বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক নয় যেন নরক!

দুঘর্টনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুঘর্টনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রুখতে হবে? যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক।
নতুনধারা
  ২০ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

আমাদের সড়ক মহাসড়কগুলো এখন মরণফঁাদ। সড়ক নয় যেন নরক! এমন কোন দিন নেই, যেদিন অকালে প্রাণ ঝরছে না, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বাতাস ভারি হয়ে উঠছে না। দেশে যেভাবে সড়ক দুঘর্টনা বেড়েছে তাতে, নিরাপদ সড়ক বলে আর কিছু নেই। প্রতিদিন এমন হত্যাকাÐ ঘটলেও সংশিষ্টদের কাছে এটি গা-সওয়া হয়ে গেছে; সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে নেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। তাই বাংলাদেশে সড়ক দুঘর্টনার নামে ধারাবাহিক হত্যাকাÐ চলছে। এ অবস্থায় আজকাল আর কেউ ঘর থেকে বের হলে পৈতৃক প্রাণটা নিয়ে ফের ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।

এ তো দেখছি খুনিদের দেশ। সড়ক খুনিরা দাপটের সঙ্গে রাস্তায় মানুষ মারছে আর আমরা সবাই তা চেয়ে চেয়ে দেখছি। সড়ক দুঘর্টনা প্রাকৃতিক নয়, মানবসৃষ্ট কারণ। তাহলে এমন মৃত্যুকে আমরা কেন খুন বলব না? সড়ক দুঘর্টনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার হন। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাক্সিক্ষত কোনো উদ্যোগ নেই বাংলাদেশে। ফলে সড়ক দুঘর্টনা না কমে জ্যামিতিক হারেই বেড়ে চলেছে। এমন কোনো দিন নেই, যে দিন সড়ক দুঘর্টনা হচ্ছে না। বিগত এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুঘর্টনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে সরকার দুঘর্টনা সংঘটনকারী গাড়িচালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করেন। এতে চালকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়ক দুঘর্টনায় কারও মৃত্যু ঘটলে এ জন্য চালককে নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার কাছে প্রায় জিম্মি থাকতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে দুঘর্টনা সংঘটনকারী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কতৃর্ক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে ইদানীং সড়ক দুঘর্টনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুঘর্টনার সাথে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনা এদেশে বিরল। দেখা গেছে, প্রায় সব কটি দুঘর্টনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে গেছে। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে। উৎকোচ কিংবা অথর্ ভাগাভাগির মধ্যে দিয়েই সমাপ্তি ঘটেছে এসব ঘটনার।

সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুঘর্টনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুঘর্টনার হিসাব নিয়ে পুলিশ এ তথ্য দিয়েছে। বেসরকারি হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুঘর্টনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যায় প্রায় ৫৫ জন। পুলিশের দেয় তথ্য ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হল, দুঘর্টনার পর পুলিশকে ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুঘর্টনায় মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশ রেকডর্ভুক্ত করে না। যা হোক, পুলিশের দেয় তথ্যানুযায়ী ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পযর্ন্ত সড়ক দুঘর্টনায় মারা গেছে প্রায় ২ হাজার ১৪০ জন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে ১ হাজার ১৮৬ এবং সামান্য আহত হয়েছে ১৫৭ জন। অন্য একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পযর্ন্ত দেশে সড়ক দুঘর্টনা ঘটেছে ৭২ হাজার ৭৪৮টি। মারা গেছে ৫২ হাজার ৬৮৪ জন। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরও কয়েক হাজার মানুষ। ২০০৯ সালের এক আন্তজাির্তক পরিসংখ্যানে দেখা যায় এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুঘর্টনায় মৃত্যুর সংখ্যা নেপালে বেশি, দ্বিতীয় বাংলাদেশ। সবচেয়ে কম যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুঘর্টনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ওই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, সড়ক দুঘর্টনার শিকার ব্যক্তিদের প্রায় ৩২ শতাংশ ১৬ থেকে ৩২ বছর বয়সের মধ্যে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় দেশে যানবাহন দুঘর্টনায় বছরে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং আহত ও পুঙ্গ হয়ে পরনিভর্রশীল জীবন কাটাতে বাধ্য হয় এর চাইতেও অনেক বেশি মানুষ। সড়ক দুঘর্টনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুঘর্টনায় ফি বছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এটি দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুঘর্টনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশসমূহের তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। এক গবেষণা জরিপ হতে জানা যায়, ৪৮ শতাংশ সড়ক দুঘর্টনার জন্য দায়ী যাত্রীবাহী বাস, ৩৭ শতাংশ দায়ী ট্রাক। এক গবেষণায় দেখা যায়, নানা কারণে দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরযানে ১০০টি ভয়াবহ দুঘর্টনা ঘটছে। উন্নত দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক হাজার মোটরযানে দুই দশমিক পঁাচ ভাগ থেকে তিন দশমিক পঁাচ ভাগ। অন্যদিকে আমাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার যানবাহনে ১৬৩ জন দুঘর্টনার শিকার হচ্ছেন। সরকারি হিসাব মতে, ১৯৯৯ সালে ৪ হাজার ৯১৬ জন, ২০০০ সালে ৪ হাজার ৩৫৭, ২০০১ সালে ৪ হাজার ৯১, ২০০২ সালে ৪ হাজার ৯১৮, ২০০৩ সালে ৪ হাজার ৭৪৯, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৮২৮, ২০০৫ সালে ৩ হাজার ৯৫৪, ২০০৬ সালে ৩ হাজার ৭৯৪, ২০০৭ সালে ৪ হাজার ৮৬৯, ২০০৮ সালে ৪ হাজার ৪২৬, ২০০৯ সালে ৪ হাজার ২৯৭, ২০১০ সালে ৫ হাজার ৮০৩, ২০১১ সালে ৩ হাজার ৬৮৮, ২০১২ সালে ৫ হাজার ৯১১, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৮৬৫, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৯৭৫, ২০১৫ সালে ৮ হাজার ৬৪২, ২০১৬ সালে ৭ হাজার ৪২৭, ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৯৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ২০১৮তে চলতি জুন পযর্ন্ত হিসাবে বিগত বছরের তুলনায় সড়ক দুঘর্টনা বেড়েছে। প্রতি বছরই এভাবে সড়ক দুঘর্টনায় মানুষ মরছে আর তা রোধ করা যাচ্ছে না কেন? অদক্ষ ও দুই নম্বরী লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকগণই যে এসব দুঘর্টনার জন্য দায়ী তা বলাই বাহুল্য। এর প্রতিকার কেউ করছে না।

দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ র‌্যাব বাহিনী গঠন করা যায়, দুঘর্টনা রোধে এ জাতীয় বাহিনী নয় কেন? এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে সন্ত্রাসীদের হাতে শতকরা ৩০ জন লোক মারা গেলে সড়ক দুঘর্টনায় মারা যায় ৭০ জন। ৩০ জনের জীবনসহ অপরাপর জানমাল রক্ষায় সরকারের একটি বাহিনী থাকলে শতকরা ৭০ জনের জীবনসহ অসংখ্য আহত ও ডলারে কেনা পরিবহন রক্ষায় সরকার সড়ক দুঘর্টনা রোধে বাহিনী গঠন করছে না কেন? দেশের মানুষের জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দুঘর্টনা রোধে চরমভাবে ব্যথর্ সরকারকে দেশের মানুষের স্বাথের্ যথাসম্ভব দ্রæত ভাবতে হবে। আমরা জেনেছি, কেবল সড়ক দুঘর্টনায়ই দেশে গড়ে প্রতিদিন ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটছে। এ হিসেবে মাসে ৯০০ জন এবং বছরে ১০ হাজার ৮০০ জন মারা যাচ্ছে। তবে বিআরটিএর পরিসংখ্যানমতে, এ সংখ্যা দিনে ১৬ এবং বছরে পঁাচ হাজার ৭৬০ জন। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুঘর্টনার মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রয়োগে ব্যথর্ হলে প্রয়োজনে তাদের ঢেলে সাজাতে হবে, অন্যথায় দুঘর্টনা রোধে নতুন করে র‌্যাবের মতো দুঘর্টনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে। দুঘর্টনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ১. ত্রæটিপূণর্ যানবাহন চলাচল, ২. মোবাইল ফোন ব্যবহার, ৩. অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন, ৪. ট্রাফিক আইন না মানা, ৫. নিয়োজিতদের দায়িত্বে অবহেলা, ৬. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতকর্তা এবং ৭. অরক্ষিত রেললাইন। আর এসব কারণে প্রতিদিনই ঘটছে হতাহতের ঘটনা।

দুঘর্টনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুঘর্টনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রুখতে হবে? যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক।

সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেয়া আরও কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুঘর্টনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুঘর্টনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারও কাছেই কাম্য নয়। আমরা সড়ক দুঘর্টনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আমরা আশা করি।

মীর আব্দুল আলীম: সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক

হবংিংঃড়ৎব১৩@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<4212 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1