শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রীলংকায় সন্ত্রাসী হামলা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

সন্ত্রাসী যেই ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, তার মূল পরিচয় সে সন্ত্রাসী, একজন সন্ত্রাসীর কোনো ধর্মই থাকতে পারে না। কেননা প্রতিটি ধর্মই মানুষকে শান্তির বার্তা দেয়। এখন ঘুমিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। যার যার স্থান থেকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
মাহমুদ আহমদ
  ২৫ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার শোক না কাটতেই শ্রীলংকায় ভয়াবহ বোমা হামলা। গত ২১ এপ্রিল শ্রীলংকায় ইস্টার সানডে চলাকালে গির্জা ও বিলাসবহুল হোটেলে ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯০-এ। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন প্রায় ৫০০ জন। ভয়াবহ সন্ত্রাসী এই হামলায় সমগ্র বিশ্বে বিরাজ করছে আতঙ্ক। এ ঘটনায় বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমরাও শোকাভিভূত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ এসব সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই আমরা নৈরাজ্যকর কোনো না কোনো খবর মিডিয়ার সুবাদে পেয়ে থাকি। যদিও 'ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত' নামে একটি স্বল্প পরিচিত স্থানীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে এ হামলার জন্য অভিযুক্ত করছে শ্রীলংকার সরকার। শ্রীলংকা পুলিশের দাবি, তারা ১০ দিন আগেই ন্যাশনাল তাওহিদ জামাতের হুমকির ব্যাপারে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন। ফরাসি সংবাদমাধ্যম এএফপির হাতে পাওয়া নথি অনুযায়ী, গির্জায় হামলার ব্যাপারে শ্রীলংকার পুলিশকে আগেই সতর্ক করেছিল 'একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা'। বিষয় হচ্ছে, যে সংগঠনই ন্যক্কারজনক এ কর্মকান্ডের জন্য দায়ী তাদের মূল পরিচয় হলো সন্ত্রাসী। বর্তমান সবচেয়ে আলোচিত শব্দ হলো সন্ত্রাসবাদ। মূলত যারা এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো ধর্ম নেই। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের যে অপ্রতিরোধ্য বিস্তার ঘটছে, তাতে এটি সর্বাপেক্ষা বড় 'আতঙ্কে' পরিণত হয়েছে। এ সংকটময় পরিস্থিতিতে বিশ্বশান্তি ও ইসলামের ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করা সময়ের অপরিহার্য দাবি হয়ে উঠেছে। কারণ বিশ্বের কোথাও কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সংঘটিত হলে তৎক্ষণাৎ কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই মুসলমানদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হয়ে থাকে, যদিও এটি ঠিক নয়। কেননা যারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে তারা কখনও কোনো ধর্মের অনুসারী হতে পারে না, তাদের পরিচয় তারা সন্ত্রাসী।

আমেরিকার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৮২-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৭৫টি সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়েছে। এর অধিকাংশ সংঘটিত হয়েছে খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদের দ্বারা। তাই বলে কি আমরা বলব, সকল সন্ত্রাসীই খ্রিষ্টান বা ইহুদি? অবশ্যই না। এসব মিডিয়া জিহাদকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলারও অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। 'ইসলামের নামে সন্ত্রাস' সৃষ্টি ইহুদিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্তেরই ফসল। কোরআনের কিছু আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে জিহাদের নামে সন্ত্রাস বৈধ করার অপচেষ্টা করছে তারা। বিশেষত আধুনিক তরুণ যাদের অধিকাংশই ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের মধ্যে ইসলামের বিকৃত ধারণা দিয়ে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করছে। অথচ ইসলাম শান্তির ধর্ম আর ইসলামের উত্তম আদর্শে মুগ্ধ হয়েই যুগে যুগে মানুষ ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছে। রাসুলুলস্নাহ (সা.) তায়েফের ময়দানে অমুসলিমদের নির্যাতনে রক্তাক্ত অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও তাদের প্রত্যাঘাত করার কথা ভাবেননি। ইসলাম প্রচারের পদ্ধতি সম্পর্কে আলস্নাহর নির্দেশ হলো- 'আপনি আপনার পালনকর্তার পথের দিকে আহ্বান করুন জ্ঞানগর্ভ কথা ও উত্তম উপদেশগুলোর দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন' (সুরা নহল, আয়াত: ১২৫)। এমন উন্নত আদর্শ থাকা সত্ত্বেও ধর্মের নামে অনেকে সন্ত্রাসী কার্জক্রমে জড়িয়ে পড়ে আর বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। আমাদেরকে দেখতে হবে এসব সন্ত্রাসী সংগঠন কীভাবে গড়ে উঠল, কীভাবে এত শক্তিশালী হয়ে উঠল এবং তাদেরকে কারা দাঁড় করিয়েছে আর এর পিছনে মূল কারণই বা কী? শ্রীলংকায় ভয়াবহ হামলায় যেমন 'ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত'-এর নাম উঠে এসেছে ঠিক তেমনি অসংখ্য এমন সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে যারা ধর্মকে পুজি করে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে। আর বিশেষ একটি মহল নিজদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে এদেরকে মদদ দেয়। আমরা দেখতে পাই আইএসের উত্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ইরাকে সাদ্দামের পতন। মূলত আল-কায়েদা থেকেই আইএসের উত্থান। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তাদের তান্ডব দেখছে বিশ্ববাসী। নিরীহ মানুষদের পুড়িয়ে মারছে, জবাই করছে। নিরপরাধ নারী ও শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না এদের হাত থেকে। বলা যায় এসব সন্ত্রাসী গ্রম্নপের পথ ধরেই সমগ্র বিশ্বে আজ শত শত সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্ম হয়েছে। শ্রীলংকার ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত তারা নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী, তাদের কোনো ধর্ম নেই।

