শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যৌন সহিংসতা, যৌনতা এবং পুলিশি শিক্ষা

জনগণকে সেবা দিতে হলে পুলিশবাহিনীর মধ্যে থাকতে হবে স্বশিক্ষা-সুশিক্ষা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ। অতি সম্প্রতি, 'নুসরাত জাহান রাফির' কেসের ক্ষেত্রে প্রথম দিককার পুলিশি ভূমিকা ছিল একজন এন্টিসোশ্যাল কর্মীর মতো, শুধু জ্ঞান এবং ইচ্ছে শক্তির ঘাটতির জন্য।
মুশফিকা লাইজু
  ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

নারীর প্রতি যখনই কোনো নিযার্তন কিংবা সহিংসতার ঘটনা ঘটে তখনই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কমবেশি বির্তক ওঠে এবং চলমান থাকে। খুবই আশ্চর্য, এমন একটা ঘটনা নেই যেখানে পুলিশের নেতিবাচক ভূমিকার কথা প্রকাশিত বা সমালোচিত হয়নি। সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগীরা পুলিশবাহিনীর প্রতি আস্থা, শ্রদ্ধা তথা সম্মান হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এই প্রশ্ন কোটি জনতার এবং এটা একটা জাতীয় সমস্যা। হয়তো জাতীয়ভাবে সমস্যা চিহ্নিত হয়নি কিন্তু এখন এটা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশে অন্যান্য সমস্যার মধ্যে এটি একটি উলেস্নখযোগ্য জটিল সমস্যা। এই সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের দক্ষতা, সম্মান এবং সভ্যতা ও নৈতিকতার প্রশ্নও।

এটা কঠিন সত্য, বাংলাদেশে তথা বিশ্ব-সমাজের কাছে নারীর প্রাপ্যতা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর। এখনকার বাংলাদেশে সহিংসতা, নিযার্তন এবং নারী- রীতিমতো পরিপূরক শব্দ। নারী যখন কোনো সহিংসতার শিকার ও নিপীড়িত হন; অনেক বাধা অতিক্রম করে একটু ন্যায়বিচারের জন্য রাষ্ট্র কাঠামোর নাগরিক সুরক্ষার প্রথম ধাপ পুলিশের শরণাপন্ন হন। অনেক ভয় দ্বিধা নিয়ে সুরক্ষা চাইতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হন। ফলাফল শূন্য। আবারও নিপীড়ন আবারও অন্যায্যতা। এ যেন বেড়ার ক্ষেত খাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু কেন, এমন তো হওয়ার কথা নয় পুলিশ বিভাগ রাষ্ট্রের একটি জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, বিভাগ যখন তাকে নিয়োগ দেয় তখন কী তার নীতি, মূল্যবোধ, সেবাদানের কৌশল, সেবাদানের উদ্দেশ্য, রাষ্ট্রের আদর্শ, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি- এ সব বিষয়ে তাকে তৈরি করার জন্য, বিকাশের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক কিংবা যৌক্তিক প্রশিক্ষণের জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করা হয় একজন পুলিশ ভাই কি অপরাধবিজ্ঞানের পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সাম্প্রতিক বিশ্ব সম্পর্কে শেখেন বা ধারণা রাখেন আমার/আমাদের জানা নেই! ধরে নিই, তারা জানেন বা চর্চা করেন, তাহলে তাদের কার্যক্ষেত্রে এহেন আচরণ কেন কেন প্রতিটি নারী সহিংসতার ঘটনায় তাদের ভূমিকা দেশবাসীর কাছে বির্তকিত হয় এবং সত্যতা প্রমাণে বাধা হয়ে দাড়ায়

আসল জুজুটা কোথায় তাদের মানসিকতায় মূল্যবোধে নাকি এটা তাদের পুরুষতান্ত্রিক মগজের সীমাবদ্ধতা! যদি তাই হয়, তবে সরকার কেন তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন না, যে কীভাবে একজন সহিংসতার বা পারিবারিক বা সামাজিক নিযার্তনের শিকার নারীর কেসটির ব্যবস্থাপনা করতে হয় বা হবে। কোনটা যৌনতা, কোনটা যৌন সহিংসতা, কোন অপরাধের গভীরতা কতটা, সে বিষয়ে তাদের জ্ঞান একেবারেই সীমাবদ্ধ।

