বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্বাধীনতা ও অসা¤প্রদায়িক চেতনায় উদ্দীপ্ত এক নাম

আবু আফিয়া আহমদ
  ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জ্যৈষ্ঠ পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ৩ জানুয়ারি ব্যাংককের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না.......রাজিউন)। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি জড়িত ছিলেন এবং স্বাধীনতার চেতনা ও সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দেশের এবং দলের ক্রান্তিলগ্নেও অত্যন্ত গুরুত্বপূণর্ অবদান রেখেছেন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নীতি-নিধার্রণী একটি সভায় তিনি বাংলাদেশের সাবের্ভৗম রাষ্ট্রের উগ্র ধমার্ন্ধদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পাবে বলে সবাইকে সতকর্ করেছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশে মগজধোলাইকৃত এক শ্রেণির অতি ধামির্কদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ইসলামী জিহাদের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে জঙ্গি বানানোর কথা উল্লেখ করে দলের সবাইকে সতকর্ করে দেন। এর আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্র ধমার্ন্ধদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশের বুদ্ধিজীবী ও সুধিমহলে নিন্দিত ও সমাদৃত হয়েছিল। তার মৃত্যুতে জাতি, বণর্ নিবিের্শষে মমার্হত।

তিনি কতটুকু অস¤প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতেন এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে শ্রদ্ধা করতেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ মিডিয়াতে দেয়া তার একটি বক্তব্যের ভিডিও এখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, “আমরা বিশ্বাস করি যে, সংবিধানে প্রত্যেকটি ধমর্ই স্বাধীনভাবে পালন করার অধিকার আছে এবং সেই অধিকার রক্ষা করার জন্য আমরা সব সময় সদা সচেতন। যখন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পাবলিকেশন ব্যন্ড করা হয় বাংলাদেশে আমরা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তার প্রতিবাদ করেছি। আমাদের নেত্রী বারবার এই কথা বলেছেন, কিছুদিন আগেও তিনি এক সাক্ষাৎকারে এবং প্রেস রিলিজের মাধ্যমে বলেছেন যে, কে মুসলমান কে মুসলমান না সেটা নিধার্রণ করা দায়িত্ব সৃষ্টিকতার্র, এটার দায়িত্ব পৃথিবীর কাউকে দেয়া হয়নি। আজকে যে পাকিস্তানে মুসলমানদের ভেতরে শিয়া সুন্নির যে গণহত্যা চলছে সেটারাও কিন্তু পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে ঘটতে পারে। আজকে আহমদিয়া সম্প্রদায় পরবতীের্ত শিয়া সম্প্রদায়, কেউ আসবে ওয়াহাবী সম্প্রদায়, কেউ আসবে হানাফি সম্প্রদায় বিভিন্ন ধরনের ফেতনার ঘটনা ইসলামের মধ্যে আছে। তো কেউ নিরাপদ থাকবে না। আমরা সংবিধান বিশ্বাস করি এবং সংবিধান সব ধমের্রই, সব মনোভাবেরই প্রকাশ করার সম্পূণর্ স্বাধীনতা সেখানে আছে এবং সে বিশ্বাস করার জন্যই আজকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সঙ্গে একত্রিত হয়েছি এবং আমরা নিশ্চিত করতে চাই, আপনারাসহ বাংলাদেশের সব ধমের্র সমান অধিকার যেন বাংলাদেশে বহাল থাকে। এই ধমের্র নামে যে ব্যবসা সেই ব্যবসাকে বন্ধ করার জন্য আজকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।”

২০১১ সালের জুলাই মাসে যেদিন ১১টি ইসলামী দলের নেতৃত্বে হরতাল পালিত হয়েছিল সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধমর্’ থাকার বিষয়ে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে মতবিনিময়কালে তিনি বলেছিলেনÑ কমিটি যদিও রাখতে চাইছে কিন্তু আমি এবং সংবিধান সংশোধন কমিটির কয়েকজন সদস্য এই রাষ্ট্রধমর্ রাখার বিরুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন, ‘সংবিধান তো দেশের সব নাগরিকের জন্য। সংবিধান যখন পড়ব, তখন আমি হিন্দুও না, আমি মুসলিমও না। আমি দেশের নাগরিক হিসেবে এটা পড়ব, এটা মান্য করব।’ এটাই ছিল ‘আমি হিন্দুও না, আমি মুসলিমও না’ বক্তব্যের বিষয়। যার আপাদমস্তক ছিল অসাম্প্রদায়িক আর তার তাই এই অসাধারণ বক্তব্যকে কিছু ধমার্ন্ধরা বিকৃত করে তাকে নাস্তিক আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছে ও করেছে। তার এই বক্তব্যের পরপরই তাহফিজে হারামাইন পরিষদের সভাপতি মাওলানা সাদেক আহমদ সিদ্দিকী এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, তিনি যেহেতু নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করছেন। তাহলে কি তিনি ধমির্বরোধী না ধমির্বদ্বেষী? (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ১৫/৭/২০১১)

