শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নববর্ষ উদযাপন এবং বাঙালি সংস্কৃতি

নতুন বছরে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবন সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক, দেশ ও জাতির সুনাম আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আরো বিস্তার লাভ করুক এ প্রত্যাশা আমাদের।
তারাপদ আচার্য্য
  ১৪ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপলব্ধি এবং এর নিরন্তর চর্চা করা যে কোনো জাতির জন্যই গৌরবের। এ গৌরব বাঙালি জাতিরও রয়েছে। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আমাদের ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্যের ধারকবাহক বাঙালি। এই বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপ ফুটে ওঠে বাংলা নববর্ষের দিন। বাংলা নববর্ষ বাঙালির সমগ্র সত্তা, অস্তিত্ব ও অনুভবের সঙ্গে মিশে আছে। এটা বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল দিক। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আমাদের প্রাণের অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখ আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এ জাতি তার দেশকে ভালোবাসে, ভালোবাসে তার সংস্কৃতিকে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে নববর্ষ বরণ বাঙালি জাতিসত্তাকে উজ্জ্বল করে। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও এ জাতি তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে, রক্ষা করবে প্রাণের চেয়ে প্রিয় এ ভাষা, হাজার বছরের সংস্কৃতি।

বাঙালি জাতি গানে-কবিতায়, নানা লোকাচারে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দূর অতীত থেকেই বয়ে চলেছে নববর্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সম্রাট আকবরের শাসনামলে কৃষিনির্ভর বাংলায় বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন চালু হয়েছিল, নানা বিবর্তনে তা আজো বহমান। এ দেশের বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে বাংলা নববর্ষ বহুকাল ধরে বরণীয়। চৈত্রসংক্রান্তির নানা লোকাচার আর নববর্ষ বরণে কৃষিজীবী সমাজের বিচিত্র আয়োজন লোকায়ত উৎসব হিসেবেও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও বৈশাখের গুরুত্ব যথেষ্ট।

বৈশাখের সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কও তাৎপর্যপূর্ণ। পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষ বাঙালির বিজয় পতাকা আকাশে তুলে ধরে। বাঙালির এই বিজয় হচ্ছে সংস্কৃতির বিজয়। এই সাংস্কৃতিক বিজয়ের ফল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির এই সর্বজনীন উৎসব। প্রতি বছরের মতো রাজধানী ঢাকায় এবারো রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাঙালির বর্ষবরণ শুরু হবে। এই অনুষ্ঠানটিও এখন বাঙালির ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্য এ কারণে যে, পাকিস্তানি শাসনামলে নববর্ষ উদ্‌যাপনকে বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করেছিল। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করেছিল। এতে হাজার হাজার বাঙালি যোগ দিয়েছিল। এই দিন বাংলা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। লাখ লাখ মানুষ ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসে। নববর্ষ মানে নবজাগরণ। বাঙালির পুরনো ঐতিহ্যকে শহরে থেকেই স্মরণ করি অথবা ঐতিহ্যের কাছে ফিরে যাই। বাঙালি নারীরা সুন্দরভাবে সেজে রমনা বটমূলে কিংবা ধানমন্ডি লেকে যায়, পুরুষরাও এই দিনে বাঙালি সংস্কৃতির ধারকবাহক হয়ে ওঠে। এদিন আমরা ঢোল কিনে জোরে জোরে বাজাই, বেলুন উড়িয়ে দেই মুক্ত আকাশে, প্রিয়ার খোঁপায় পরিয়ে দিই গাঁদা-গোলাপ। বাংলা গানের প্রতি অতিদরদি হয়ে উঠি।

গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য গ্রামীণ মেলা এখন আর আগের মতো বসে না। পুতুলনাচ, যাত্রাপালা, জারি-সারি-ভাটিয়ালি গানের দিন প্রায় শেষ। গ্রামীণ খেলা, দাঁড়িয়াবাঁধা, গোলস্নাছুট, কানামাছি, হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা গ্রামীণ জনপদে তেমন একটা দেখা যায় না। কৃষিজমি দখল করে সেখানে তৈরি করা হয়েছে ইটভাটা, না হয় করা হচ্ছে হাউজিং বা শপিং মল। গ্রামে এখন তৈরি হচ্ছে উঁচু উঁচু ভবন। নগরায়ণের ছাপ পড়ছে সর্বত্র। একে ছাপ না বলে গ্রাস বলাই সঙ্গত। নদীতে পালতোলা নৌকা এখন আর চোখে পড়ে না। 'মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না'- এ কথা এখন আর কেউ বলে না। নদী এখন ইঞ্জিনচালিত নৌকা দখল করে নিয়েছে। আর নদীর স্বচ্ছ পানি দখল করে নিয়েছে নাগরিক বর্জ্য। রাখাল গরুর পাল নিয়ে আর মাঠে যায় না। গ্রামীণ সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে দখল করে নিয়েছে নগর। যে নগর পশ্চিমা সংস্কৃতির আবহে উচ্ছ্বসিত ও ভারাক্রান্ত।

আমরা মুখে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার কথা বলি কিন্তু কাজে উল্টো। আমরা যারা বাঙালি সংস্কৃতির ধ্বজাধারী বলে জাহির করি, তারা কিন্তু বাঙালি খাবার খাই না, জীবনাচরণেও বাঙালিপনা ফুটে ওঠে না। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াই; যার কারিকুলামে বাঙালি, বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের কোনো গন্ধ নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি ভুলতে বসেছে। এ ধরনের স্ববিরোধী সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে কি আমরা খুব বেশি দূর এগোতে পারব? শেকড়ের সন্ধান একদিন আমাদের করতেই হবে। ফিরে যেতে হবে শেকড়ের টানে।

সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনের দর্পণ। এটা নিরন্তর চর্চার বিষয়। মুখে এক আর কাজে অন্য- এভাবে আর যাই হোক বাঙালি সংস্কৃতি চর্চাকে বেশি দূর এগিয়ে নেয়া যাবে না। মনুষ্যত্ব তথা মানবধর্মের সাধনাই হচ্ছে সংস্কৃতি। আমরা যা ভাবী, পছন্দ করি এবং যা প্রতিদিনের জীবনাচরণে প্রতিফলিত হয় তা-ই আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানে নিজস্বতা নিয়ে সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে বেঁচে থাকা। সংস্কৃতি মানে কেবল নাচ, গান, সিনেমা-নাটক নয়। বাঙালি যদি তার নিজস্বতা হারিয়ে বিদেশি সংস্কৃতিকে বুকে ও মনে ধারণ করে সারা বছর কাটিয়ে দেয় তবে একদিন পহেলা বৈশাখ পালন করে কী লাভ।

প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, গত শতকের আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। তারপর থেকে প্রতি বছরই বর্ষবরণে মঙ্গল শাভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ ছাড়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় উৎসাহিত হয়ে ঢাকার বাইরেও একই ধরনের শোভাযাত্রাও বের হয় পহেলা বৈশাখে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু এক উৎসবের অনুষঙ্গ বা নামই নয়, এই শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে মেলে ধরার এক অন্যতম প্রয়াস। এর পাশাপাশি সমাজে অবক্ষয় থেকে মুক্তি এবং পেছনের দিকে হাঁটা প্রতিরোধেরও আহ্বান জানানো হয়। সকলে মিলে, যাবতীয় ভেদাভেদ ভুলে সম্প্রীতির এক অপূর্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয় মঙ্গল শোভাযাত্রায়। যেখানে সব অশুভ দূর হবে, এই প্রত্যয়ই ব্যক্ত হয় দৃঢ়ভাবে।

আসুন বৈশাখী মেলার আবহে আমরা সবাই গড়ে তুলতে পারি স্ব স্ব নীড়। যে নীড়ে থাকবে না কোনো কৃত্রিমতা। এতে সবারই মঙ্গল ছাড়া অমঙ্গল হবে না। উন্নত জীবন গড়ার পাশাপাশি অতীত স্মৃতিকে মনে জাগ্রত রাখতে পারলেই প্রকৃত বাঙালির পরিচয়ের মৃতু্য ঘটবে না।

নতুন বছরে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবন সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক, দেশ ও জাতির সুনাম আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আরো বিস্তার লাভ করুক এ প্রত্যাশা আমাদের।

তারাপদ আচার্য্য: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<45319 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1