এই সব ঘটনা কতটা সহানুভূতিশীল হয়ে স্পর্শকাতরতার এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করতে হয় তা সত্যিকারই তারা জানে না। শুনেছি, কিছু দাতা সংস্থার অর্থায়নে দুই-একটি প্রকল্প চালু আছে বা ছিল পুলিশ বিভাগের কর্মীদের জেন্ডারসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের। যদি তাই হয় তবে তার ইতিবাচক প্রভাব কোথায় যদি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকতারাই প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন তবে তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা করবেন কী করে। বেশিরভাগ অভিযোগকারিণী পুলিশি নিযার্তনের শিকার হন জেলা বা থানা পর্যায়ে দাখিলকৃত কেসগুলোতে। কারণ পুলিশের কর্মকান্ডের জন্য সম্ভবত জবাবদিহিতার কোনো রুটিন ফলোআপ থাকে না। যদি থাকতো তবে কোন পুলিশ কর্মকতা ভুলেও ভুল করে থাকলে ঊর্ধ্বতনের সহযোগিতায় সঙ্গে সঙ্গে সংশোধিত হয়ে যেত। তা ছাড়া নারীর প্রতি হওয়া কেসগুলো ডিল করা হলো একটি কৌশলগত প্রক্রিয়া। ভিক্টিমকে সহযোগিতা দিতে বা ন্যায়বিচার করার জন্য সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে জ্ঞানগত কৌশল অনুসরণ করা প্রয়োজন। সেই কৌশলের মধ্যে আছে সাধারণবিজ্ঞান, যুক্তিবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, দশর্ন ও মনোবিজ্ঞানের ওপর বিশদজ্ঞান। যতদূর জানি, এ ধরনের সামষ্টিক জ্ঞান বা চর্চানির্ভর কোনো প্রশিক্ষণ পুলিশবাহিনীতে নিয়োগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা করা হয় না। শুধু আত্মরক্ষা, অস্ত্র চালনা, স্বাস্থ্যচর্চা, ঘোড়া চালনোটাই সব নয়। একটি দেশের ন্যায্যতার প্রাথমিক স্তর হিসেবে মানুষের খুব কাছ থেকে পুলিশবাহিনী সেবা দিয়ে থাকে সুতরাং তাকে ওই গণমানুষের মানসিক অবস্থাটা জানতে হবে সবার আগে। সোনা চুরি আর রুটি চুরির জন্য একই আচরণ বা পথ অনুসরণ করা যাবে না। প্রতিটি নারী নিযার্তনের এবং যৌন সহিংসতার ঘটনাকে পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় আলাদা আলাদাভাবে ডিল করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক মনস্তাত্ত্বিকতা ঝেড়ে ফেলে স্থানীয় সংস্কৃতি বিবেচনায় পেশাগত ভূমিকা পালন করতে হবে।

একথা সত্যি যে, একজন না জানা এবং অজ্ঞানলব্ধ মানুষ শুধু পারিপার্শিক ধারণাগত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পেশার ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত সেবা দিতে পারবে না। সুতরাং শুধু ব্যাক্তি পুলিশকে তার অপেশাদারি আচারণকে ঢালাওভাবে দোষ না দিয়ে গোটা পুলিশবাহিনীর অবকাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন।

জনগণকে সেবা দিতে হলে পুলিশবাহিনীর মধ্যে থাকতে হবে স্বশিক্ষা-সুশিক্ষা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ। অতি সম্প্রতি, 'নুসরাত জাহান রাফির' কেসের ক্ষেত্রে প্রথম দিককার পুলিশি ভূমিকা ছিল একজন এন্টিসোশ্যাল কর্মীর মতো, শুধু জ্ঞান এবং ইচ্ছে শক্তির ঘাটতির জন্য।

