শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

সামাজিক নিরাপত্তাবোধ ও সম্ভাবনাময় উৎপাদনশীলতা

মুহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন শরণখোলা, বাগেরহাট
  ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

আজ আমরা সত্যিই গর্বিত বাঙালি। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে আমাদের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা চলমান। অর্থনীতির সূচকগুলোর অবস্থানও অনেকটাই চোখে পড়ার মতোই। বাড়ছে বিদেশি বিনিয়োগ, সরকারের নানান তৎপরতা এবং সেই সঙ্গে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা। অবশ্যই তা সরকারি বিভিন্ন আয়োজনকে ঘিরে। এর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তার অবস্থান এবং পরিস্থিতি সঠিকভাবে বিশ্লেষণের সময় এখনই। এখন প্রশ্ন এটা দাঁড়াচ্ছে যে, এত উন্নয়নের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত হচ্ছে? অর্থাৎ আমরা সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনে কতটুকু নিরাপদ বোধ করছি! এটাও সরকারের প্রতি জনগণের বিশ্বাস জন্মানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি।

বাংলাদেশ ২০১৯ সালে বিশ্বের ৪১তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়েছে। ২০৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ২৪তম স্থান দখল করে বিশ্বের শীর্ষ ২৫টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের তালিকায় প্রবেশ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। উন্নয়নের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাতে বলা আছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নকে অবশ্যই পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের আওতায় রাখতে হবে। যদি গেল মাসের সার্বিক পরিস্থিতি আমরা শুধু সড়ক দুর্ঘটনা ও অপ্রত্যাশিত অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলোকে বিবেচনায় রেখে বিচার করতে যাই, তাহলেও দেশ আজ মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ভুলগুলো কিন্তু আজকের করা নয়, হঠাৎ থেকে এসব দুর্যোগ শুরুও হয়নি। এখন যা হচ্ছে সেগুলো পূর্বকৃত অসচেতনতা ও ভুলের মাশুল। যমুনা টিভিতে সম্প্রচারিত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী, সেখানেও অধিকাংশ নির্মাণে প্রথম দিকে বেশ অনিয়ম ছিল। ব্যবসায়ীরা অনিরাপদ জেনেও ঝুঁকি নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট সেতু ভেঙে অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে। এগুলোর প্রত্যেকটিই সঠিক নিয়ন্ত্রণ আর পর্যবেক্ষণের অভাবে হচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। কোনো দুর্ঘটনার পরপর টিভি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞজনদের নিয়ে বিশ্লেষণের আয়োজন করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শুরু হয় হাহাকারমূলক কথাবার্তা সেই সঙ্গে বিপদ নিয়েও ব্যঙ্গাত্মক খবরাখবর। আগে ভূমিকম্প হলে মানুষ তাদের নিরাপদ চিন্তিত করত আর এখন আগুন লাগার ঘটনায়। 'উদাসীনতা' আর 'অনিয়ম', শব্দ দুটি আমাদের দেশের বাঙালির তথা অধিকাংশ মানুষের মধ্যে জেঁকে বসেছে। সরকার, গণমাধ্যম আর জনগণ যেটুকু করছে তার অনেকটাই এর ভয়ঙ্কর থাবায় আসল উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সারা দেশে কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে বিশ্লেষণ হয়। যেমন- আগে কি করা উচিত ছিল, কর্তৃপক্ষের দ্বারা কি করা হয়েছে এবং প্রেক্ষাপটকে ঘিরে কি করা উচিত? এই বিশ্লেষণ কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে তা প্রমাণসাপেক্ষ। তাই উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক। সঠিক চিত্র তুলে ধরার জন্য জনগণের মধ্যে একটি গবেষণা চালানো যেতে পারে যে তারা মানসিকভাবে কতটুকু নিরাপদ বোধ করেন? তবে তাদের উত্তরটি যে সরাসরি হঁ্যা হবে না তা বোঝাই যাচ্ছে। যথাযথ নিরাপত্তাবোধ দ্বিধাহীন সন্তুষ্ট আনে আর যা একই সঙ্গে দেশের উৎপাদনশীলতা এবং সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে। জনৈক তত্ত্ববিদের 'প্রয়োজন বা চাহিদার পদসোপান'-এর একটি গুরুত্ববহ ধাপ হচ্ছে 'নিরাপত্তা'। তত্ত্বটি পুরনো হলেও এটি বর্তমানে উপলব্ধ বটে! আজ বাংলাদেশ যতটা সমৃদ্ধ তা রক্ষা করাটা অনেকটাই নির্ভর করছে জনগণের নিরাপদ বোধ করার ওপর। অন্যথায় উন্নয়ন স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না বলেই বিজ্ঞজনরা মনে করেন। যে ভুলগুলোর কারণে আজ কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, অবৈধ দখলদারিত্ব সরানোয় ঘর-বাড়িচু্যত হতে হচ্ছে, সে ভুলগুলোর যেন আর পুনরাবৃত্ত না হয় সেদিকে যথাযথ নজরদারী এখন সময়ের দাবি। সচেতন জাতি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করার এখনই সময়। সরকারি কর্তৃপক্ষের সবাই যদি তাদের বিবেচনায় স্বচ্ছ হন তাতে অনেক কাজই কঠিন হয়ে উঠবে। তবে তাতে উদ্যমী হওয়াটা বন্ধ করা যাবে না। ভালো থাকতে চাই আমরা সবাই আর দিনশেষে এটাই সর্বোচ্চ সত্য। তাই আমাদের চিন্তা, পরিকল্পনা এবং করণীয় সেই অনুযায়ী হোক। সংবিধানে বলা আছে, 'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস' আর কথাটির তাৎপর্য অনেক। আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন আর সচেষ্ট হলে তা প্রকৃত উন্নয়নকে ধারাবাহিক করতে আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবে।

