নিমতলী থেকে চকবাজার। দূরত্ব মাত্র নয় বছরের। পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি নিমতলীর ভয়াবহ স্মৃতিকেই সামনে এনেছে। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলী অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারিয়েছিল ১২০ জনেরও বেশি নারী-পুরুষ। আর চকবাজারে প্রাণহানি ঘটেছে ৭৮ জনের। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, প্রাণহানির সংখ্যাটি আরও বড় হতে পারে। বুধবারের অগ্নিকান্ডের প্রকৃত কারণ তদন্ত করলে বেরিয়ে আসতে হয়তো, কিন্তু ভয়াবহতার বিষয়টি স্পষ্ট। পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছেন, ভবনটিতে রাসায়নিক গুদাম ছিল। এ ছাড়া নিচতলায় কয়েকটি গাড়ি ছিল, যেগুলো গ্যাসে চলে। আগুনের কারণে গাড়িগুলো বিস্ফোরিত হয়। আরেকটি গাড়ি ছিল, যার ভেতর ছিল অনেক সিলিন্ডার। ওই সিলিন্ডার হয়তো আশপাশের বাড়িতে ও হোটেলে গ্যাস সরবরাহের জন্য রাখা হয়েছিল। ওই গাড়িতেও ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ কারণে মৃতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যায়। ঘটনা যে কারণেই ঘটুক, পুরান ঢাকার চিপা ও ঘিঞ্জি গলি এবং জ্যামের কথাটি বলাই বাহুল্য। আর নানান অব্যবস্থাপনার বিষয়টিও অগ্নিকান্ডের পর আলোচনায় এসেছে। এজন্য যদি কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করা হয়, তাহলে কি ভুল হবে?
স্মর্তব্য যে, ২০১০ সালের জুন মাসে রাজধানীর নিমতলী এলাকায় একটি বৈদু্যতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের পর গোটা এলাকা ভস্মীভূত হয় এবং অন্তত ১২০ জনের মৃতু্য হয়েছিল। সাধারণ অগ্নিকান্ড এমন বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনারও প্রধান কারণ ছিল ওই এলাকায় থাকা দাহ্য পদার্থের দোকান ও গুদাম। তখন জনাকীর্ণ এলাকায় দাহ্য পদার্থ না রাখার ব্যাপারে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু আমরা যে নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করিনি- চকবাজারের দুর্ঘটনা তারই বড় প্রমাণ। গণমাধ্যমের নানান খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চকবাজারের অগ্নিকান্ডস্থলে নানা রাসায়নিক, পস্নাস্টিক পণ্য ও দাহ্য পদার্থের কারখানা ও গুদাম ছিল। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, এসব কারখানা ও গুদাম না থাকলে এত প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি দেখতে হতো না আমাদের। নিমতলীতে যেমন ভয়াবহ ঘটনা দেখতে হয়েছে, তেমনিভাবে চকবাজারেও দেখতে হলো একই বিপর্যয়কর পরিণতি।
রাসায়নিক পদার্থ অত্যন্ত দাহ্য। আগুনের স্পর্শে এলে তা কতটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে সেই অভিজ্ঞতা আমরা কীভাবে ভুলে যেতে পারি, তা বিস্ময়ের জন্ম দেয় বৈকি। নিমতলী অগ্নিকান্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদামগুলো সরিয়ে ফেলার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা তালিকা করে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু কাজটি আজও কেন সম্পাদন হয়নি, তাও নানান প্রশ্নের জন্ম দেয়। একেকটি ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তোলেন, আর কয়টি অগ্নিকান্ডের পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে? জনবহুল আবাসিক বা বাণিজ্যিক এলাকায় দাহ্য পদার্থের কারখানা বা গুদামের কারণে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার নজির কেবল নিমতলী বা চকবাজার এলাকাতেই দেখা যায়নি। ২০১৫ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে মিরপুরে একইভাবে দাহ্য পদার্থবহুল পস্নাস্টিক কারখানায় আগুন লেগে অন্তত ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। তখনও আলোচনায় এসেছিল, কারখানাটির অবস্থান জনাকীর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় না হলে এবং নিরাপত্তাবিধি মানা হলে হতাহতের সংখ্যা এত বেশি হতো না। চকবাজার ট্র্যাজেডির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আবারও বলতে চাই, রাজধানীবাসীকে এমন ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতে হবে আর কতদিন?
আমরা লক্ষ্য করি, এক একটি দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ 'শিক্ষা' নেয়ার কথা বলে, অনিয়মবিরোধী অভিযানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে, শহর নিরাপদ করে তোলার নানান প্রতিশ্রম্নতি দেয়। কিন্তু শোক ও আলোচনা থিতু হয়ে গেলে বিষয়টি ফের তিমিরেই হারিয়ে যায়। আমাদের প্রত্যাশা, চকবাজারের মর্মান্তিক অগ্নি দুর্ঘটনার মধ্যদিয়ে টনক নড়ুক কর্তৃপক্ষের। মনে রাখা দরকার, জনবহুল এলাকায় দাহ্য পদার্থের কারবার বন্ধ করা না গেলে আরও ব্যাপক মাত্রায় প্রাণ ও সম্পদহানি হতে পারে। ফলে জনবহুল ও আবাসিক এলাকা বিশেষ করে পুরান ঢাকা থেকে অনতিবিলম্বে সব রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হোক। এ ব্যাপারে আর যেন বিলম্ব না ঘটে সেজন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এমন ভয়াবহ ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেউ প্রত্যাশা করে না।