শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এমন মর্মান্তিক ঘটনা আমরা আর দেখতে চাই না

নারীর ক্ষমতায়নসহ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে বাংলাদেশের নারীসমাজ বিশ্বে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে এদিক থেকে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি প্রতিরোধে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্নসহ দেশে যথেষ্ট ভালো আইন রয়েছে। ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেয়ার দাবিও উঠেছে। তবে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, বিস্তৃত পরিসরে এর প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে।
ফারহানা মাহমুদ তন্বী
  ১৮ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

দিনের পর দিন নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা যেন পালস্না দিয়ে বেড়ে চলেছে। অতি সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাত জাহান রাফি নামে এক মাদ্রাসাছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা যেমনি নিষ্ঠুর-নৃশংস, তেমনি হৃদয়বিদারক। রাফি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা। দগ্ধ ও মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে প্রথমে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স এবং অনতি পরেই ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাফির সর্বোত্তম চিকিৎসা চলছে। দোয়া করি এবং সবার কাছে দোয়া চাই সে যেন সুস্থ হয়ে ওঠে।

নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়, না কর্মস্থলে, না শিক্ষাঙ্গনে আর না ঘরে। সর্বত্রই তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গত বছর একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত শিরোনাম ছিল 'লোহাগড়ায় গাছে বেঁধে গৃহবধূকে নির্যাতন'। চৌদ্দশত বছর পূর্বে অর্থাৎ অজ্ঞতার যুগেও মনে হয় এমনটি করা হতো না যা আজ নারীদের সঙ্গে করা হচ্ছে। সুন্দরভাবে বাঁচার কাম্য কার না রয়েছে। সবাই চায় এ সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচতে। আমাদের দেশে আড়াই বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পালা দিয়ে বাড়ছে আদিবাসী নারীদের ওপর নির্যাতন। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। ধর্ষণ নামের এই সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করতে ধর্ষকের দ্রম্নত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে অন্যান্য অপরাধীরাও সচেতন হয়ে যায়। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, গণধর্ষণসহ জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা ঘটছে। আর ঘটনাটি কেবল বিয়ে বা ধর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে। অথবা ধর্ষিতা পরিবার সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করছে। তদুপরি তথাকথিত ফতোয়া বা সামাজিক বিচারের রায়ে ধর্ষকের পরিবর্তে শাস্তি দেয়া হচ্ছে ধর্ষিতাকে। সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষকরা এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে বেশি করে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ওয়াজগুলোতে সমাজের চাহিদার দিকে লক্ষ্য না রেখে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতেই যেন হুজুররা ব্যস্ত থাকে। একের পর এক নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে অথচ আমাদের হুজুররা এসব বিষয় নিয়ে কোনো চিন্তা করেন না, তারা শুধু আছেন কাকে কাফের ফতোয়া দেয়া যায় আর নাস্তিকদের বিচার কীভাবে করা যায়। নুসরাত জাহান রাফির সঙ্গে যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে তাও করেছে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ দৌলা। এ ধরনের পিশাচদের নামের আগে মাওলানা শব্দ ব্যবহার করাও মনে হয় আমাদের ঠিক হবে না। যাদের দ্বারা এ ধরনের নিকৃষ্ট কাজ সংঘটিত হতে পারে তারা মানুষ নামে কলঙ্ক। এসব তথাকথিত হুজুর বা মাওলানাদের হাত থেকে আলস্নাহ আমাদের রক্ষা করুন।

এ দেশের নারীরা আজ নির্মমভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। নুসরাত জাহান রাফির মতো কত নারীই ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃতু্যর জন্য অপেক্ষা করে। প্রত্যেহ কতই না এমন খবর প্রকাশিত হয় যে, শিশু ধর্ষিত, ধর্ষণের পর হত্যা, গ্রামের পাটের ক্ষেতে, ভুট্টার ক্ষেতে বা ডোবা-নালায় ধর্ষিতা নারীর লাশ পাওয়া গেছে বা দুই বছরের শিশুকে পা দিয়ে গলায় টিপে ধরে গৃহবধূকে ধর্ষণ এ ধরনের খবর পত্রিকার নিয়মিত আয়োজন। একের পর এক ধরনের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে আর অপরাধীরা পারও পেয়ে যাচ্ছে। পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই তো এ ধরনের জঘন্য কাজটি করতে অপরাধীদের মনে কোনো ধরনের ভীতির সঞ্চার হয় না।

ধর্ষণের সংখ্যা ও ব্যাপ্তি বাড়ছে দিন দিন। প্রতি মাসে গড়ে ৫৫ শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ২৬৯টি বেসরকারি সংস্থার পস্নাটফর্ম বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ২০১৮-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই পরিসংখ্যান। গত বছরের প্রথম তিন মাসে ১৭৬ জন শিশু শিকার হয়েছে ধর্ষণের। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৫ শিশুকে। গত বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৪৫ শিশু। এর কারণ দুর্বল চার্জশিট, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সর্বোপরি বিচারহীনতার সংস্কৃতি। নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার শিশুরা অসহায় ও দরিদ্র বিধায় অপরাধীরা ক্ষমতাবান হলে মামলার গতি মুখ থুবড়ে পড়ে। আদালতে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানি প্রমাণ করাও কঠিন। তদুপরি রয়েছে সামাজিক সম্মান ও লোকলজ্জা। যে কারণে আজ পর্যন্ত প্রায় কোনো ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। ফলে ধর্ষণের প্রকোপ বেড়েই চলেছে।

নারীর ক্ষমতায়নসহ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে বাংলাদেশের নারীসমাজ বিশ্বে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে এদিক থেকে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি প্রতিরোধে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্নসহ দেশে যথেষ্ট ভালো আইন রয়েছে। ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেয়ার দাবিও উঠেছে। তবে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, বিস্তৃত পরিসরে এর প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে।

অবশ্য এর জন্য নিম্ন আদালতসহ থানা-পুলিশও কম দায়ী নয় কোনো অংশে। সেখানে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আছে বিস্তর। প্রশ্ন হলো আর কত দিন এভাবে নারী ও শিশুরা নির্যাতিত হতে থাকবে? নারী এবং শিশুদের ওপর নির্যাতনকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় যত দিন না আনা হবে তত দিন সম্ভব নয় এ দেশ থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ করা। একই সঙ্গে প্রত্যেক পরিবারকেও হতে হবে সচেতন। অপরাধী যেই হোক তাকে কোনোভাবে ছাড় দেয়া যাবে না।

ফারহানা মাহমুদ তন্বী: কলাম লেখক

ভধৎযধহধঃড়হহর২০১৫@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<45760 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1