বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষমা করো নুসরাত

নুসরাত জাহান রাফি অনন্তলোকে চলে গেছে সবাইকে কাঁদিয়ে। বাংলাদেশে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় কিছু দালাল, যারা নিজেরা অন্যায়ে করে এবং অন্যের অন্যায় সহযোগিতা করে থাকে। সিরাজ উদ দৌলার রয়েছে এমন কিছু দালাল। যাদের জন্য সরকারি নির্দেশনা সব সময়ই বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়। তাই সিরাজ উদ দৌলাসহ তার অনুগত দালালদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

দু'বাহু উদ্বেলিত করে বিচার চাই, বিচার চাই বলে চিৎকার করার পর যখন তথৈবচ, তখন নিজের ব্যর্থতাটা নিজেকে কুরে কুরে খায়। ইংরেজির সেই প্রবাদটির মতো ইধৎশরহম ফড়ম ংবষফড়স নরঃ। তনু, রিমা, তকীসহ কত প্রাণ ঝরে গেল, সারা দেশব্যাপী নিন্দার ঝড়, মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ, কথিত সুশীল নিশীকথকরা রাত পার করল আলোচনার পর আলোচনা করতে করতে। ইলেক্ট্র্রনিক মিডিয়াগুলো গরম হয়ে উঠল তাদের আলোচনায়। আর এ ধরনের পৈশাচিক ইসু্যর প্রতিকার চাওয়া আন্দোলনগুলোকে কেন্দ্র করে মানবতাবাদী নেতাও রাতারাতি হয়ে গেল কেউ কেউ। এত সব কিছুর পর কি পরিত্রাণ পেয়েছে সমাজের সাধারণ মানুষ। দিন দিন পৈশাচিকতা বাড়ছে। নদীর স্রোতের মতো সময় পেরিয়ে যায়, সব কিছু আর মনে থাকে না আবার ঘটনা ঘটে সবাই সোচ্চার, তারপর আবার থেমে যায়। তবে এ রকম লোমহর্ষক পৈশাচিক ঘটনা এখন কথিত সামাজিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের ইসু্য তাই তারা কিছু কর্মসুচি পালন করতে পারছে। নুসরাত জাহান রাফির ঘটনাটির সূত্রপাত থেকে একটু দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যারা আজ রাফির হ্যার বিচার চেয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করছে তারা নিজেরাও নুসরাত জাহান রাফির হত্যার দায় এড়াতে পারবে না। রাফি যৌন হয়রানির শিকার হয় তারই অধ্যায়ন করা শিক্ষালয় মাদ্রাসার প্রধানের কাছে। এই হয়রানির বিচার চাইতে তিনি থানায় যান। সেখানেও রাফি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক আবার নিগৃহীত হয়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রুম থেকে বেরিয়ে সে অঝোরে কাঁদতে থাকে, এই বিষয়টিও সবার জানা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও অন্যান্য গণমাধ্যমেও এই রাফির ন্যকারজনক যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো প্রকাশিত হয়। রাফির এই ঘটনাগুলো কি আজকে যারা রাফি হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করছেন তারা কি জানতেন না। রাফি তার শিক্ষা গুরু কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়ে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের কাছে যায়। উভয় স্থানেই রাফি একই ধরনের হয়রানির শিকার হয়। ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিক্ষালয় এবং থানা দুটো জায়গায়ই একজন নারী শিক্ষার্থীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছিল। তাই এসব জেনে কেন মানবতাবাদীরা এই দুটো স্থান নারীর জন্য নিরাপদ হোক এই দাবিতে মানববন্ধন করেননি। সেদিন যদি রাজপথে নেমে থানা এবং শিক্ষালয়কে নারীর জন্য নিরাপদ স্থান হোক এই দাবিতে এবং রাফির যৌন হয়রানির বিচার চাওয়া হতো, তাহলে বিষয়টি অন্যরকম হতে পারত। আর সিরাজুদৌলস্নার মতো জানোয়াররা রাফিকে পুড়িয়ে মারার সাহস করতে পারত না। ইংরেজিতে বলা হয় চৎবাবহঃরড়হ রং :যব নবঃঃবৎ :যধহ পঁৎ। