শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২৫ মার্চের গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা

২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজারবাগে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত করা হয় বাংলার মাটি। এরপর সারা দেশে শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। পাকিস্তানের শোষণ-শাসন আর বৈষম্যে অতিষ্ঠ বাঙালি জাতি এ প্রতিরোধের জন্যই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল। অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
মেহেদী হাসান
  ২৫ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন "যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।" হাজার বছর চলে যাবে তবুও একটি নাম বাঙালির হৃদয়ে চির অমলিন হয়ে থাকবে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শের নাম, একটি চেতনার নাম, একটি সংস্কৃতির নাম, একটি প্রতিষ্ঠানের নাম, সর্বোপরি স্বাধীনতার নাম।

বাঙালির সংঘবদ্ধতা রুখে দিতেই ২৫ মার্চের লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। আর এ বেদনাবিধুর ঘটনার মধ্যদিয়ে বাঙালি আরও দ্বিগুণ শক্তি অর্জন করে। কালরাতের শোক ও ক্রোধ থেকেই বাঙালি একযোগে জেগে ওঠার প্রেরণা পায়। ফলে তৎক্ষণাৎ দেশের জনগণের মধ্যে অখন্ড পাকিস্তানের প্রতি পূর্ণ অনাস্থার প্রকাশ ঘটায়। কালরাতের পরদিন ২৬ মার্চ থেকেই স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার যুবা-তরুণ এবং আবালবৃদ্ধবনিতা। শাপেবর হওয়া ২৫ মার্চের একটি কালরাতের অধ্যায়ই মোড় ঘুরিয়ে দিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের। শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলার আপামর জনগণই সূচনা করল যুদ্ধজয়ের এক ইতিহাসের। যে ইতিহাস বাঙালি জাতির ত্যাগ সংগ্রাম আর গৌরবের ইতিহাস।

২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজারবাগে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত করা হয় বাংলার মাটি। এরপর সারা দেশে শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। পাকিস্তানের শোষণ-শাসন আর বৈষম্যে অতিষ্ঠ বাঙালি জাতি এ প্রতিরোধের জন্যই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল। অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