যদি কর্তব্যরত ঐ পুলিশ অফিসার ঘটনার প্রথম মিনিট থেকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতেন, তবে হয়তো দেশ কাঁপিয়ে পৃথিবীকে লজ্জিত করে আমাদের স্বাধীন দেশের অনাচারকে গোটা পুলিশবাহিনীকে প্রশ্নের মুখে রেখে এভাবে অকালে মরে যেতে হতো না নুসরাতকে।

পৃথিবী, দেশ, সমাজ এবং পরিবারেও এমনিতে নারীরা অহরহ নিযার্তনের শিকার এহেন পরিপ্রেক্ষিতে যদি বিচারের আশ্রয়ের পারাকাষ্ঠা থেকে আবারও তাকে অবিচারের শিকার হতে হয় তবে সে লজ্জা সভ্যতার। এমনিতেই বাংলাদেশের আইন নারীবান্ধব নয়, তথাপি যতটুকু আছে সেটুকু কাজে লাগিয়ে পুলিশ কর্মীরা নারীর প্রতি হওয়া নির্যাতনও সহিংসতার ঘটনাগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনা করেন, তবে হয়তো বেঁচে যাবে কিছু প্রাণ, সম্মানিত হবে কিছু সম্ভ্রম। হাজারো কেসস্টাডির মাঝে থেকে দুটো ঘটনার সামান্য অংশ শেয়ার করছি।

ঘটনা ১). আমার একবন্ধু নারী অধিকারকর্মী, তিনি একা ডেমরাতে বসবাস করতেন। কপালে টিপ পরে মাথায় ঘোমটা না দিয়ে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেন বলে একরাতে নিজের ঘরে শিকার হন নৃশংস আক্রমণের। কোনো মতে জানে বেঁচে হাসপাতাল হয়ে যখন থানায় গিয়েছেন কেস ফাইল করতে, প্রথমেই দ্বায়িত্বরত পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে বাধা আসে। সেই পুলিশ অফিসার তাকে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন সাধারণ ডায়েরি করার জন্য। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি আমার ওই বন্ধুকে খারাপ মেয়ে প্রমাণ করার জন্য রাত একটা পর্যন্ত থানায় বসিয়ে রেখে হাজারো চেষ্টা করেছেন। যাই হোক, ওই অপরাধী 'বুনো ওলে'র পালস্নায় পড়েছিল বলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়েছে।

ঘটনা ২). আমার আর এক সহযোদ্ধা বোনকে পাঠিয়েছিলাম আইসিটিতে মামলা করার জন্য। কারণ সাবেক প্রেমিক তাদের একান্ত মুহূর্তে কিছু ভিডিও ফুটেজ পাবলিকলি পোস্ট করেছিল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাকেও একই আচারণের শিকার হতে হয়েছে। পরে পুলিশ হেড কোয়ার্টার টু ধানমন্ডি থানা- এমনি করে বেশ কয়েকদিন সময় ব্যয় করার পর কোনো একটা কিনারা সে পেয়েছে হয়তো! তবে এরই মধ্যে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছে সে নষ্টা মেয়ে নয়। এভাবেই পুলিশের স্মরণাপন্ন হলে নারীকে কয়েক দফা হেনস্তা হতে হয়, এর অবসান প্রয়োজন। যদি ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মী সঠিকভাবে জানতেন যে, নারী ভিক্টিমদের কেসগুলো কীভাবে ব্যবস্থা করতে হয়, তবে হয়তো বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর উল্টোটাই ঘটতো।

সুতরাং সমাজের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মনে করি, নারী ভিক্টিমকে পুলিশি নিযার্তনের হাত থেকে মুক্তি দিতে হলে বা কমাতে হলে, পুলিশ কর্মীদের জন্য সময়োপযোগী বিষয়ভিত্তিক উচ্চতর প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।

মুশফিকা লাইজু: উন্নয়ন কর্মী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<46370 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1