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ প্রভাবশালী, তার প্রতি অনুগত ফেনীর সোনাগাজীর ক্ষমতাসীনরা। গত ২৭ মার্চ এই প্রভাবশালী অধ্যক্ষ তার অফিস কক্ষে নুসরাত জাহান রাফিকে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নুসরাত একটি মামলা করেছিল সোনাগাজী থানায়। নুসরাতের দায়ের করা মামলা থেকে এই লম্পটকে রক্ষা করার জন্য বিক্ষোভ মিছিল হয় সোনাগাজীতে। মিছিলে হাজার খানেক নারী-পুরুষ অধ্যক্ষ লম্পট সিরাজুদৌলস্নার নিঃর্শত মুক্তির দাবি করে। আজকে যারা নুসরাতের হত্যার বিচারের দাবিতে রাজপথ প্রকম্পিত করছেন, তাদের কাছে এই লম্পটের নিঃশর্ত মুক্তির দাবির মিছিলের বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা কি ছিল? এ সমাজে কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজেদের সচেতন এবং নৈতিক আদর্শিক বলে দাবি করেন। তাদেরই দেখা যায় এ ধরনের লম্পটদের পেছনে গিয়ে সামাজিক সংগঠন করতে আর এ ধরনের জনসমর্থনে ফলে লম্পটদের লাম্পট্য বেড়ে যায় আর প্রাণ হারায় নুসরাতরা। তাই সরকারপ্রধানকে এ ধরনের ঘটনায় দায়ী করার আগে শহড়ি :যুংবষভ। কারণ এই শ্রেণির মানুষ নিজেদের আদর্শিক এবং নৈতিক দাবি করেন। এরাই আবার লম্পটদের সমর্থন জানায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে আর এদের সমর্থনে এই লম্পটরাই সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায়। সুতরাং পরোক্ষভাবে প্রকৃত দায়ী করা একটু ভেবে দেখবেন।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে এটা বাংলার প্রাচীন একটি প্রবাদ। চোর চলে যাওয়ার পর এই বেড়ে যাওয়া বুদ্ধিতে সমাজের কোনো উপকার হয় না। গত ক'দিন আগে ৭১ টিভিতে একটি অনুষ্ঠান দেখছিলাম। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্পর্কিত ঘটনা। শিক্ষকটি ১১ জন শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্টের সুপারভাইজার। এই ১১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আটজন ছেলে এবং তিনজন মেয়ে। শিক্ষক শহরে একটি বাড়ি তৈরি করছেন। অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কিত বিষয়ে বোঝানোর জন্য শিক্ষক তার নির্মাণাধীন বাড়িতে তিন মেয়ে শিক্ষার্থীদের প্রায়ই ডাকেন। মেয়ে শিক্ষার্থীরা ওখানে গেলে তিনি কুরুচিপূর্ণ আচরণ করেন। এই আচরণের প্রতিবাদে মেয়ে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে। আর বিষয়টি গণমাধ্যমের দৃষ্টি আসে। ৭১ টিভি ফোনে তিন শিক্ষার্থী এবং এই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময়টা ৭১ টিভি সরাসরি সম্প্রচার করে। তাদের ফোনিক কথপোকথনে শিক্ষকের নিচু মানসিকতার পরিচয় মেলে। শিক্ষকের কথায় প্রমাণিত হয়ে যায়, তার নির্মাণাধীন বাড়িতে শিক্ষার্থীদের ডাকাটা ছিল অসৎ উদ্দেশ্য। ফোনে টিভির সঙ্গে কথা বলতে বলতে শিক্ষক একপর্যায়ে বলেন তাকে হেয় করার জন্যই মেয়ে শিক্ষার্থীদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লেলিয়ে দেয়া শব্দটির অর্থ নিশ্চয় ভালো করে জানেন। আর কোন ধরনের মেয়েদের লেলিয়ে দেয়া যায় যৌনবিষয়ক কাজে তাও শিক্ষক জ্ঞাত। একজন শিক্ষক যদি তার নিজ শিক্ষার্থীদের এ ধরনের বিশেষণে বিশেষায়িত করেন তা থেকে ওই শিক্ষকের চারিত্রিকমান নিরূপণ হয়ে যায়। আর এ ধরনের শিক্ষকটি কি রকম অপরাধ করতে পারেন তা মাপার জন্য অন্য কোনো সূচকের দরকার পড়ে না। এই বিষয়টি এখানে অবতারণা করার উদ্দেশ্যটা হলো- এ ধরনের শিক্ষকদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি ভাবছেন। নাকি আরেকটা রাফির মতো করুণ পরিণতির পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হবে। তখন সবাই মিলে আবার উৎসবের মতো করে রাজপথ প্রকম্পিত করে হত্যার বিচার চাইবেন।

