বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

খোলা চিঠি

মনিবুল হক বসুনীয়া সহঃ শিক্ষক, রাজারহাট, কুড়িগ্রাম
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

প্রথমে আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূণর্ একটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার জন্য।

আপনি আমার/আমাদের অভিবাদন, শুভেচ্ছা ওভালোবাসা গ্রহণ করুন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এত গুরুত্বপূণর্ বলছি কারণ, আমরা জানি ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদÐ’। আর সেই শিক্ষার সূতিকাগার হলো ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এই প্রাথমিক বিদ্যালয় যেহেতু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সেহেতু এই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব অবশ্যই অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূণর্ হলের আমার/আমাদের ধারণা। সরকার ইতোমধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক পরিবতর্ন এনেছেন যা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। যেমনÑ উপবৃত্তি, বিনামূল্য বই বিতরণ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, ভৌত অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতিসাধন, শিশু শ্রেণির শিক্ষাথীের্দর জন্য নিদির্ষ্ট শিক্ষক, শিক্ষকদের দক্ষতাসম্পন্ন করে তোলার জন্য দেশে ও দেশের বাইরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইত্যাদি। এসব বহুবিধ কারণে সরকারকে বলা হয় ‘শিক্ষাবান্ধব সরকার’।

