বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন: অজর্ন বজর্ন

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির স্বীকৃতির পরবতীর্কালে দেখা গেছে বাংলা সাহিত্যের প্রসারে বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকদের নতুন নতুন বই লিখতে ও প্রকাশ করতে, বইমেলার প্রচলন হতে, ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটতে। বস্তুত, সমাজে এক বিশাল ইতিবাচক পরিবতর্ন সূচিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সমাজদেহ থেকে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ বা হ্রাসের প্রক্রিয়া জোরদার হয়।
রণেশ মৈত্র
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

১৯৪৮ ও ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের বহুমাত্রিক অজর্ন আমাদের জানা। তবুও নতুন নতুন প্রজন্মের আগমনের কারণে এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যথর্তার সুযোগে যে সব অজর্ন কাযর্ত: ইতোমধ্যেই ফিকে হয়ে এসেছে, আমাদের সাংবাৎসরিক কতর্ব্য হয়ে দঁাড়িয়েছে সাধ্যমতো সেগুলো তুলে ধরা। যাতে বতর্মান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবার নতুন উৎসাহে হারানো বিজয়গুলো পুনরায় অজর্ন করতে পারে এবং তাকে বিক্ষিত করতে পারে।

১৯৪৭ এর রাষ্ট্রীয় বিভাজন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব যে উৎকট সাম্প্রদায়িকতার ফসল (এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির সাফল্যও বটে) ১৯৪৮ এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক মাস যেতে না যেতেই, বাঙালি মূলে ফেলে দেয় ১৯৪৮ এর মাচের্ রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।

আমাদের সবারই মনে আছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে। ছয় থেকে সাত মাস যেতে না যেতেই ১৯৪৮ সালের মাচের্ বাঙালি তরুণরা “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” বলে মাঠে নেমে পড়লেন আজ তা ভাবলে বিস্মিতই হতে হয়। কারণ, ১৯৪৭ সালে অসাম্প্রদায়িক শক্তির পরাজয়ই তো ঘটেছিল “মুসলমানের রাষ্ট্র” হিসেবে, সেখানে ১৯৪৮-এর শুরুতেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আদলিক তাত্তি¡ক ভিত্তিমূলেই তো আঘাত হেনে ফেলল কারণ ওই আন্দোলন ছিল স্পষ্টতই দ্বিজাতিতত্তে¡র বিরোধী। দ্বিজাতিতত্ত¡ ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিমূলে বড় ধরনের আঘাত হেনেছিল ওই আন্দোলনের মাধ্যমে।

কিন্তু এত দ্রæততার সঙ্গে আন্দোলনটির সূচনা হলো যে, ব্যাপক মানুষের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে তা বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। কারণ যে মানুষ ১৯৪৬ এ (বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়) ভোটের জোরে “মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল, যে ইসলামী জৌলুস বাঙালি মুসলিম মানুষকে গ্রাস করেছিল তা কি অত দ্রæতই সমাজদেহ থেকে বিদূরিত হয় কখনও? তাই তার রেশ বেশ ভালোভাবেই ছিল সেই পাকিস্তানি জোশ হারিয়ে যায়নি তখনও মুসলিম সমাজদেহ থেকে। এ কারণেই মূলত ১৯৪৮-এর আন্দোলন দ্রæত আরও ব্যাপকতা লাভ করতে সক্ষম হয়নি।

তবে একটা আগুন জ্বলেছিলÑ যা তুষের আগুনের মতো ধিকি ধিকি করে জ্বলছিল। ১৯৫২-র ফেব্রæয়ারিতে এসে তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। সমাজকে প্রচÐ নাড়া দিল। বাঙালি তীব্রভাবে ঘুরে দঁাড়ালো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ঝড়ের মতো জানান দিল যে, তারা হিন্দু নয়। মুসলমান না, তারা সবাই বাঙালি যে বাঙালিত্ব রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সাম্প্রদায়িক, ধমার্ন্ধ রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ভয় পেত এবং সে কারণেই প্রচার করত যে, বাংলাভাষা হিন্দুর ভাষা, মুসলমানের নয়। বাংলাভাষা ভারতের ভাষা, পাকিস্তানের নয়।

সবাই ঘুরে দঁাড়াতে শুরু করেছেন। শিল্পীরা, সাহিত্যিকরা, কবি ও গাল্পিক এবং ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, বাদ্যশিল্পী, ছাত্র ও যুব সংগঠন, নারী সমাজসহ সমগ্র বাঙালি জাতি। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নিবিের্শষে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ¯েøাগানে মুখরিত করে তুলেছিল সারা বাংলার মানুষ।