আসলে ধমির্নরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি, এর অথর্ ধমর্হীনতা বা ধমর্ বিমুখতা নয়। এর অথর্ হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নায়করা নাগরিকদের ধমর্ বা বিশ্বাসের বিষয়ে সম্পূণর্ নিরপেক্ষ থাকবেন। কে কোন ধমের্ বিশ্বাসী বা কে অবিশ্বাসী অথবা নাস্তিক এ বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। ধমর্-বণর্ নিবিের্শষে সব নাগরিকের সমান অধিকার, সবাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সমানÑ এই হচ্ছে ধমির্নরপেক্ষতা। আর এই নীতিতেই তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।

আমরা জানি, ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে সবর্কালের সবের্শ্রষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ‘ধমর্ নিরপেক্ষতা’র ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে তিনি বলেনÑ “ধমর্ নিরপেক্ষতা মানে ধমর্হীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধমর্-কমর্ করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধমের্ক নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধমর্ পালন করবে। তাদের বাধা দিবার মতো ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধমর্ পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধমের্ক কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধমের্র নামে জুয়াচুরি, ধমের্র নামে বেইমানি, ধমের্র নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধমর্ অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধমের্ক রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধমীর্য় অধিকার খবর্ করা হয়েছে। আমি বলব, ধমীর্য় অধিকার খবর্ করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধমীর্য় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।” (তথ্য-‘বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ’ পুস্তক-পৃষ্ঠা-৮-১২) ধমর্ নিরপেক্ষতা সম্পকের্ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ঐতিহাসিক ৭ জুন উপলক্ষে সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে দ্ব্যথর্হীন ভাষায় ঘোষণা করেন “বাংলাদেশের মুসলমান মুসলমানের ধমর্ পালন করবে। হিন্দু তার ধমর্ পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধমর্ পালন করবে। এই বাংলায় ধমর্ নিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধমের্র নামে ব্যবসা করা চলবে না। ধমের্র নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধমের্র নামে রাজনীতি করে রাজাকার আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না” (বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ)। স্বাধীনতার এতটি বছর অতিক্রম করার পরেও এই শান্তিপ্রিয় দেশে যারা ধমের্র নামে রাজনীতি ও বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় জাতি তাদের চিনতে ভুল করেনি। এবারকার নিবার্চনই তার বড় প্রমাণ।

মূলত ধমর্ নিরপেক্ষতা এমন একটি চশমা যা পরিধান করলে শাসকদের চোখে ধমর্-বণর্ নিবিের্শষে প্রতিটি মানুষ কেবল একজন মানুষ হিসেবেই ধরা দেয়। তখন সে খোদার এক সম্মানিত সৃষ্টি হিসেবে মনে হয়Ñ যার প্রতি ন্যায় বিচার ও সদাচরণ করা শাসকদের পবিত্র দায়িত্ব। এই শিক্ষা আমরা মহান আল্লাহর ব্যবহার থেকেও গ্রহণ করতে পারি। তিনি যেমন মুসলমান-অমুসলমান, আস্তিক-নাস্তিক, পুণ্যবান-পাপী নিবিের্শষে সবার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তাদের সৎকমের্র প্রতিদান দেন, সবাইকে সূযের্র আলোয় উদ্ভাসিত করেন, সবাইকে তার করুণার বৃষ্টি বষর্ণ করেনÑ ঠিক তেমনি জাগতিক সরকার বা রাষ্ট্র নায়কদেরও এই গুণটি অবলম্বন করা উচিত। তবেই রাষ্ট্র ও দেশ হবে সুখী, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ।

আবু আফিয়া আহমদ: কলাম লেখক

ধনঁ.ধভরধ২০১৬@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<33369 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1