যা সরকারের ভাবমূতির্ উজ্জ্বল করছে। সরকার শিক্ষাবান্ধব সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এই শিক্ষাকাযের্র সঙ্গে সরাসরি জড়িত মানে শিক্ষক, আরও সুনিদির্ষ্ট করে বললে সহকারী শিক্ষক, তাদের কী অবস্থা তা জানাতেই মূলত আজকের আমার এই খোলা চিঠি। একটা উদাহরণ দিই। ধরি, আমাদের একজন শিশুসন্তান আছে। যাকে আমরা বাসায় একজন সাহায্যকারীর কাছে রেখে কমর্স্থলে যাই। আমাদের শিশুটির জন্য বাসায় পযার্প্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। যেমনÑ খেলাধুলা করার, টিভি দেখার, প্রয়োজনীয় খাবারের ইত্যাদি। কিন্তু যে সাহায্যকারী তার সাবর্ক্ষণিক দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন তিনি তার প্রত্যাশামাফিক সুবিধে বা ন্যায্য পাওনা পাচ্ছেন না। মানে আমরা তাকে তার ন্যায্য বা যৌক্তিক পাওনা থেকে বঞ্চিত করেই যাচ্ছি দীঘির্দন ধরেই। সে ক্ষেত্রে এই সাহায্যকারী কি আমাদের ওই সন্তানের প্রতি শুধুই দায়িত্ব পালন করবেন নাকি অনেক খুশিমনে আন্তরিকতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন? আপাতদৃষ্টিতে হয়তো দেখা যাবে তিনি দায়িত্বপালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা যদি গভীরভাবে পযের্বক্ষণ করি তাহলে বুঝতে পারব তিনি মনের ভিতরে একটা কষ্ট, একটা ক্ষত, একটা বেদনা নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। একজন অভিভাবক হিসেবে আমরা কি এটা চাইব যে আমাদের সন্তানকে শুধুই দায়িত্ব পালনের জন্য যতটুকু করার ততটুকু করুক? নাকি এটা চাইব যে, আমার সন্তানের প্রতি দায়িত্বপালনের সময় স্বতঃস্ফ‚তর্ভাবে, পূণর্ আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক? আপনি শুধু একজন সচেতন রাজনীতিবিদ বা সচেতন প্রতিমন্ত্রীই নন, আমার জানামতে আপনি একজন সচেতন নাগরিকও। সে হিসেবে আমি অনুমান করতে পারি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগে থেকেই আপনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের দুঃখ, কষ্ট, চাওয়া, পাওয়ার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল আছেন। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া বা আপনার আশপাশের অভাগা সহকারীদের মাধ্যমে যে আমরা বেতন বৈষম্যের শিকার। আশা করি, আপনি দায়িত্ব নেয়ার পরে সেটা বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন বা দাপ্তরিকভাবে ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জেনেছেন তাই আমি বিস্তারিত কিছু বলতে চাচ্ছি না। আমি শুধু দুটো কষ্টের কথা আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই, বিরক্ত হবেন না বলেই আমার বিশ্বাস। আপনি আমাদের জেলার মানুষ অতএব, আপনাকে তো আমরা বলবই। জোর করে হলেও বলতে চাইব এলাকার একজন ভাই হিসেবে, বন্ধু হিসেবে। আর এলাকার না হলেও আপনি আমাদের মন্ত্রণালয়ের সবোর্চ্চ পদে অধিষ্ঠিত সেদিক থেকেও আমি/আমরা আপনাকে বিরক্ত না করে কাকে করবো বলেন.... জাতীয় পে স্কেল ঘোষণার পর আমাদের আন্দোলনের মুখে তৎকালীন অথর্মন্ত্রী মহোদয় সারাদেশের ৮ জন শিক্ষককে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্স রুমে একটি কনফারেন্স করেছিলেন। আমি সেই কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিলাম একজন সদস্য হিসেবে। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন সেদিনই তিনি আমাদের তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করে বেতন-বৈষম্য দূর করে দেবেন। আমরা বুক ভরা আশা নিয়ে কনফারেন্স রুম থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আজকে আমি সেই বেতন-বৈষম্য নিয়েই লিখছি। এরপর, আমাদের আমরণ অনশন শুরু হলে তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মহোদয় এই বলে অনশন ভেঙেছিলেন যে, ‘অতিদ্রæত’ আরও সুনিদির্ষ্ট করে বললে, ‘মাসখানেকের’ মধ্যেই বেতন-বৈষম্য দূর করবেন যদি এটা যৌক্তিক প্রমাণ করা যায়। আমাদের নেতারা এটার যৌক্তিকতা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করলেও সেটার নিরসন আজ পযর্ন্ত হয়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে সমস্যাগুলো আছে তা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো করে অন্যকেউ উপলব্ধি করতে পারবেন না ওই, ‘কভু আশি বিষে দংশেনি যারে’ এর মতো। তাই প্রাথমিক শিক্ষার সাবির্ক উন্নতির জন্য প্রাথমিক ডিপাটের্মন্টের প্রতিটি পযাের্য় প্রাথমিক শিক্ষক থাকাটা জরুরি বলে আমি/আমরা মনে করি। একটা উদাহরণ দিই। আপনি তৃণমূল পযার্য় থেকে রাজনীতি করেই আজকের এই অবস্থানে এসেছেন যোগ্যতার প্রমাণ করে।

