বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষ মানবসম্পদ ও জ্ঞানভিত্তিক আঞ্চলিক উন্নয়ন

জ্ঞানভিত্তিক এলাকা উন্নয়ন ধারণা জনগণের একটি অংশকে দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সমৃদ্ধির যুগে প্রবেশের জন্য তৈরি করার একটি বলিষ্ঠ উদ্যোগ। শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন অর্থাৎ জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে আর্থিক সম্পদ এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জ্ঞানের ভিত্তিতে সমৃদ্ধশালী স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার এই মহতী প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ জাতির জন্য একটি অনুকরণীয় প্রত্যয়ের জন্ম দেবে। এর ফলে দেশের উন্নয়ন ও আত্মমর্যাদাশীল সম্পদশালী জাতি গঠনের পথ প্রশস্ত হবে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ১৬ মে ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক ও আর্থিক সম্পদের পরিমাণ অতি নগণ্য। জনগণকে মানব সম্পদ হিসেবে উন্নয়ন করে ভৌত সম্পদের সীমাবদ্ধতা লাঘব করা এবং একই সঙ্গে আর্থিক সম্পদ সৃষ্টির ভিত গঠন করা সম্ভব। জনগণকে মানব সম্পদ হিসেবে রূপান্তরের একটি প্রধান পন্থা হলো জনমানুষের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন। গুরুতর আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চতর পর্যায়ে শিক্ষার ভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য অব্যাহত প্রচেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পর্যায় পর্যন্ত বৃত্তি, উপবৃত্তি ও বেতন মওকুফের মাধ্যমে মেয়েদের শিক্ষা সম্প্রসারণের বিশেষ প্রয়াস এই প্রচেষ্টার একটি উলেস্নখযোগ্য দৃষ্টান্ত। শিক্ষাবিস্তারে অঞ্চলভিত্তিক অসমতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে এবং প্রতিটি শহরে ও উপ-শহরের ওয়ার্ড/মহলস্নায় অনেক উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বা আরও উচ্চতর শিক্ষাগত যোগতা সম্পন্ন তরুণ-তরুণী রয়েছে। তবে বাস্তবে দেখা যায় যে এসব শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশের শিক্ষা ও দক্ষতা বাজারে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বা তারা সুযোগ/সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিতে পারছে না। ফলে এই সব শিক্ষিত তরুণ-তরুণী শিক্ষিত বেকাররূপে সমাজে বোঝাস্বরূপ পরিগণিত হচ্ছে এবং তারা নিজেরাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। বাজারমুখী জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাতে বিনিয়োগকে উৎপাদনমুখী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করতে হবে। এই বিষয়টিই জ্ঞানভিত্তিক এলাকা উন্নয়ন ধারণার ভিত্তিতে মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি (এনজিও) পর্যায়ে ক্ষুদ্র-ঋণ পদ্ধতির মাধ্যমে অতি দরিদ্র ও বিশেষ শ্রেণির জনগণকে কেন্দ্র করে এলাকাভিত্তিক উন্নয়নের (গ্রাম ও শহরে) প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই ক্ষুদ্র-ঋণ পদ্ধতির মাধ্যমে কিছুটা হলেও দারিদ্র্য উপশম হয়েছে, তবে বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ গ্রহীতার ক্ষেত্রে সমৃদ্ধির কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এর ফলে জনগণ দারিদ্র্যের চক্রজালেই আবদ্ধ হয়ে আছে এবং দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।

জ্ঞানভিত্তিক এলাকা উন্নয়নের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে প্রতিটি গ্রামের/মহলস্নার তরুণ-তরুণীদের উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বাজারমুখী (দেশে ও বিদেশে) জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন ডিগ্রি/ডিপেস্নামা/উচ্চ মাধ্যমিক উত্তর সার্টিফিকেট অর্জনের ব্যবস্থা করা হবে। আশা করা যায় যে এ ধরনের শিক্ষিত/প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজের পরিবার, প্রতিবেশী এবং সমাজকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন জ্ঞানের আলোকে সমৃদ্ধির দিকে নিতে পারবে। গ্রামেরই একজনের জ্ঞানভিত্তিক সমৃদ্ধি অন্যদের কাছে উদাহরণ হিসেবে গণ্য হবে এবং গ্রামের অন্যান্য তরুণ-তরুণীর উন্নতির পথ দেখাবে। তাদেরই একজনের এই অর্জন দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত গ্রামের জনগণের মধ্যে আশার আলো জ্বালাতে পারে এবং তাদের সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখাতে পারে। তবে সেই তরুণ-তরুণীকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করার জন্য প্রথমেই নূ্যনতম উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

