীর্, শুভানুধ্যায়ী ও সমথর্করা অনন্তকাল ধরে স্মরণ রাখবেন। বতর্মানের এই সবর্গ্রাসী লোভ-লালসা ও নীতি- নৈতিকতাহীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজে সত্যই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব ও অমর ইতিহাস।

নিতাই চন্দ্র রায়: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<31023 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1