\হএই ঘোষণায় তিনি পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য বাংলার জনগণকে আহ্বান জানান।বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল নিম্নরূপ:'এটিই সম্ভবত আমার শেষ বার্তা : আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমার আহ্বান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করুন। যতদিন পাক হানাদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হয় এবং যতদিন আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হয় ততদিন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।' শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে প্রচারের জন্য মধ্যরাতের কিছুক্ষণ পরে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাকে অবলম্বন করে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমানও। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা আর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে। দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর ভেঙে স্বাধীনতার বার্তা নতুন সূর্য হয়ে উদিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, তবে এই দিনের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৭ মার্চ, ১৯২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের মধ্য দিয়ে। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে বঞ্চিত নিপীড়িত উপেক্ষিত বুবুক্ষ জাতির মুক্তিরদূত হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার হাত ধরে হাজার বছরের স্বাধীনতাবঞ্চিত বাঙালি অর্জন করেছিল আজন্ম কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। এই চির প্রত্যাশিত মুক্তির রচয়িতা ও নায়ক একত্রিত করেছিলেন সমগ্র জাতিকে। পরিচালিত করেছিলেন মহান মুক্তির সংগ্রাম, আর দিয়েছিলেন সেই স্বপ্নময় স্বাধীনতা। আর নিজে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির প্রিয় বন্ধু, বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। যে নেতৃত্বের মাধুর্য ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী আর উনি হয়ে উঠেছেন অতুলনীয়, বহুগুণে গুণান্বিত একজন বিশ্ব নাগরিকে। বঙ্গবন্ধুকে শুধু নেতা বা শাসক বললে উনাকে সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। উনি ছিলেন বিশ্বনেতা। উনার নেতৃত্বের যোগ্যতা, ব্যক্তিত্বের সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বনেতার আসনে বসিয়েছে। মননে ও মগজে উনি ছিলেন প্রকৃত বাঙালি। পাকিস্তান জেলখানায় তার চোখের সামনে কবর খোঁড়া হয়েছিল, নিশ্চিত মৃতু্যর সামনে নিঃশঙ্ক চিত্তে বলেছিলেন "আমি নতি স্বীকার করতে জানি না। আমি বাঙালি, আমার দেশ বাংলাদেশ"। লন্ডন অবজারভারের বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইরিল ডান তার নিবন্ধে লিখেছেন "হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিব একমাত্র নেতা যিনি রক্ত, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও জন্মগতভাবে ছিলেন সম্পূর্ণ রূপে বাঙালি"। জাতিসত্তার প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর গভীর গর্ব ও শ্রদ্ধাবোধ। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অনুভূতিকে পদদলিত করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই দেশের নামকরণ করেছিল পূর্ব পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু এটা মানতে পারেননি এবং উনিই প্রথম বিরোধিতা করেছিলেন। ২৫ আগস্ট, ১৯৫৫ সাল, পাকিস্তান গণপরিষদে বলেছিলেন "মাননীয় সভাপতি, তারা (সরকার) পূর্ববাংলার নাম পূর্ব পাকিস্তানে পরিবর্তন করতে চায়। বাংলার ইতিহাস আছে, একটি ঐতিহ্য আছে। যদি এই নামটি পরিবর্তিত হয়, তাহলে বাঙালি জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখতে হবে তাদের পরিচয় পরিবর্তনের জন্য তারা প্রস্তুত কিনা?" (পাকিস্তান গণপরিষদের ধারা বিবরণী, ১৯৫৫)। সেদিন পাকিস্তানিগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর দাবি উপেক্ষা করেছিল। পরে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সালে বলেছিলেন 'মাঝে মাঝে, বাঙালি জাতির ইতিহাস এবং আকাঙ্ক্ষার সবদিক মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বঙ্গোপসাগর ব্যতীত, কারণ বঙ্গ শব্দটি কোথাও পাওয়া যায় না। বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে, আমি আজ ঘোষণা করছি যে, পূর্ব পাকিনস্তানের নাম বদলে নামকরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ'। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে সফল সংগঠক, '৪৭ থেকে '৭১ জাতির এই ক্রান্তিকালে উনার বলিষ্ঠ সাংগঠনিক দক্ষতা আর সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে উনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বজনবিদিত একচ্ছত্র নায়ক। যেমনটা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর নেতা মওদুদ আহমেদ তার 'বাংলাদেশ, শেখ মুজিবুর রহমানের যুগে' বইয়ে বলেছেন, "বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে শেখ মুজিবের আবির্ভাব সবচেযয়ে বড় ঘটনা। তাকে কবর দেয়ার মধ্যে দিয়ে তার মৃতু্য ঘটেনি। শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে আরও কার্যকর, দক্ষ, সক্ষম এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবির্ভূত হতে পারে বা হবে, কিন্তু এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রেখেছেন এবং জাতিকে নতুন পরিচয় দিয়েছেন।" বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল মানুষকে ভালোবাসতে পারার মধ্যে। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় বিবিসির সাংবাদিক স্যার ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাতৎকারে বলেছিলেন "আমার সর্বোচ্চ শক্তি আমার লোকদের জন্য ভালোবাসা, আমার সর্বশ্রেষ্ঠ দুর্বলতা আমি তাদের অনেক বেশি ভালোবাসি।" পাকিস্তান কারাগারে বন্দি অবস্থায় চলা নির্যাতনময় পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করেছিলেন এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন "আমার বিশ্বাস, আমার আদর্শ আর সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্যই আমি এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পেরেছি। এই জনগণ আমাকে তাদের ভাই, তাদের পিতা এবং তাদের নেতা হিসেবে ভালোবাসে"। আপনার কাছে দেশ না পরিবার আগে আসে- এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন "আমার জীবনটা দেশ এবং জনগণের সেবায় উৎসর্গকৃত। এবং এরপর আমার পরিবারের প্রশ্ন উঠে"। উনার সম্বোধনে ছিল বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের আহ্বান-"আমার ভাই ও বোনেরা", "আমি" না বলে বলতেন "আমরা"। সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ কখনোই উনাকে স্পর্শ করতে পারেনি। এমনকি ক্ষমতার মসনদও উনার আগ্রহের বস্তু ছিল না। ৭ মার্চের ভাষণে অকপটে দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা দিলেন "আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না।। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই"। ছিলেন ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, সবসময় অন্য ধর্মের চর্চা ও স্বাধীনতার বাধাহীন সুযোগের ব্যাপারে ছিলেন রক্ষক। মার্চের ওই উত্তাল সময়ের মধ্যেও সে কথা ভোলেননি- তাই উচ্চারণ করেছিলেন "এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়"। [৭ মার্চের ভাষণ, বাংলাদেশ সংবিধান পঞ্চম তফসিল ১৫০(২)অনুচ্ছেদ ]। বঙ্গবন্ধু ু ছিলেন আত্মবিশ্বাসী আর সঙ্কল্পে অবিচল। কোনো কিছুই টলাতে পারেনি উনার আত্মবিশ্বাস। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যক্রম চলাকালে পশ্চিমা সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেছিলেন "আপনাদের বলছি, তারা আমাকে ছয় মাসও এখানে ধরে রাখতে পারবে না"। এবং বেদ বাক্যের মতো ঠিক তাই হয়েছিল। গণজাগরণের ফলে উনাকে গ্রেপ্তারের সাত মাসের মধ্যে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয় কোন কিছুর কাছে আপস বা মাথা নিচু করেছেন ইতিহাসে এমন তথ্য পাওয়া যায় না। ২৫ মার্চ রাত্রে একজন পুলিশ সদস্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন পুলিশের পোশাক পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আত্মগোপন করার জন্য, উত্তরে উনি বলেছিলেন "ও ধস হড়ঃ ধ নধপশ ফড়ড়ৎ চড়ষরঃরপরধহ - আজ যদি আমি পালিয়ে যাই তা হলে বাঙালি জাতি কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না"। (ফারুক আহমেদ বাচ্চু, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা কর্মকর্তা)

