বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

মাদকে জড়িয়ে পড়ছে পথশিশুরা

মো. ওসমান গনি কুমিলস্না
  ২৩ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ- এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে আমাদের দেশের শিশু অধিকার সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে দেশের বহু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। তারপরও আমাদের দেশের অধিকাংশ শিশু এখনো পথশিশু বা ভাসমান হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। এসব শিশুরা হচ্ছে ঢাকাসহ সারা দেশের শহর-বন্দরগুলোতে ভাসমান শিশু। এ সব শিশু সরকার ও পরিবারের কোনো সঠিক তত্ত্বাবধানে না থাকায় তারা নিজেরা তাদের মনমতো চলাফেরা করছে। অনেকেই টোকাইর কাজ করছে আবার অনেকে ফুলসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করছে। তাদের দেখাশোনা বা খোঁজখবর নেয়ার মতো কোনো অভিভাবক এগিয়ে আসে নাই। যার জন্য তারা একপর্যায়ে আস্তে আস্তে সমাজের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি, ডাকাতি, খুন, ছিনতাই হতে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যে তারা করতে পারে না। তবে তাদের জীবনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কাজটি হলো তারা এক সময় নেশার জগতে জড়িয়ে পড়ে নেশা করতে করতে অকালেই তাদের জীবনটা ধবংস হয়ে যাচ্ছে। তাদের নেশার জগতে আনার জন্য একটি গ্রম্নপ রয়েছে। তারা যাদের বড় ভাই হিসেবে ডাকে। এই বড় ভাইদের নির্দেশেই তারা সবকাজ করে থাকে। তারা যখন অতিমাত্রায় নেশাক্ত হয়ে পড়ে তখন তারা একপর্যায়ে নেশার টাকা জোগাতে নিজেই শুরু করে মাদক কেনাবেচা। ভাসমান রিকশাচালক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা তাদের কাছ থেকে গাঁজা কিনে থাকে। এক সময় ক্রেতা আর নেশা দ্রব্যের চাহিদা বাড়ে। এখন শুধু সেবনই করে না, বিক্রির পাশাপাশি ফরমায়েশ মতো বিভিন্ন জায়গায় গাঁজা আর ইয়াবাও পৌঁছে দেয় এই কিশোররা।

বড় ভাইরা (তাদের ভাষায়) মাদক বিক্রি ও বহনের কাজে শিশু-কিশোরদের বেশি নিরাপদ মনে করে। তাই তাদেও দলে ভেড়ানো হচ্ছে। যার কারণে দিন দিন এ কাজে শিশু-কিশোরদের চাহিদা বাড়ছে। আগে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মাদক নিয়ে গেলে ছোটদের ৫০ টাকা দিলেই হতো। এখন ১০০ থেকে ২০০ টাকা দিতে হয়। বয়স একটু বেশি হলে আরও বেশি টাকা দিতে হয়। যে সব শিশু দেখতে খুবই সহজ-সরল, কিন্তু আচরণে অনেক চালাক-চতুর তাদেরই চাহিদা বেশি বড় ভাইদের কাছে। এ সব শিশু-কিশোররা নিরাপদে মাদক বিক্রি ও বহন করতে পারে। খুব সহজে ধরা পড়ে না। তবে কখনো ধরা খেলে দুই-চারটি থাপ্পড় ও লাথি মেরে ছেড়ে দেয়।

দেশে কী পরিমাণ ভাসমান শিশু-কিশোর মাদকে আসক্ত তার নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়ে থাকে, দেশে ৭০ থেকে ৮০ লাখের মতো মাদকাসক্ত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, ঢাকায় পাঁচ লাখের মতো পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ মাদকাসক্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো ২০০২-০৩ সালের এক গবেষণায় বলেছে, পথশিশুদের ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত।

আইসিডিডিআরবি সর্বশেষ ২০১১ সালের এক গবেষণায় ৫১ শতাংশ পথশিশুর মাদকাসক্তের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবন করে। গত কয়েক বছর আগে তাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্ত পথশিশুদের মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও ৮ শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে। এর বাইরে বিরাট একটি অংশ ড্যান্ডির (সলিউশন গাম) নেশায় আসক্ত।

পথশিশুদের বেশির ভাগই পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখে না। তবে বেশির ভাগ পরিবার সন্তানদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত। গুটি কয়েক পরিবার আছে যারা মাঝেমধ্যে এ সব মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চায়। পথশিশুরা প্রথমে সিগারেট ধরে। এরপর ড্যান্ডি ও গাঁজা সেবন শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ইয়াবা ও হেরোইনসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। এক সময় এ সব শিশুকে ব্যবহার করে বড় ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড করানো হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাসমান বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িত। তাদের ভেতরে সব সময় অপরাধমূলক প্রবণতা কাজ করে। তাই বাড়িতে থাকলেও তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সর্বদা ঝামেলায় জড়িত থাকে। এ ছাড়া বাড়ির টাকা ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি ছাড়াও প্রতিবেশীদের বাসায় চুরি করে থাকে। এ জন্য তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিলে পরিবার আরও বেশি ঝামেলায় পড়ে। যার কারণে তারাও সন্তানদের বিষয়ে উদাসীন। শহীদ মিনার এলাকায় থাকা কুলসুম নামে এক কিশোর জানায়, এক সময় ফুল আর চকোলেট বিক্রি করত। পরে বন্ধুদের সঙ্গে ড্যান্ডি খাওয়া শুরু করে। এখন মাঝেমধ্যে গাঁজা আর ইয়াবা খায়। তবে ইয়াবার আসক্তি অনেক বেড়ে গেছে। এখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় গাঁজা খেতে হয়। নয়তো মাথা ঠিকমতো কাজ করে না। তার ভাষ্য, গাঁজা খেতে না পারলে মাথা আর শরীর অবশ হয়ে যায়। কোনো কিছু চিন্তা করতে পারে না। খুবই খিট খিটে মনে হয়। এ ছাড়া তখন অন্য বন্ধুদের সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়।

পলাশীতে থাকা লাকী নামের আরেক ভাসমান কিশোরী জানায়, ছেলে বন্ধুরাই দুষ্টমির ছলে তাদের ড্যান্ডি আর গাঁজা খাওয়া শিখিয়েছে। এখন সপ্তাহে দুদিন ইয়াবাও খায়। তাদের ছেলে বন্ধুরা শাহবাগ, আজিমপুর ও নীলক্ষেতসহ আশপাশের এলাকায় মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ ও মোবাইল ছিনতাই করে। যেদিন বেশি টাকা আয় হয় সেদিন সবাইকে ইয়াবা খাওয়ায়। অন্যান্য দিন সবাই টাকা ভাগ করে ইয়াবা কিনে খায়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় ভাসমান শিশু-কিশোররা সব সময় হতাশাগ্রস্ত থাকে। এ ছাড়া রাষ্ট্র বা সমাজ এসব বিচ্ছিন্ন শিশু-কিশোরদের যথাযথভাবে গ্রহণ করতে চায় না। এসব কারণে ভাসমান শিশু-কিশোররা মানসিকভাবে নানা জটিলতায় ভুগে মাদকে জড়িয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, এককভাবে তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। পরিবার ও রাষ্ট্র উভয়ই এ সমস্যার জন্য দায়ী। এসব শিশু-কিশোরের দু'বেলা খাবারের জন্য অনেক সময় বড় অন্যায় করে বসে। যার কারণে সরকারিভাবে এসব শিশু-কিশোরের দেখভালের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই তাদের নেশা ও অপরাধ থেকে ফিরিয়ে মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<42175 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1