সরকার গুলি দিয়ে জবাব দিল। মানুষ দলে দলে জেলে গেল আন্দোলন অব্যাহত রাখল তীব্রতর করে তুলল দিনে দিনে। বিজয় অজর্ন করেই ছাড়ল তারা। বহুমাত্রিক বিজয় আমরা দেখেছি বাঙালি সংস্কৃতির পুনরাবাহন। দেখেছি নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম, গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীতের ব্যাপক প্রসার, দেখেছি নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আল্পনার পুনঃস্থাপন, দেখেছি নাটকে যে সব স্থানে বাধা দেয়া হতো, সে সব জায়গায় বাধাকে বাধাহীন করে তুলতে, যে সব স্থানে অভিনয়কালে পুরুষকে নারী সাজিয়ে অভিনয় মঞ্চে তুলত সে সব স্থানে আবার নারীই নারী চরিত্রে অভিনয় শুরু করতে। দেখেছি শহরে-বন্দরে, হাটে-বাজারে সবর্ত্র দোকান-পাটসহ নানা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোডর্ আরবি, উদুর্, ইংরেজির পরিবতের্ বাংলায় নতুন করে লিখতে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির স্বীকৃতির পরবতীর্কালে দেখা গেছে বাংলা সাহিত্যের প্রসারে বাঙালি কবি সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকদের নতুন নতুন বই লিখতে ও প্রকাশ করতে, বইমেলার প্রচলন হতে, ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটতে। বস্তুত, সমাজে এক বিশাল ইতিবাচক পরিবতর্ন সূচিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সমাজদেহ থেকে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ বা হ্রাসের প্রক্রিয়া জোরদার হয়।

একে একে নানা অসাম্প্রদায়িক ছাত্র, যুব সংগঠন রাজনৈতিক দল গঠিত হতে শুরু করল এবং এ জাতীয় সংগঠন হিসেবে পূবর্ পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হলো সত্তরে, দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার শাখার বিস্তার ঘটায়। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ধীরে ধীরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টা পরিষ্কার উপলব্ধিতে এলো। গণতন্ত্রী দল নামে বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠিত হলো।

বিদ্যমান সংগঠনগুলো তাদের নামের সাম্প্রদায়িক অংশ বজর্ন করে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হলো। ১৯৫৫ সালে পূবর্ পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তার নামের মধ্য থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে পূবর্ পাকিস্তানে ছাত্রলীগ এবং ১৯৫৬-তে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন প্রমুখের উদ্যোগে “আওয়ামী মুসলিম লীগ” থেকে “মুসলিম” শব্দটি তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত হওয়ার মতো তাৎপযর্পূণর্ ঘটনা ঘটতে শুরু করে ।

ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে এ কথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে প্রথম সাম্প্রদায়িকতা ও সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী যুব সংগঠন হিসেবে “পূবর্ পাকিস্তান যুবলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ওই যুব লীগের নেতারাই ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাৎপযর্পূণর্ অবস্থান রেখেছিল। ওই যুবলীগ নেতাদের মধ্যে জীবিত আছেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। জেলা পযাের্য়ও কেউ কেউ জীবিত আছেন মুষ্টিমেয় সংখ্যায়Ñ তবে সংগঠনটি প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজও অস্তিত্বহীন। এখন যে যুবলীগকে রাজনৈতিক অবস্থানে দেখা যায়, সেটি ১৯৪৮ সালের ওই যুবলীগ নয়।

১৯৪৮-এর যুবলীগের প্রয়াত নেতাদের অবিস্মৃত নামগুলো হলো ইমাদুল্লাহ তাজ-উদ্দিন আহমেদ, কে জি মুস্তফা, আবদুল মতিন (ভাষা মতিন), ওলি আহাদ, গাজীউল হক, আতাউর রহমান, আমিনুল ইসলাম বাদশা, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ।

আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ধমার্শ্রয়ী রাজনৈতিক, ছাত্র, যুব প্রতিষ্ঠানের জন্ম বন্ধ যদিও তখন কাউকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি রাষ্ট্রীয়ভাবে।

যে সব সংবাদপত্র ভাষা আন্দোলনের পর প্রকাশিত হয় তাদের নাম রাল শুরু হয় বাংলা শব্দ দিয়ে। অবশ্য এমন প্রথম পত্রিকা হলো দৈনিক সংবাদ। কিন্তু ‘আজাদ’ ইত্তেফাক, ইত্তেহাদ-এর মতো বিদেশি শব্দে সংবাদপত্রের নামকরণ তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় এবং মোটামুটি তা আজও অব্যাহত আছে।