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সফল ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, খুব ভালোভাবে বুঝেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, শুধু প্রকাশ্য শত্রম্নর সঙ্গে নয় অপ্রকাশিত দেশি শত্রম্নর সঙ্গেও "মনে রাখবেন শত্রম্নবাহিনী ধুঁকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে" (৭ মার্চের ভাষণ)।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের স্বীকৃতি সব সময় তার অনুসারীদের আনুগত্যতা এবং নেতার প্রতি বিশ্বাসের মধ্যে প্রকাশ পায়। উনার একান্ত সহচর মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননের ভাষণে প্রিয় নেতার ব্যাপারে বলছিলেন, "আপনারা জানেন, পাকিস্তানের শোষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সব স্বার্থ পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। আমি জোর দিয়ে বলছি, তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্তপ্রতীক শেখ মুজিব। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি। তার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই" (হাবিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতার জেল হত্যা। উনার ব্যক্তিত্ব আর বাচন ভঙ্গির মধ্যে ছিল চুম্বকীয় আকর্ষণ শক্তি, এক অনবদ্য সত্য আবেদন। বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক স্যার মার্ক টুলির ভাষায় 'শেখ সাহেবের বক্তব্য শুনতে আমি জনসাধারণের সঙ্গে বিভিন্ন সভায় যোগ দিয়েছিলাম। তার কণ্ঠ ছিল চমৎকার, যা জনতাকে মুগ্ধ করে তুলতো। আমি জনগণের প্রতিক্রিয়া থেকে সেটা অনুভব করতে পারতাম।'

বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতা ছিল অতুলনীয়। পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু যেটা করে দেখিয়েছিলেন সেটা শুধু বিরল-ই না, অনেকটা অসম্ভব। মাত্র তিনমাসের মধ্যে ভারত তাদের সেনা প্রত্যাহার করে, যেটি আর কখনোই কোথাও হয়নি। ফেব্রম্নয়ারি ১৯৭২ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কলকাতায় সাক্ষাতের সময় উনি বলেছিলেন "এখন হচ্ছে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সময়। তাই এই মুহূর্তে শক্তিশালী বিরোধিতা আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিকে অছিলা করে আমাদের বিরোধী পক্ষ দ্রম্নত সংগঠিত হতে সক্ষম হবে বলে মনে হয়"। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতাকে সম্মান করে মহান নেতার জন্ম তারিখে ১৭ মার্চ, ১৯৭২ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করেন।[এম আর আক্তার মুকুল, ইন্দিরা যখন বাংলাদেশে: কাছ থেকে দেখা চলিস্নশ থেকে একাত্মর]

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সীমাহীন বিশ্বাসের মূর্তপ্রতীক। এই জাতিকে উনার সমান বিশ্বাস আর কেউ করেনি বলেই ধারণা করা যায়। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ আরো বেশ কিছু শুভাকাঙ্‌ক্ষী বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু গভীর বিশ্বাসের কারণে উনি কখনোই এগুলোকে গুরুত্ব দেননি। এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা "র" সম্ভাব্য সেনা অভু্যত্থানের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। সাবেক "র" কর্মকর্তা আর. কে. যাদব তার বই মিশন "র" এ লিখেছেন, 'আর এন কাও, "র"-এর শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে ১৯৭৪ সালে ডিসেম্বরে ঢাকায় এসে বঙ্গভবনে শেখ মুজিবুর রহমানকে তার জীবনের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। উত্তরে শেখ মুজিব বলছিলেন, "এরা আমার নিজের সন্তান, এরা আমার ক্ষতি করবে না"।

বঙ্গবন্ধু তার ক্যারিশ্মাটিক নেতৃত্ব, আকাশসম ব্যক্তিত্ব, অসম্ভব সাহস এবং জাতির প্রতি সীমাহীন বিশ্বাস আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জন্য পেয়েছেন বিশ্বমর্যাদা। শ্রদ্ধাভরে উনাকে স্বীকার করে নিয়েছেন বিশ্বের গুণীজনেরা এবং স্থান দিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। প্রয়াত ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের নেতা লর্ড ফেননার ব্রকওয়ে বলেছিলেন "এক অর্থে, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী ও দে ভ্যালের চেয়ে শেখ মুজিব বড় মানের নেতা"। মিসরের সাংবাদিক হাসানিন হিকাল দিয়েছিলেন বিশ্ব নাগরিকের সম্মান, 'শেখ মুজিবুর রহমান একমাত্র বাংলাদেশের নন। তিনি সকল বাঙালিদের জন্য মুক্তির দূত। তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির নতুন উদ্ভব। মুজিব বাঙালিদের সব সময়ের নায়ক'। আমাদের শ্বাপদসংকুল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনব্দ্য অভিযাত্রী বঙ্গবন্ধু ু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের আবিষ্কারক। তার সংগ্রামের মহাকাব্য পঠিত হয় পৃথিবীর সতসহস্র নিরীহ, নিপীড়িত, বঞ্চিত, মুক্তিকামি জনতার হৃদয়ে, তার আদর্শ অনুপ্রাণিত করে সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, তার নেতৃত্বে আজো বিশ্ব খুঁজে পায় স্বাধীনতার সুখ।

মেহেদী হাসান : শিক্ষক, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ডিসিপিস্নন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<42478 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1