আপনি যে এলাকায় বা যে দলে আছেন সেই এলাকার বা সেই দলের সমস্যা কি আপনার চেয়েও অন্যকেউ ভালো বুঝবে? যারা কখনই রাজনীতি করেননি তাদের কাউকে ধরে এনে যদি আপনার এলাকার রাজনৈতিক দায়িত্ব দেয়া হয়, তিনি কি তা যথাযথভাবে পালন করতে পারবেন? ধরে নিলাম তিনি অনেক আন্তরিক, কিন্তু এলাকার রাজনীতির ব্যাপারে সম্যক ধারণা না থাকায় তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। বা নিলেও অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। কিন্তু আপনার কাছে এটা বা হাতের খেল হবে। কারণ, আপনার সম্যক ধারণা আছে। আমরা ঠিক এই কথাটাই বলতে চেয়েছি। যেহেতু শিক্ষকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমস্যা, সুবিধে, অসুবিধে সম্পকের্ সম্যক ধারণা রাখেন তাই আমরা চেয়েছি সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রিপদ ধরে মহাপরিচালক পযর্ন্ত পদোন্নতি দিতে হবে। আপনি জানেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫+ থেকে ১০+ পযর্ন্ত শিক্ষাথীর্রা আসে। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি ৯টা থেকে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট পযর্ন্ত। কোমলমতি শিক্ষাথীর্রা এই দীঘর্সময় ধরে বিদ্যালয়ে থাকতে অস্বস্তিবোধ করে, একঘেয়েমি অনুভব করে। শেষের দিকে গিয়ে তারা অমনোযোগী হয়ে পড়ে। তারা শারীরিক, মানসিক উভয় দিক থেকেই দুবর্ল হয়ে পড়ে। শিক্ষকদের কথা না হয় বাদই দিলাম। কোমলমতি শিক্ষাথীের্দর কথা বিবেচনায় রেখে স্কুলের সময়সূচি কমিয়ে নিয়ে আসা যায় কিনা সে ব্যাপারে আপনি চিন্তা করবেন এ আশাটুকু রাখছি। আমাদের ডিপাটের্মন্টকে বলা হয়ে থাকে ‘ভ্যাকেশনাল ডিপাটের্মন্ট’। কিন্তু আমরা সব জাতীয় দিবস, উৎসব যথাযথভাবে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে পালন/উদযাপন করে থাকি। অতএব, আমাদের দাবি এটাই যে, আমাদের ‘নন ভ্যাকেশনাল ডিপাটের্মন্ট’ ঘোষণা করা হোক। ইদানীং বলা হয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানদের বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতে হবে। এটাতে আমাদের আপত্তি নেই। আমরা তো চাই যে সবার সন্তান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুক, সবার নজর প্রাথমিকে থাকুক। সেজন্য আমরা চাই প্রতিজন জনপ্রতিনিধি মানে, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার থেকে প্রধানমন্ত্রীর সন্তান এবং প্রতিজন সরকারি চাকরিজীবীর সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানোর জন্য আইন করা হোক। লেখা অনেক দীঘর্ হয়েছে, আর দীঘর্তর করব না। আমরা শিক্ষক। আমরা জাতির মেরুদÐ শক্ত করার কাজে নিয়োজিত। এই যে আপনি বা আপনার মতো যারা আছেন তাদের আমরা, আমাদের মতোই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই অ আ ক খ শিখিয়েছি পরম মমতায়। আমরা ভালোবেসে আপনাদের নাকের সদির্টা পরিষ্কার করে দিয়েছি, দিচ্ছি। এই যে এভাবে আমরা পরম মমতায়, ভালোবেসে, স্বপ্ন দেখিয়ে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছি তা কি এই তৃতীয় শ্রেণির কমর্চারী হয়ে থাকার জন্য! আমাদের সম্মান দেয়া হয়, মিটিংয়ে, সেমিনারে, আলোচনা সভায় আর বক্তৃতায়। কিন্তু বাস্তবে কি আসলেই আমাদের ন্যূনতম সম্মান দেয়া হয়? আমি স্বীকার করছি আমাদের শিক্ষকদের কিছু ঘাটতি আছে কিন্তু তার মানে এই নয়, আমাদের সবার ঘাটতি আছে। আমরা যেমন ছেলেবেলায় আপনাদের ভুলগুলো, দোষগুলো ভালোবেসে বুঝিয়ে শুধরে দিয়েছিলাম সেটা কি আমরা এখন আপনাদের কাছে আশা করতে পারি না? পরিশেষে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, আপনার নেতৃত্বে শিক্ষাবান্ধব সরকার আরও বেশি শিক্ষকবান্ধব হবেন। শিক্ষকরা মনে আনন্দ, শান্তি, তৃপ্তি, প্রশান্তি আর সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বিদ্যালয়ে যাবেন, সেদিন বেশি দূরে নয়। আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন সে কামনায় আজকের মতো এখানে শেষ করছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<34991 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1