দেশের সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন তিনিও চান সিরাজ উদ দৌলার মতো লম্পটদের শাস্তি হোক। প্রধানমন্ত্রী নুসরাতকে বাঁচানোর জন্য দেশের বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেন এবং সব চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেন। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

নুসরাত জাহান রাফি অনন্তলোকে চলে গেছে সবাইকে কাঁদিয়ে। বাংলাদেশে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় কিছু দালাল, যারা নিজেরা অন্যায় করে এবং অন্যের অন্যায়ে সহযোগিতা করে থাকে। সিরাজ উদ দৌলার রয়েছে এমন কিছু দালাল। যাদের জন্য সরকারি নির্দেশনা সব সময়ই বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়। তাই সিরাজ উদ দৌলা সহ তার অনুগত দালালদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে।

দেশের মানুষ তনুর সম্পর্কে ভুলে যায়নি এখনো। সেই সময়ের প্রকাশিত একটি সংবাদ সম্পর্কে একটু বলছি এই কারণেই তনু হত্যাটির বিচার হয়নি এখনো আর সমগ্র বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার একটি প্রচেষ্টাও চলে সেই সময়ে। সংবাদ তথ্যটি পড়লে তা বুঝতে কারও কষ্ট হবে না। ২০১৬ সালের ১৩ জুনের দৈনিক সংবাদের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাংবাদিকরা মেডিকেল বোর্ডকে প্রশ্ন করেছিল, মৃতু্যর আগে তনু ধর্ষিতা হয়েছিল কিনা এর জবাবটা আসে, ধর্ষণ হচ্ছে একটি লিগ্যাল টার্ম এটা সাইন্টিফিক টার্ম না। যৌনাঙ্গের প্রশ্ন লাগলেই ধর্ষণ হয়। এটা লিগ্যাল টার্ম সুতরাং সায়েন্টিফিক না; কিন্তু মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য ডা. ওমর ফারুক যা বললেন তা হয়তো লিগ্যাল না হয়ে সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা হতে পারে। তিনি বলেছেন, সেক্সচুয়াল ইন্টার কোর্স আর ধর্ষণ দুটি ভিন্ন বিষয়, তবে তনুর মৃতু্যর আগে সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্স হয়েছে তবে কতক্ষণ আগে হয়েছে তা বলা যাবে না। মৃতু্যর আগে যে যৌন ক্রিয়া হয়েছে ডা. ওমর ফারুক তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তনুর যৌন ক্রিয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। যদি ময়না তদন্তে তনুর যৌন অভিজ্ঞতা প্রমাণ করা যায় তা ছাড়া রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃতু্যর আগে তনু সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্স করেছে, তা হলে এই ইন্টারকোর্সটি ধর্ষণ হতে পারে না কেন? মেডিকেল ফরেনসিক টিমের বক্তব্যে কি বৈপরীত্যের সুর বোঝা যায় না। বিজ্ঞান আর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় আসলে ফরেনসিক টিম মেডিকেল টিম কি বোঝাতে চেয়েছেন তা সাধারণ মানুষের বোধগম্যতায় আসবে না। বিষয়টা হলো ডাক্তারি পরীক্ষার বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে ফরেনসিক মেডিকেল টিমের সদস্য মৃত তনুর সম্পর্কে যা বললেন তাতে তনু হত্যাকান্ডের রহস্য আরও ঘনীভূত হলো।

কোনো নারীকে ধর্ষণ করার পর এ ধরনের মুখরোচক গল্পের অবতারণা করাটার পেছনে উদ্দেশ্য কি? ধর্ষণ বা নারীর যৌন হয়রানির বিষয়গুলো নিয়ে এ ধরনের রাসালো গল্প করার ফলে অপরাধীরা বেঁচে যায়।

তাই অনন্তলোকে চলে যাওয়া নুসরাত জাহান রাফির বিষয়টিও যেন তনুর মতো না হয়।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<45471 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1