শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন

বাংলাদেশের অহংকার অমর একুশে ফেব্রæয়ারি আজ আন্তজাির্তক মাতৃভাষা দিবস। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষ আজ এ দিবসটি নিয়ে গবর্ করে। এ গবের্র অংশীদার আসাম রাজ্যের ১১ জন ভাষা শহীদও। বাংলাদেশের মতো আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনও ঘটনাবহুল ও ঐতিহাসিক।
আনোয়ারা আজাদ
  ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

সৃষ্টির পর থেকেই মানুষ যুদ্ধ করে যাচ্ছে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পানির জন্য, খাদ্যের জন্য, বাসস্থানের জন্য, দেশের জন্য। এক কথায় নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কত কিছুর জন্য যে পৃথিবীতে লড়াই করতে হয় সে শুধু লড়াকুরাই জানে। মুখের ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যও যে লড়াই করতে হয় সেটা জানিয়ে দিল একমাত্র বাংলা ভাষা নামক ভাষায় যারা কথা বলে সেই জাতি। জীবন দিয়ে নিজের মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ইতিহাস রচনা করল।

বিশ্ব মানচিত্রে ভারত-পাকিন্তান নামক রাষ্ট্র দুটির জন্ম নেয়ার শুরুর সময় থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তাই নিয়ে দ্বিমত তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে তা আন্দোলনে রূপ নেয়। নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকাডর্, এনভেলাপ প্রভৃতিতে ইংরেজির সঙ্গে উদুর্র ব্যবহার করার চক্রান্ত শুরু হলে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমুদ্দিন মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উদুর্’ শীষর্ক পুস্তক লিখে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে। সেই সময়েই আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মদ উদুর্র পক্ষে বিবৃতি প্রদান করলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দাশির্নক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ ভাষাবিদরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূবর্বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগের একটি অংশ পূবর্ পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে আলাদা একটি সংগঠনে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটি ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে তমুদ্দিন মজলিশের অবস্থানকে সমথর্ন করে। তমুদ্দিন মজলিশ ও পূবর্ পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ মিলে একটি সংগ্রাম পরিষদ পুনগর্ঠন করা হলে ১১ মাচর্ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমগ্র পূবর্ পাকিস্তানে ধমর্ঘট আহŸান করা হয়। এই ধমর্ঘটের ধারাবাহিকতায় ১৪ মাচর্ থেকে ১৯ মাচর্ পযর্ন্ত ঢাকা শহরে ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৬ মাচর্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় যার সভাপতিত্ব করেছিলেন আজকের কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বিক্ষোভের উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামলে নিতে তৎকালীন প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার চুক্তি করলেও কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তা ভÐুল করে দেন। তিনি পূবর্ পাকিস্তানে এসে রেসকোসর্ ময়দান ও কাজর্ন হলে বিশেষ সমাবতের্ন উদুর্ই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এতে তরুণরা ব্যাপক প্রতিবাদ করলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। তরুণদের প্রতিবাদ ও জেরার মুখে পরের দিন বাংলা ভাষা সমথর্কদের সঙ্গে বৈঠক করতে বাধ্য হন জিন্নাহ, যদিও তা ব্যথর্ হয়।

১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঢাকা সফরে আসেন। ২৭ জানুয়ারি তিনি পল্টন ময়দানে উদুর্ই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দিলে প্রতিবাদের ঝড় বিস্তৃতি লাভ করে। পুরো পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংগ্রাম পরিষদ ফেব্রæয়ারি মাসের ২১ তারিখ প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পূবর্ পাকিস্তানে এই প্রতিবাদ আন্দোলনে দ্রæত দানা বেঁধে উঠলে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে তরুণ সমাজ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেদের দাবি আদায়ে সংগঠিত হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ফেব্রæয়ারি মাসের ২১ তারিখে ১৪৪ ধারা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কিছু কমীর্ রাষ্ট্র ভাষা বাংলা করার দাবি আদায়ের পক্ষে মিছিল শুরু করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি হলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননাকারীদের ওপর গুলিবষর্ণ করে। এই গুলিতে রফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সংগ্রাম পরিষদ নিহতদের শহীদের মযার্দা দিয়ে তাদের রক্তে রঞ্জিত দিনটিকে কেন্দ্র করে পুরো পূবর্ পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে দেয় এবং তখন থেকেই এই দিনটি শোক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

অবশেষে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নিবার্চনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। যা আজ আন্তজাির্তকভাবে স্বীকৃত।

১৯৬১ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে পূবর্ পাকিস্তানের তথা আজকের বাংলাদেশের বাঙালিরা শুধু নন, আসামের শিলচরের বাঙালিরাও ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার মযার্দা রক্ষায় জীবনদান করেছে। কিন্তু তাদের এই ত্যাগের ঘটনাটি বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উপেক্ষিত অধ্যায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ বাঙালি এখনও জানেন না বাংলা ভাষার জন্য জীবন দানের ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই নয় অন্য আরও কোথাও ঘটেছিল। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আসামের শিলচরে সেদিন একজন নারীসহ মোট ১১টি তাজা প্রাণ রক্ত ঢেলেছিল যা অনেকেরই অজানা।