পরবতীর্ সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৯৫৪-র নিবার্চনে হক-ভাসানী-সোহ্রাওয়াদীর্র নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট অসাধারণ এবং একচ্ছত্র বিজয় অজর্ন করে শাসক মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে। পরবতীর্ সময়ে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, অতঃপর শহীদ সোহ্রাওয়াদীর্র বৈরুতে আস্মিক মৃত্যু ঘটল শেখ মুজিবের হাতে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূবর্বাংলা স্বায়ত্ত শাসন, ৬ দফা, ছাত্র সমাজের ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান এবং সবের্শষ ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নিবার্চনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অকল্পনীয় বিজয় ঘটল। কিন্তু তার হাতে কিছুতেই রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ভিন্ন পথে কতৃর্ত্ব জোর করে ধরে রাখতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে; শুরু করে ব্যাপক গণহত্যা-বাঙালি নিধন। নিরস্ত্র বাঙালিকে তখন ঘুরে দঁাড়াতে হয় এবং শেষ পযর্ন্ত জাতীয় ঐক্য, জাতীয় আন্তজাির্তক সহযোগিতার মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বহু আকাক্সিক্ষত বাংলাদেশ নামক নতুন ধমির্রপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আকাশে রক্তিম সূযের্্যর উদয় হয়।

অতঃপর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবতর্ন ও ১৯৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন ও বাংলাদেশের মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধমির্নরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ওই সংবিধানে গৃহীত হওয়াতে ভাষা আন্দোলনের আদশির্ক বিজয়ের পরিপূণর্তা আসে।

১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ মাত্র ২৪ বছরে কি বিশাল বিজয়ই না অজির্ত হয়েছিল। গণতন্ত্র, ধমির্নরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বা সমাজতান্ত্রিক অথর্নীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ধমীর্য়, শৈল্পিক ও অথৈর্নতিক বৈষম্য দূর করে বাঙালি সংস্কৃতির বহুবিধ বিকাশ উন্নয়নের কি অপূবর্ অনুক‚ল পরিবেশই না সৃষ্টি হয়েছিল।

এবার যদি ১৯৭২ থেকে ২০১৮ এই ৪৬ বছরের অথার্ৎ আগের দফায় দ্বিগুণ সময়ের অজর্ন হিসেব করি তাহলে কি পাই? অনেক রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল বিপণি প্রভৃতি স্থাপিত হয়েছে, অনেক সেতু নিমির্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। চোখ ধঁাধানো বহুতল দালান কোঠা ঢাকাসহ বাংলাদেশে যত ঘটেছে গোটা পশ্চিম বাংলায় তা ঘটেনি। জাতীয় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে সব দাবি সত্য। বিশাল বাজেট পাস করছি তাও সত্য।

কিন্তু মূল বিবেচ্য হলো মানুষের অথৈর্নতিক বৈষম্য কি কমেছে? কোটিপতি লোকের সংখ্যা কত? মাসিক পঁাচ হাজার বা তার কিছু কম- বেশি টাকা উপাজর্ন করে এমন নি¤œবিত্ত ও বিত্তহীনের সংখ্যা কত? নিশ্চয়ই মানতে হবে জন সংখ্যার ৫ ভাগ বা তার কিছু কম-বেশি কোটি পতি দেশের ৯৫ ভাগ অথির্বত্তের মালিক। তা হলে উন্নয়নটা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কাদের?