এই যে সমগ্র বিশ্বে ধর্মের নামে নজিরবিহীন সহিংসতা, তা শুধু ইসলাম নয় বরং কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। নৈরাজ্য সৃষ্টি করে কাউকে ধর্মের সুশীতল ছায়ার বেহেস্তি বাতাসের স্বাদ উপভোগ করানো যায় না। নৈরাজ্যের মাধ্যমে কেবল বিশৃঙ্খলাই দেখা দিতে পারে শান্তি নয়। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চাই ধর্মের শান্তিময় শিক্ষার বাস্তবায়ন। বিশ্বনিয়ন্ত্রণকর্তা সব সময়ই মানুষকে শান্তির পথে আহ্বান করে থাকে। প্রকৃত-শান্তির ধারক ও বাহক কখনো সমাজের ও দেশের অশান্তির কারণ হতে পারে না।

এসব নৈরাজ্যকারীদের জন্য সমগ্র বিশ্বই আজ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি নৈতিকভাবে চরম অধঃপতনে নিপতিত। পরিশেষে একটি মৌলিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখা শেষ করব। শ্রীলংকায় যে একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি স্থানে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয় তদ্রম্নপ বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশেও দেশের ৬৩ জেলায় জঙ্গি হামলা করা হয়েছিল, সেই হামলার কথা আমাদের অবশ্যই মনে আছে। শ্রীলংকার এই হামলা এবং বাংলাদেশের সেদিনের হামলার বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কিছুটা মিল রয়েছে। অমিল হচ্ছে হতাহতের বিষয়ে। বাংলাদেশে ওই হামলায় কেউ হতাহত হয়নি। আমাদের অনেকের ধারণা হলো, নাইজেরিয়াতে, মধ্যপ্রাচ্যে, আফগানিস্তানে, নিউজিল্যান্ডে, শ্রীলংকায় অথবা পাকিস্তানে যা হচ্ছে আমাদের দেশ তথা বাংলাদেশে তা হবে না। কেননা আমাদের দেশ তাদের কাছ থেকে দূরে অবস্থিত। আমরা নিরাপদ থাকব। এটি আত্মপ্রসাদ বলে আখ্যায়িত হতে পারে ঠিকই কিন্তু একে আত্মঘাতী আত্মপ্রসাদ বলতে হবে। বিপদ দেখে উটপাখির মত মাথাটা বালির মধ্যে লুকালে কিন্তু রক্ষা পাওয়া যাবে না। কেননা, 'তালেবানিত্ব' কোনো জাতীয়তা বা কোনো বিশেষ দেশের নাগরিকের নাম নয়। নির্দিষ্ট একটি সীমানায় আবদ্ধ কোনো জীবেরও নাম নয়। এটি একটি বিকৃত মানসিকতার নাম। এটি যে কোনো দেশে যে কোনো সময় মাথাচাড়া দিতে পারে।

তাই সময় থাকতেই এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের এই শান্তিময় দেশে কোনো সন্ত্রাসীদের স্থান নেই। সন্ত্রাসী যেই ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, তার মূল পরিচয় সে সন্ত্রাসী, একজন সন্ত্রাসীর কোনো ধমই থাকতে পারে না। কেননা প্রতিটি ধর্মই মানুষকে শান্তির বার্তা দেয়। এখন ঘুমিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। যার যার স্থান থেকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

মাহমুদ আহমদ: কলাম লেখক

সধংঁসড়হ৮৩@ুধযড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<46667 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1