অন্যায়ের কাছে হার মানতে হলো জীবনের। বলি হলো প্রাণ। মারা গেল ফেনীর সোনাগাজীতে অগ্নিদগ্ধ নুসরাত জাহান রাফি। অপরাধ তার পরিবার গত ২৭ মার্চ শ্লীলতাহানীর জঘন্য এ কাজটির জন্য কেন শিশু ও নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন! এ জন্য ৬ এপ্রিল তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যায়। ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায় মেয়েটি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমরা অপরাধীদের বিচার দাবিতে তাৎক্ষণিক সারা দেশে কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ দেখিনি। শাহবাগ থেকে শুরু করে সারা দেশে নারীকে একটি গালির জন্য যেরকম প্রতিবাদ হয় বা বিগত দিনে হয়েছে তার সহস্র ভাগের একভাগও হয়নি। কারণ হিসেবে বিজ্ঞজনরা সঠিকই বলেছেন এখন বোরকা পরলে ছাত্রী সংস্থার সদস্য হয়ে যেতে হয়। আরও মেয়েটি যদি হয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী তাকে কী ভাবছে মানুষ ভাবা যায়!

আমরা এক আজব দেশে আর সমাজে বাস করি। কেউ প্রতিবাদ করছেন গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না টি-শার্টের উপর লিখে। আরে এখন তো বাংলাদেশে বেশির ভাগ মেয়েরা খোলামেলা চলাফেরা করে কয়জন গা ঘেঁষে দাঁড়ায়? দাঁড়ানোর সাহস পায়? আমি একজন লোকাল বাসের যাত্রী হিসেবে বলব বাসে মেয়েদের যথেষ্ট সম্মান দেখানো হয়। মেয়েরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হয় অন্যত্র, বাসে নয়। আর বাংলাদেশে যে ধর্ষণগুলো হয় সরাসরি ধর্ষণ হয়। ধর্ষক যদি এতকিছু মানতো তবে তো সে ধর্ষণ করত না। আমাদের দেশের আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। যা আমরা নুসরাতের অগ্নিদগ্ধের পরেও দেখতে পেয়েছি। পরিবারের অভিযোগ রাজনৈতিক চাল হচ্ছে। ওসিকেও প্রত্যাহার করতে হয়েছে। বাস্তবতাটাই আসলে বাংলাদেশে এমন যদি সঠিক আইন প্রয়োগ হত তবে কেউ ধর্ষণ করাতো দূরে থাক অন্য মেয়েদের দিকে বিনা কারণে তাকানো সাহস করত না। তখন কারও আর গায়ে বিজ্ঞাপন নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হতো না যে, 'গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না।' লেখাটি শেষ করার আগে দুটি প্রশ্নের আলোচনা দিয়ে শেষ করব। প্রশ্ন দুটি সবাই করছেন যে পর্দাই যদি সমাধান হতো তবে