সেই নারীর নাম কমলা ভট্টাচাযর্। যিনি জন্মেছিলেন ১৯৪৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের শ্রীহট্টে (সিলেটে)। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯ মে ১৯৬১ সালে অন্যদের সঙ্গে তিনিও বাংলা ভাষাকে আসামের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে শহীদ হন। কমলার বাবার নাম রামরমণ ভট্টাচাযর্, মাতা-সুপ্রবাসিনী দেবী।

দেশবিভাগের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকলে সাহিত্য-সংস্কৃতিও ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। বিশেষ করে আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে বাঙালি জনপদ গড়ে উঠলে বাঙালিদের প্রভাব বিস্তার হতে থাকে। ফলে আসামের অসমীয়রা একটা সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের বিরুদ্ধে ১৯৫০ সালে ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলন করে। অবশ্য এই আন্দোলনের ইন্ধন জুগিয়েছিল ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা। এদের ইন্ধনেই অসমিয়া জাতীয়বাদ এবং অসমিয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারি ভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাঙালিদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ শুরু করে অসমীয়রা। এমনকি ১৯৪৮ সালের মে মাসে গোহাটী শহরে বাঙালিদের ওপর তারা আগ্রাসন চালায়। ১৯৬০ সালের ৩ মাচর্ আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা বিধানসভায় অসমিয়াকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা ঘোষণা করলে সে বছরেই ১৬ এপ্রিল শিলচরের বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিরা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং একটি কমিটি গঠন করে। সাথে বাংলা ভাষার পক্ষে চলতে থাকে নানান কমর্সূচি। এই সব কমর্সূচি চলাকালেই ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসাম রাজ্যের সবর্ত্র অসমিয়া ভাষা প্রয়োগের জন্য বিধানসভায় বিল উত্থাপন হয়। এতে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ লাখ লাখ বাঙালির অধিকারের দাবি অগ্রাহ্য করা হলে এই আইনের প্রতিবাদ করে বাংলা ভাষার পক্ষশক্তি আরও সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। তাদের ভাষ্য- বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার সমমযার্দা না দিলে বাঙালি সমাজের মৌলিক অধিকার ও মাতৃভাষা রক্ষাথের্ বাংলা ভাষা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো বৃহত্তর আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া অপরিহাযর্ হয়ে পড়বে।

এই ভাবনা থেকে সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে ১৯৬১ সালের ১৯ মে থেকে সমগ্র কাছাড়ে বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবিতে অহিংস অসহযোগ গণআন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। যেই কথা সেই কাজ- পূবর্ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮ মে রাত ১২টার পর থেকে প্রায় ১০ হাজার তরুণ-তরুণী বিভিন্ন বয়সের মানুষ শিলচর রেলস্টেশনে অহিংস অবস্থান ধমর্ঘট করার জন্য সমবেত হতে থাকে।

অবশেষে ভোর হয়, আসে ১৯ মে। সমবেত উত্তেজিত জনতার প্রতিরোধে স্টেশনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময় পুলিশ অনেককেই গ্রেপ্তার করে ও অনেককে গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে চলে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে বেলা আড়াইটার দিকে রেলস্টেশনে কতর্ব্যরত বিএসএফের সদস্যরা হঠাৎ গুলিবষর্ণ শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষনাৎ শহীদ হন ৯ জন ও পরে আরও দুজন, মোট ১১ জন শহীদ হন।

তবে গুলি-কারপিউ-গ্রেপ্তার ইত্যাদিতেও আন্দোলনকারীরা ভীত হয় নাÑ তাদের আন্দোলন চলতে থাকে। অবশেষে তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ওই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় আসামের কতৃর্পক্ষ। এভাবেই আসাম রাজ্যে ভাষা আন্দোলনের চ‚ড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধান সভায় স্বীকৃতি পায়।

২০০৫ সাল থেকে আসামের মানুষ দাবি তুলেছিলেন বাংলা ভাষার আন্দোলনের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, সেই শহীদদের মযার্দা দেয়ার জন্য স্টেশনটির নামকরণ করা হোক ভাষা শহীদ স্টেশন। কতৃর্পক্ষের সঙ্গে অনেক চিঠি চালাচালির পর শেষমেশ ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে যে রেলস্টেশনটির কাছে বাংলা ভাষা আন্দোলনের দাবিতে ১১ জন মানুষ শহীদ হয়েছিল তার নাম করা হয়েছে ভাষা শহীদ স্টেশন।

১৯ মের ঘটনা অনেকটা হারিয়ে যেতে থাকলে ২০০৩ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদ এই দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতি বছর ১৯ মে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অপর্ণ এবং আলোচনার আয়োজন করে থাকে।

বাংলাদেশে এরাই সবর্প্রথম দিবসটিকে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে ১১ জন ভাষা শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অপর্ণসহ নানা কমর্সূচির মধ্যদিয়ে পালন করে আসছে। প্রতিবছর ১৯ মে ও ২১ ফেব্রæয়ারি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালায় যোগ দিচ্ছেন ভারত ও বাংলাদেশের আমন্ত্রিত অতিথিরা।

বাংলাদেশের অহংকার অমর একুশে ফেব্রæয়ারি আজ আন্তজাির্তক মাতৃভাষা দিবস। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষ আজ এ দিবসটি নিয়ে গবর্ করে। এ গবের্র অংশীদার আসাম রাজ্যের ১১ জন ভাষা শহীদও। বাংলাদেশের মতো আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনও ঘটনাবহুল ও ঐতিহাসিক।

আনোয়ারা আজাদ: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<34714 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1