শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একটি রাষ্ট্রের জন্মদিন

ইতিহাসে মুজিব নগর সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও সুযোগ্য নেতৃত্ব সর্বোপরি যুদ্ধ পরিচালনায় নানা কৌশল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাদের নাম ও অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
মোহাম্মদ নজাবত আলী
  ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

বাঙালি জাতি হাজার বছর পরাধীন ছিল। কিন্তু একটি সংগ্রামী জাতি হিসেবেও বাঙালি বিশ্বে সুপরিচিত। যুগ যুগ ধরে কারো অধীনে মাথা নত করে থাকা বাঙালির স্বভাব নয়। তাই স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালি জাতি নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে। সেই তিতুমীর-খুদিরাম থেকে শেখ মুজিব পর্যন্ত আমাদের গর্ব ও বাঙালি সংগ্রামী ইতিহাসে এক উজ্জ্বল সাক্ষর। ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এ সবই বাঙালির দেশপ্রেমের এক গৌরবময় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মহানায়ক। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাকে অবসম্ভাবী করে তুলেছিলেন তার প্রবাদ পুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা ছিল অতুলনীয়। তাই একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক জনতার সামনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি বাংলার স্বাধীনতার জন্য ঘরে ঘরে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তোলার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালির স্বাধীনতাকে বাঞ্চাল করার জন্য ২৫ মার্চ রাতে রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে। ২৫ মার্চের সে ভয়াল রাতে পাকবাহিনী পিলখানা রোড, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে বিভিন্ন হলগুলোসহ পুরো ঢাকা নগরীতে ইতিহাসের এক বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ মধ্যে রাতে বাঙালির হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। গোটা বাংলাদেশ ছিল অবরুদ্ধ ও যুদ্ধের ময়দান।

আজ ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিব নগর দিবস। ১৭৫৭ সালে পলাশির আম্রকাননে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল সে প্রাচীন জেলারই আর এক আম্রকাননে জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমান জেলা) বৈদ্যনাথতলা নামে একটি গ্রামের নতুন নামকরণ করা হয় মুজিব নগর। কি অভাবনীয় পরিকল্পনা অন্য কোনো নাম কারো মাথায় আসেনি। এখানেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাফল্যের বড় পরিচয় পাওয়া যায়। এ মুজিব নগরই ছিল যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক ও সু-শৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করার লক্ষ্যে সত্তর সালের নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের নিয়ে এ মুজিব নগর সরকার ১০ এপ্রিল গঠিত হলেও ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। নব গঠিত মুজিব নগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তবে তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় উপ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে সশস্ত্র বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন। তারপর একে একে নেতারা মঞ্চে এসে বসলেন। আ. মান্নান শুরু করেন অনুষ্ঠানের সূচি। প্রথমে নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির যে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ জন্ম নিল তার নাম হলো স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা বারবার বললেন। তার প্রতিজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব, আত্ম ও স্বার্থ ত্যাগ এবং বিরাট রাজনৈতিক জীবনের বর্ণনা দেন উপস্থিত জনতা ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাংবাদিকের সামনে। তিনি বলেন, আজ এই আম্রকাননে একটি জাতির জন্ম নিল। বিগত বছর যাবত বাংলার মানুষ তার নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তা হতে দিল না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এই লড়াইয়ে জয় আমাদের অনিবার্য। আজ না জিতি কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই। পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলো তা চির দিন অম্স্নান ও অক্ষুণ্ন থাকবে। বিশ্বের মানচিত্র থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব মুছে ফেলার শক্তি কারো নেই।

তা ছাড়া মুজিব নগরের এ ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান থেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান এবং সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্বের সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান। যার ফলশ্রম্নতিতে বিশেষ করে ভারত, রাশিয়ার সাহায্য সহযোগিতায় এবং মুক্তিপাগল জনতার সশস্ত্র লড়াই অপরিমেয় দেশপ্রেম মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এত কম সময়ে স্বাধীনতা অর্জন বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীনতার যাত্রা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন- যার সফল পরিণতি ঘটান মুজিব নগর সরকার।

প্রকৃত পক্ষে মুজিব নগর বা অস্থায়ী সরকার হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কেন্দ্রভূমি। বাঙালির তীর্থক্ষেত্র। প্রতি বছর মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/শিক্ষক ছাড়াও সমাজের সর্বস্তরের জনগণ। নতুন প্রজন্মকে মুজিবনগর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। ২৪ বছরের পাকিস্তানি সরকারের শাসন শোষণের ইতিহাস পাল্টে দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব অপরিসীম। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে ২৪টি ত্রিভূজাকৃতির যে, দেয়াল রয়েছে যা ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন শোষণের এক জলন্ত প্রতীক হিসেবে বিরাজ করছে। মূলত মুজিবনগর সরকারই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁতুর ঘর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অস্থায়ী মুজিব নগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান অপরিসীম। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অস্থায়ী মুজিব নগর ছিল যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের রাজধানী। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে মুজিব নগর সরকারের সুদক্ষ পরিকল্পনায়। যে কোনো জনযুদ্ধকে পরিচালিত করে বিজয়ের মালা ছিনিয়ে আনতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার যেটা মুজিব নগর সরকারের ছিল। কেন না, মুজিব নগর সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল তাজউদ্দিন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তাজউদ্দিন আহমদের যথেষ্ট ভূমিকা ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও তাকে আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করি না।

যা হোক, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে অভাবে ১৮৫৭ সালের বাংলা সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। সে ক্ষেত্রে মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের গতি দ্রম্নত ত্বরান্বিত হয় এবং মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশে জনগণের অপরিসীম ত্যাগ তিতিক্ষা দেশপ্রেম এবং মুজিবনগর সরকারের সুদক্ষ নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালনায় তা সম্ভব হয়।

ইতিহাসে মুজিব নগর সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও সুযোগ্য নেতৃত্ব সর্বোপরি যুদ্ধ পরিচালনায় নানা কৌশল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাদের নাম ও অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

মোহাম্মদ নজাবত আলী: শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<45643 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1