দুই বছরের শিশু কেন ধর্ষণের শিকার হয়? আর একটি প্রশ্ন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌলা যদি ধর্ষণ করেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হয়ে! মাদ্রাসা? আমি তাদের বলব- আলস্নাহ কিন্তু পবিত্র কোরআনে বলেছেন, 'হে ইমানদারগণ (বিশ্বাসীগণ)! তোমরা দ্বীনের ভিতরে পুরোপুরিভাবে প্রবেশ করো...। (বাকারা)' যেহেতু এটি মুসলিমদের বলা হয়েছে এবং আরও জানি পবিত্র কোরআনুল কারিমে ধর্ষণের শাস্তি কতটা ভয়াবহ করেছেন। কিন্তু আমরা যদি ইসলামের একটি মানি অন্যটি বাদ দিই আবার সেই একটি মেনে অন্যটি বাদ দেয়া ব্যক্তিটিকেই ইসলামের আইনের কষ্টিপাথরে ফেলে যাচাই-বাছাই করতে চাই বিষয়টি কি হাস্যকর নয়? যদি পবিত্র কোরআন হিসেবে শাস্তি দেয়া হয় তবে তারপর থেকে আর ধর্ষককে খুঁজে পাবেন কি? আবার হয়তো উদাহরণ দেবেন সৌদি আরবেও তো ধর্ষণ হয়। হঁ্যা, সৌদি আরব কিন্তু ইসলামের আইন-কানুন নয়, আইন-কানুন হলো কোরআন-হাদিস। আর সৌদি যদি এটি মেনে বিচার না করেন ইসলামী আইন চালু থাকার ফলেও তবে এর জন্য কিন্তু কোরআন-হাদিস আর মাদ্রাসা দায়ী নয়, দায়ী হলো সরকার, প্রশাসন এবং অপরাধীরা। মাদ্রাসার কাজ হলো নৈতিকতা শেখানো মানা-না মানা, ভালো-মন্দ তো ব্যক্তির ভিতরকার সমস্যা। তবে বাংলাদেশে মাদ্রাসায় চাকরি প্রদানের আগে আমি অনুরোধ করব অন্তত যাতে একবছর নৈতিকতা যাচাই করে। নৈতিক ভিত্তি কতটুকু ভালো এক বছর দেখে তারপর চাকরিতে স্থায়ী করা। প্রতিক্ষেত্রের চাকরিতে এটি করা উচিত। কারণ ৯ এপ্রিল গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে ধর্ষণ এমনকি কর্মচারী নারীর সন্তানের বাবা ওই ভিসি এমন অভিযোগ উঠেছে। যাই হোক ধর্ষণ যেই করুক হোক সে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সবার আইনুযায়ী কঠিন শাস্তি হোক। মাদ্রাসা আর পর্দাকে দোষবেন না। কারণ শতাংশ হিসেব করলে মাদ্রাসায় এ ধরনের ঘটনা কম ঘটে এবং পর্দাশীলদের ক্ষেত্রেও কম ঘটে। আপনাদের কাছে অনুরোধ ফ্যাশন বোরকা পরা মেয়েদের আবার পর্দানশীল বলে চালাবেন না। নুসরাতের ঘটনায় যারা জড়িত দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে সঠিক তদন্ত করে অপরাধীদের কঠিন শাস্তি দিন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<45644 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1