মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যাশা

মনে রাখতে হবে, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ কোনো কাকতালীয় বিষয় নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল এ স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে দেশের সবাইকে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও প্রজ্ঞার ফল আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের রক্তস্নাত একটি পতাকা।
তারাপদ আচার্য্য
  ২৬ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

আজ স্বাধীনতা দিবস। বাঙালির সহস্র বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবের দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বুকে লালন করা স্বাধীনতার অনির্বাণ শিখা। ৪৭ বছর আগে এ দিনে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। আমার সোনার বাংলাদেশ। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়ে মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেইনি। আর '৫২-এর পথ ধরেই আমাদের ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন এবং ২৫ মার্চের ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চেই আহ্বান এসেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতিকে আহ্বান জানিয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ এগিয়ে আসতে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি সরকারবিরোধী সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর আপামর জনসাধারণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। অচল হয়ে পড়ে দেশ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলেও এর ঐতিহাসিক পটভূমি ছিল দীর্ঘ। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ জন্ম নেয়। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল হিন্দু, পাকিস্তানে প্রাধান্য ছিল মুসলমানদের। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্ব ছিল হাজার মাইলেরও বেশি। সংস্কৃতিগতভাবে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্ত ও সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে। পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই দেশ শাসন ও অর্থনৈতিক নীতিতে উভয় অংশের মধ্যে বৈষম্য দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কৃষিপণ্য ও অন্যান্য সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে থাকে। এর পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর অবশেষে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ।

মনে রাখতে হবে, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ কোনো কাকতালীয় বিষয় নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল এ স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে দেশের সবাইকে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও প্রজ্ঞার ফল আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের রক্তস্নাত একটি পতাকা।

এই পতাকাকে কোনোভাবেই অমর্যাদা করা সমীচীন নয়। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ছিল আশ্চর্য রকমের সব ভুলে ভরা। এটা এমন একটি রাষ্ট্র ছিল যার রাজধানী ছিল হাজার মাইল দূরে। রাষ্ট্রের দুই অংশের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল ছিল বেশি। দুই দেশের জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব ছিল অনেক। শোষণ-বৈষম্যের মাত্রাও ছিল তীব্র। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ চরমভাবে শোষণ-বৈষম্যের শিকার হন। ক্ষোভ তাদের মধ্যে দানা বাঁধতে থাকে। '৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেও ক্ষমতা পায় না পূর্ব বাংলার জনগণ।

তৎপরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম। পাকিস্তানি অপশাসন শোষণ নির্যাতন ও বৈষম্যের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য বাঙালি জাতি মরণপণ সংগ্রাম করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাঙালি জাতি উদ্দীপিত হয়। মূলত সেটাই স্বাধীনতার ঘোষণা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে জাতিকে আহ্বান জানিয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হয়তো তাকে গ্রেপ্তার করবে। এ কারণেই জাতিকে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তিনি বজ্রকণ্ঠে বলেন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা করতে হবে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর বজ্রনির্ঘোষ ঘোষণা 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। তিনি আরও বলেন, 'যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রম্নকে প্রতিহত করে ছাড়বা।' বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় বলেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না- বাংলার মানুষের অধিকার চাই।' বঙ্গবন্ধু ছয় দফাকে এক দফায় পরিণত করতে এ ভাষণেই তিনি বাঙালির স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা দেন। এ ভাষণেই ছিল একটি রাষ্ট্রের অভু্যদয়ের কথা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ।

পায়ে পায়ে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। এত বছর পরও স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো কতটুকু প্রতিফলিত করতে পেরেছি, তা নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন জাগে। জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে দেশ অনেক এগিয়েছে, আরো এগিয়ে যাবে। ভাবতে অবাক লাগে, যিনি দেশ স্বাধীন করার নেতৃত্ব দিয়েছেন তাকে মেরে ফেলে তার হত্যার বিচার যাতে না হয়, সে জন্য মহান সংসদে বসে আইন তৈরি করা হয়েছে। এটা কি কোনো সভ্য জাতির পক্ষে করা সম্ভব! আশার কথা, জাতির জনকের হত্যার বিচার হয়েছে। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। নিঃসন্দেহে এটি অত্যন্ত ভালো একটি কাজ। এত রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, এই দেশের মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। দেশের মানুষের কল্যাণে রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক হানাহানি ভুলে দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেবে এটাই এ দেশের সচেতন জনগণের প্রত্যাশা।

তারাপদ আচার্য্য: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<42581 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1