এবারে আসি সাংস্কৃতিক অগ্রগতির প্রশ্নে সাংস্কৃতিক শব্দটির বিশাল ক্যানভাসে না গিয়েও জানতে চাওয়া যেতে পারে মানুষ কেন রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ল? একথা মাত্র কয়েকদিন আগে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বলেছেন। তা হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের অগ্রগতি কতটুকু বা আদৌ হয়েছে কি? সন্দেহ নেই, আগেই বলেছিÑ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনেক বেড়েছে। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যাও বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। কিন্তু ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার আনুপাতিক হার কি ঠিকমত আছে? শিক্ষার মান কি বেড়েছে? না বাড়লে কেন বাড়েনি? পাঠ্যসূচিকে আমাদের চিন্তাধারায় অগ্রগতির স্বাক্ষর বহন করছে। শিক্ষার অসাম্প্রদায়িকীকরণ হচ্ছে না কি সাম্প্রদায়িকীকরণ? মানুষের দাবি যে শিক্ষায় পাঠ্যসূচি এবং কবিতা প্রবন্ধ-গল্প-ইতিহাস বলে আসলে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ হচ্ছে শিশু-কিশোরদের চেতনায়। সেখানে রবীন্দ্র চেতনা, নজরুল চেতনা নয়, এমন কি বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ভাবাদশর্ও নয়, তার নামে বরং বিপরীত ভাবাদশের্ই কোমলমতি শিশু- কিশোরদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ শিক্ষার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেখা যায় হেফাজতে ইসলাম ও তার প্রধান তেঁতুল হুজুরকে। এটা কি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদশের্র সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূণর্? শুধুমাত্র একুশের মাসব্যাপী গ্রন্থমেলার জৌলুস বৃদ্ধি বা সময় ও এলাকাবৃদ্ধির দ্বারা একুশের চেতনা ও আদশের্র প্রচার প্রসার হচ্ছে তা বলা যাবে কি? ধমর্ নিরপেক্ষতা কাযর্ত বিদায় দিয়ে রাষ্ট্রধমর্ লালনের মাধ্যমে ধমীর্য় বৈষম্য বৃদ্ধি, পাঠ্যক্রমের সাম্প্রদায়িকীকরণের মাধ্যমে একই পঞ্চাপদ চিন্তাভাবনার বিকাশ জোরকদমে ঘটানো হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে মসজিদ নিমার্ণ ধমীর্য় সংখ্যালঘুদের মূলে শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কোটি কোটি মুসলিমও মানসিকভাবে ও নৈতিকভাবে সমথের্নর কোনো পথ খঁুজে পাচ্ছে না। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ছিল আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। সেটা একমাত্র সাধারণ ও বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উপরিস্থ নিভর্র করে। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছেটা কি? কিন্ডার গাটেের্নর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, মাদ্রাসাগুলোর সংখ্যা হু হু করে বাড়িয়ে আরবি এবং ধমীর্য় শিক্ষার বিকাশ এতগুলো বা ত্রিধারা শিক্ষা কি আমাদের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক-অথৈর্নতিক বিকাশের সহায়ক? নাকি প্রকৃতপক্ষে বাংলা শিক্ষার অবমূল্যায়ন করে আমরা ইংরেজি আরবি শিক্ষার প্রতি অধিকতর মনোযোগ দিয়েছি। বাংলা ভাষার আন্দোলনের মহিমা কোথায় রক্ষিত হচ্ছে? ইংরেজি শিক্ষা ও তার প্রভাব বৃদ্ধির অনুক‚ল-আবার বাংলা শিক্ষার অবমূল্যায়ন কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। আইনের বই, দশের্নর বই, বিজ্ঞানের বই, বাংলায় অনুবাদ কতটুকু হয়েছে? কেন বেশি বেশি হচ্ছে না? উচ্চাদালতে পূরোপূরি বাংলা ভাষার প্রবতের্নর পথে বাধাই বা কোথায়? স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয়। স্বীকৃত দুশমন জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম কেন বে-আইনি গোষণা করা হচ্ছে না সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। শুধু মুক্তিযুদ্ধ, শুধু দেশবাসীরই দাবি এটা তাতো নয়। উচ্চাদালতের রায় বারবার তেমনই নিদের্শনা দিয়েছে তবুও সেদিকে কোনো অগ্রগতি নেই। তাই হিসাব-নিকাশ কি পাওয়া যায়? ভাষা আন্দোলনের বিপুল অজের্নর পাশাপাশি আমরা হারালাম কতটুকু? মৌলিক আদশির্ক বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে? বজের্নর পথেই কি হঁঁাটছি না আমরা শহীদদের আদশর্ বাস্তবায়নের নামে? একটি উৎপাদনশীল অথর্নীতি, আত্মনিভর্রতার অথর্নীতি প্রতিষ্ঠার বদলে আমদানিনিভর্র অথর্নীতি দিয়ে দেখাল উন্নত করা যাবে না। আমরা হতে চাই অধিক থেকে অধিকতর রপ্তানির ক্ষমতাসম্পন্ন, নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে বেকারত্বমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এক নবীন বাংলাদেশ ভাষা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যা থাকবে দীপ্তমান। সেই বাংলাদেশে সবাই তার নিজ নিজ ধমর্ পারবে না। আমরা তেমনই ধমর্ যার যার, রাষ্ট্র সবারÑ রাষ্ট্রের কোনো ধমর্ থাকবে নাÑ এ নীতি প্রতিষ্ঠায় দেশ আজও অঙ্গীকারবদ্ধ।

রণেশ মৈত্র: সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36820 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1