জ্ঞানভিত্তিক এলাকা উন্নয়ন ধ্যান-ধারণা বাস্তবায়নের জন্য যে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজন হবে তার প্রধান প্রতিবন্ধক হবে অর্থায়ন। ব্যক্তি বিশেষের পরিবারই এই শিক্ষা/প্রশিক্ষণের ব্যয়ভার বহন করবে বলে আশা করা যায়। তবে বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থার কারণে অধিকাংশ পরিবারের পক্ষেই এমন শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা কঠিন হবে। শিক্ষা ঋণ পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে এই সমস্যার আংশিক সমাধান হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার বা/এবং এনজিওগুলো শিক্ষা ঋণ স্কিম প্রবর্তন ও পরিচালনার বিষয় বিবেচনা করা উচিত। এ ব্যাপারে একটি শিক্ষা ব্যাংক স্থাপন করা যেতে পারে যার মাধ্যমে একদিকে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জনগণ সামাজিক বিবর্তনের জন্য বাজারমুখী উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিতে পারে এবং অন্যদিকে জ্ঞানভিত্তিক এলাকা উন্নয়নের মহতী স্বপ্নও বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পাবে। এই প্রক্রিয়াতে দারিদ্র্য চক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হতে পারে। শিক্ষা ব্যাংক এ ধরনের শিক্ষা অর্জনকারীদের অর্থায়নের একটি মাধ্যম হতে পারে এবং তারা সহজশর্তে ফেরতযোগ্য শিক্ষা ঋণের সুযোগ নিতে পারে। এই প্রক্রিয়া দারিদ্র্যচক্র ভাঙার একটি মৌলিক কাঠামোগত পদক্ষেপ হতে পারে। আবার অন্যদিকে এই প্রক্রিয়াটি একটি অনুঘটক (পধঃধষুংঃ) হিসেবে কাজ করতে পারে এবং মডেল হিসেবেও গণ্য হতে পারে। শিক্ষা ব্যাংক শিক্ষা খাতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সহজশর্তে ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন, শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য ঋণ প্রদান ইত্যাদি। শিক্ষা ব্যাংকের পুঁজির সংস্থান হতে পারে বিভিন্ন উপায়ে, বিশেষ করে উন্নয়ন সংস্থা থেকে অনুদান ও ঋণ প্রদান যেসব ব্যক্তির জনসেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং যারা যুক্তিসঙ্গত মাত্রায় পুঁজির ওপর লাভের প্রত্যাশা করেন তাদের কাছে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে। দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধি সৃষ্টিই হবে অনুদানকারীর ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত তৃপ্তি আর শেয়ার বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত থাকবে একটি যুক্তিসঙ্গত হারে পুঁজির ওপর আর্থিক মুনাফা। শিক্ষা ব্যাংকটি বাণিজ্যিক নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হবে তবে এর মূল বিনিয়োগের ক্ষেত্র হবে শিক্ষা, দক্ষতা, উন্নয়ন এবং এ সম্পর্কিত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তোলা। শিক্ষা ব্যাংকটি একটি শিক্ষা সমবায়ের রূপ ধারণ করতে পারে।

কমিউনিটি পর্যায়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের একটি পদক্ষেপ হিসেবে, জ্ঞানভিত্তিক এলাকায় উন্নয়ন ধারণার আওতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইইউবিএটির মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চালিয়ে প্রতিটি গ্রাম/মহলস্নাতে একজন করে পেশাদারি গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা যেতে পারে। এই পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য এবং জ্ঞানভিত্তিক এলাকায় উন্নয়নের ধারণাকে বাস্তবায়নের জন্য আইইউবিএটিতে শিক্ষা অর্থায়নের জন্য পারিবারিক সম্পদের সম্পূরক হিসেবে সাহায্যের বিশেষ ব্যবস্থা আছে, যেমন স্কলারশিপ, অনুদান, বেতন মওকুফ, ডেফার্ড পেমেন্ট, শিক্ষাকালীন কর্মসংস্থান, বিশেষ সুবিধা, শিক্ষা ঋণের (আইএমসিএসএল) মাধ্যমে এবং অনুরূপ সাহায্য। আইইউবিএটির নীতি হলো, যোগ্যতাসম্পন্ন এবং পেশাদারি উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী সব শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের আয়ের নিরিখে যথোপযুক্ত শিক্ষা অর্থায়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়া। এই ধারণাটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ তার জন্মস্থানের (গ্রাম/ওয়ার্ড/মহলস্না) একজন এইচএসসি পাস বা সমশিক্ষা মানের তরুণ-তরুণীকে আইইউবিএটির কোনো ডিগ্রি/ডিপেস্নামা/সার্টিফিকেট প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। বর্তমানে আইইউবিএটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচার, ইকোনমিক্স, টু্যরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এবং নার্সিংয়ের ওপর পেশাদারি শিক্ষাক্রম চালু আছে। ভর্তিতে উদ্বুদ্ধ করা ছাড়াও তার কাজ হবে ছাত্রছাত্রীর পারিবারিক আর্থিক অবস্থার একটি মূল্যায়ন করে তাদের প্রোগ্রাম সম্পর্কিত ফিস শিক্ষাকালীন সময়ে পরিশোধ করা ক্ষমতা কতটা আছে তা নির্ণয় করা। যারা শিক্ষাকালীন সময়ে সম্পূর্ণ ফিস প্রদান করতে পারবে না তাদের জন্য আইইউবিএটিতে প্রচলিত ডেফার্ড পেমেন্ট বা অন্য কোনো বিকল্প সুবিধার আওতায় ঋণ প্রদানের জন্য আইইউবিএটি কর্র্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা। পেশামূলক শিক্ষা এবং আর্থিক সহায়তার সুযোগ সম্পন্ন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের রেফার করা যেতে পারে। উপর্যুপরি সমাজের এই ব্যক্তির করণীয় হবে তার অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীটিকে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষায় ধাতস্ত হওয়ার কঠিন সময়টুকুতে লেখাপড়ায় উৎসাহ প্রদান এবং মানসিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। ফেল করা শিক্ষার্থীর অগ্রগতি সম্বন্ধে রেফারিকে শিক্ষাকালীন সময়ে অবহিত করা হবে যাতে তিনি একদিকে এ সম্পর্কে তথ্য পেতে পারেন এবং অন্যদিকে লেখাপড়ায় তাকে অব্যাহতভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। আইইউবিএটি শিক্ষার্থী পাস করে কর্মজীবনে প্রবেশ না করা পর্যন্ত প্রতি সেমিস্টারের ফলাফল রেফারির কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। এর ফলে রেফারি ছাত্রছাত্রীর ব্যক্তিসত্তার উন্নতিতে তার অবদানের প্রতিফলন দেখতে পারেন। এই ভর্তি প্রক্রিয়ায় উদ্বুদ্ধ করা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তি এলাকা উন্নয়নে জ্ঞান/দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে জন্মস্থানের ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবেন এবং একই সঙ্গে তার কমিউনিটিতে স্বনির্ভরতার বীজ বপন করবেন।

জ্ঞানভিত্তিক এলাকা উন্নয়ন ধারণা জনগণের একটি অংশকে দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সমৃদ্ধির যুগে প্রবেশের জন্য তৈরি করার একটি বলিষ্ঠ উদ্যোগ। শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন অর্থাৎ জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে আর্থিক সম্পদ এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জ্ঞানের ভিত্তিতে সমৃদ্ধশালী স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার এই মহতী প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ জাতির জন্য একটি অনুকরণীয় প্রত্যয়ের জন্ম দেবে। এর ফলে দেশের উন্নয়ন ও আত্মমর্যাদাশীল সম্পদশালী জাতি গঠনের পথ প্রশস্ত হবে।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<49559 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1